চন্দন মানিয়া অঙ্গেতে লেপিনু চরম আনন্দ ভরে
আব্দুল আজিজ তকি
যেখানে পাতা আন্তে বাঙালিদের পান্তা ফুরায় সেখানে সময়ের আজরাইল না আসা পর্যন্ত বক্তৃতা ফুরায় না। ১৯ শে মার্চ ২০১৫, মন্টিফিউরি সেন্টারে যে অনুষ্ঠানটি হল বলতেই হয় লন্ডনে এটা ছিল নিরস, নিরানন্দ বয়ানের অত্যাচার বিহীন একটা অভুতপূর্ব সমাবেশ। হাজারো অনুষ্ঠানের চেয়ে ব্যতিক্রম। উপস্থিত মেহমানেরা বক্তৃতা বঞ্চিত হলেও মেহেরবাণী করে দাঁতে দাঁতে করতাল বাজান নাই অথবা জাতে জাতে জাতধরে বক্তৃতা যুদ্ধেও লীপ্ত হন নাই। উপস্থিত সুধীজনের ধৈর্য্য, শ্রোতামন্ডলীর সুখাবস্থান আর শীল্পীদের নিরাপদ, নির্ঝন্ঝাট বিচরণে পুরো দু’টি ঘন্টা ছিল মুখরিত। সঞ্চালক যখনি ‘বক্তৃতাহীন অনুষ্ঠান’ বলে ঘোষনা দিলেন সাথে সাথে যে নিরঙ্কুশ করতালি বাজলো তার আনন্দে মনভরে গাইতে ইচ্ছা হলো ‘তুমি মঙ্গল করো মম মর্ম ঘোচায়ে।’ লন্ডনে সম্ভবত এই প্রথম একটা অনুষ্ঠান বক্তৃতার নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পেয়েছে এবং আয়োজকরদের কাছ থেকে তার ন্যায্য বিচার ও উপযুক্ত আচরণ নিতে পেরেছে। না হলে একাত্তরে যেমনি পাঞ্জাবীদের অত্যাচারে আমাদের মাটি রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল তেমনি এখানকার অনুষ্ঠানাদীতে বক্তাদের ভীড় আর বক্তৃতার অত্যাচারে আর অনাচারে আমাদের অন্তরটাও দুর্দশাগ্রস্থ ও রক্তাক্ত হওয়ার উপক্রম। দুরবস্থার সংকটকালীন সময়ে বক্তৃতা আর বক্তাদের যন্ত্রনা থেকে একটিবার হলেও রেহাই পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট এর আয়োজন ও তত্ত্বতাবাশকে শাবাশ বলতেই হয়। বুদ্ধির জোরে হোক অথবা সৃষ্ঠিকর্তার কৃপায় হোক তারা এ কাজটা করতে পারলেন বলেই সাধুবাদ একবার নয় সহস্রবার।
সতেরো মার্চ ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে দিবসটি পালিত হল মন্টিফিউরি সেন্টারে। মানের তুলনা না করে প্রাণের আবেগে বলছি অনুষ্ঠানটা ছিল অতি সহনীয়, সর্বজন গ্রহনীয়। এমন সব হাজারো অনুষ্ঠানে দুর্ভাগা শ্রোতা হয়ে যেতে যেতে মন মানসিকতাটা একেবারেই ভোঁতা হয়ে গেছে। এসবে আমি অধমের আর পা বাড়াতে ইচ্ছে করেনা। শীবের গীত গাইতে গাইতে আয়োজক থেকে প্রযোজকরা পর্যন্ত শীব সুন্দর হওয়ার খায়েসে শাখরেদ সমেত থাকেন উচ্ছল ছল ছল। একটা ভাল কথা শোনার, একটা সুন্দর কিছু জানার অথবা বিষয়ভিত্ত্বিক আলোচনা করার কণা পরিমান সুযোগ কখনো মেলেনা। অনুষ্ঠানগুলোতে প্রথমেই চলে যায়গা দখলের পর্ব। তারপর বক্তৃতা পর্ব ও ফটো তোলা পর্ব। মাঝে মধ্যে চলে কথা কাটাকাটি পর্ব, ধাক্কাধাক্কি পর্ব, হাতাহাতি পর্ব এবং চেয়ার ছোড়াছুড়ি পর্ব। তারপর পেপার পত্রিকা আর সোস্যাল মিডিয়ায় গালাগালি পর্ব। এমনিকরে বেশীরভাগ কালচারেল অনুষ্ঠানাদি আলসারাক্রান্ত হয়ে কালচার (culture) থেকে এগ্রিকালচারে (agriculture) রূপান্তরিত হয়।
এমন সভা সমিতিতে উপস্থিত হলেই চোখে পড়ে বিশেষ অতিথিদের একটা লম্বা ফিরিস্তি। এদের নামের সাথে বিশেষন আর পদবী লাগিয়ে এক এক করে সকলকে ডায়াসে ডেকে নেয়া হয়। আগে পিছে বসাতে বসাতে যখন ডায়াসের যায়গায় কুলায়না তখন পাশ ঘেষে ঘেষেও ডেকে নিয়ে বসানো হয়। অতিথিরাও বেশ গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে নিজেদের যায়গা দখল করেন। আবার যাদের ডাকা হয়না কিংবা ডায়াসে নেয়া হয়না দেখা যায় তাদের অনেকের বুক ফেটে টুকরো টুকরো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য উপস্থিত সকলেই নেতা, সকলেই বক্তা। হিসাবনিকাশ করলে বিষয়টা দাঁড়ায়, সব শ্রেুাতারাই নেতা আর সব নেতারাই বক্তা। এমনটি দেখে ভাবি, হায়রে, সাতই মার্চ ১৯৭১ সালে যদি এমন ঘটনা ঘটতো, সব শ্রেুাতারাই এভাবে নেতাপেতার অধিকারী হতেন আর তাদেরকে ডেকে ডেকে ডায়াসে নেয়া হতো তাহলে বাংলাদেশটাই নেতা সমুদ্রে ভেসে যেত। তখন সাধারন জনগণনের ভাগ্যাকাশে কি ঘটতো আল্লাই মালুম।
লন্ডনের সভা সমিতির সবচেয়ে কষ্টদায়ক অধ্যায় ‘বক্তৃতাংশ’। এই অংশের চৌদ্দ আনা সময় মাননীয়দের নাম আর লকবের লাঞ্চনায় লুন্ঠিত। বাকী দু’ আনা সময় শীবের গীত। ডায়াসে যারা বসেন সেই সকল বিদগ্ধজনের বয়ানের চিল্লা-চিল্লি আর হাত কপচানি দেখামাত্র কপালে হাতচাপা দিয়ে মাথা ব্যথার উপসম খোঁজতে হয়। সকলেই যেন বক্তৃতায় আত্মোৎসর্গ করে নিজেকে সবজান্তা ও বিরাট স্বার্থত্যাগী প্রমানে ব্যস্ত। শুরুতেই দেখা যায় সঞ্চালক কানে কানে ‘সময় সর্ট’ বলে দেন। কিন্তু বল্লেই কি শর্ট হয়। পঞ্চাশ জন বক্তার নামের ঘোষনা থেকে শুরু করে মাইকের সম্মুখে এসে দাঁড়ানো, সেই সাথে সকল মাননীয়দের উদ্দেশ্য করতে করতে একশো মিনিটের শ্রাদ্ধ। কোন কোন সময় বক্তারা ভাব ধরেন।নিজেদের বক্তৃতার সময়টুকু প্রধান অতিথির জন্য উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ করতে গিয়ে নিজে একটা বক্তৃতাও দিয়ে যান।নিজের জন্য নির্ধারিত কতটা সময় ছিল আর কতটা সময় উৎসর্গ করলেন অতিথিকে কেউ জানিনা। এভাবে দ্বারের অতিথিদের উপদ্রবে দাওয়াতি অতিথির সময়ের বারটা বাজে আর সেই সাথে বক্তৃতাটাও খুন। শোনা হয়না প্রধান অতিথির কথা। ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে বসেই তিনি বারবার তাঁর নামটির উচ্চারণ শুনলেন আর কাচুমাচু করে নিজের চেহারা প্রদর্শন করলেন কিন্তু বক্তৃতা দিতে পারলেন না। সভা সমিতির আয়োজন কেনইবা করা হল, কেনইবা ডাকঢোল পিটিয়ে মানুষজন জড় করা হল বোধগম্য নয়। নিজেরাই কি নিজেদের চেহারা ছুরৎ আর কথকথন শুনার তাগিদে জড় করলেন বুঝিনা। আমরা এমন আয়োজনে কি নিলাম আর কি দিলাম একটিবারও কি সে মূল্যায়নটা করি? যে দেশে থাকি সেই দেশের অনেক আদব খাছলতইতো ধারণ করি কিন্তু তাদের কাছ থেকে এতটুকুু সৌজন্যবোদ শেখার কি চেষ্টা কখনো করিনা? কই এই দেশের মিটিং ফিটিং এ গেলে বক্তাদের আর বিশেষ অতিথিদেরতো ভিড় জমে না! প্রধান বক্তার বক্তৃতা মাঠে মারা যায় না। এমন সব বেইজ্জতি কাজ কারবারতো কখনো চোখে পড়েনা? হায়রে কপাল, দানা-পানির টানে নিজের দেশ ছেড়ে লন্ডনে আসলাম কিন্তু বক্তৃতার তাড়নায় কোন এক সময় হয়তো এই লন্ডন শহরটাও ছাড়তে হয়।
সাফাই গাইছি না, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনকে বিশ্বনন্দিত শ্রেষ্ট আয়োজনও বলছি না। পাওয়া না পাওয়ার কথাও এখানে উঠাতে চাইনা। শীল্পীরা কেমন শৈল্পিক উস্তাদি দেখালেন তারও মূল্যায়ন করছি না। এখানে শুধু নিজের সন্তুষ্টিটা প্রকাশ করছি। ভালমন্দ বাচবিচার করার অভাবহীন লোকবল বাঙালির ঘরে ঘরে। সুতরাং এমন জিম্মাদারীও নিতে চাইনা। শুধু প্রকাশ করতে চাই, গরীবি হালতে হলেও বক্তৃতার যন্ত্রনা আর পলিটিক্সের পরপীড়ন থেকে একটিবারের জন্য মুক্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মপালনের অনুষ্ঠান। বর্তমানে ইংল্যান্ডের একজন নামকরা গায়ক ও গান লেখক ঞযড়সধং ঊফধিৎফ একটা খাাঁটি কথা বলেছিলেন ‘ One of the interesting things here is that the people who should be shaping the future are politicians. But the political framework itself is so dead and closed that people look to other sources, like artists, because art and music allow people a certain freedom’
অর্থাৎ আকর্ষণীয় বিষয়গলোর একটা হল যে, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়বেন তারা হলেন রাজনীতীবিদ। কিন্তু রাজনীতির কাঠামো এতই নি®প্রাণ ও নিমীলিত যে সাধারণ জনমানুষ মুক্তির জন্য অন্য উৎস খোঁজছে- যেমন শীল্পীদের। কারণ, কলা এবং সঙীত মানুষকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেয়।
সংস্কৃতি দিয়ে সংহতি আর মুক্তির পথ যদি বঙ্গবন্ধু সাংস্কুৃতিক জোট খোঁজে তা’তে কেউ অকারণ অধৈর্য্য হলে বড়ই দুঃখ পাব কারণ (সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবিনয়ে বলছি)- রাজনীতির মঞ্চ আর সংস্কৃতির মঞ্চ এক নয়। যারা এই সংস্কৃতি মঞ্চের খোঁটা ধরেছে, তারা কেউই নিষ্প্রাণ রাজনীতির মঞ্চটিকে সাফ-সুতরো করে সাজাবার চেষ্টা করছে না। রাজনীতির ভাইয়েরা আপনারা সে কাজটি করেন। আপনাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা সর্বদা আছে এবং সেটা আমরণ রাখতে চাই। আপনারা নিজেদের ঢোল নিজেরা না বাজালেও অসুবিধা নেই। মুর্শিদ এর দিব্যিকেটে বলছি, আমাদের মত অনেক নালায়েক আপনাদের কাজকামের প্রশংসা করতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রশংসা করার সে যায়গাটা আপনারা তৈরী করুন। দয়া করে ধানাই-পানাই থেকে বিরত থাকুন। রাজনীতির নিষ্প্রাণ ও নিমীলিত কাটামোটাকে সজিব করেন দেখবেন চেয়ারই আপনাকে ঠেনেহেছড়ে তার কোলে নিয়ে বসাবে। এখানে ডাকাডাকি আর হাকাহাকির প্রয়োজন পড়বেনা। জানি রাজনীতির রাজপালদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিক জোটের কাজেকর্মে অসন্তুষ্টি দেখাবেন, চরম অপবাদ আর নিন্দা জানাবেন। কোন আপত্তি, অভিযোগ অথবা অনুযোগ নেই। আপনাদের সকল আলোচনা, সমালোচনা, বাদ, অপবাদ ও নিন্দাকে মাথায় নিয়ে শ্রী রাধার ন্যায় বলবো- ‘চন্দন মানিয়া অঙ্গেতে লেপিনু চরম আনন্দ ভরে’।
(২৭ মার্চ ২০১৫)