হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের ঐতিহ্যের প্রতীক ‘জালালী কৈতর’

Jalali-Koitorসুরমা টাইমস ডেস্কঃ সিলেটের ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাচীনকাল থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে জালালী কবুতরের নাম। কিন্তু কালের বিবর্তনে শান্তিপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী সেই কবুতর হারাতে বসেছে। নিকট অতীতেও সিলেটের আকাশ জুড়ে অবাধে বিচরণ করতো এ অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক ‘জালালী কৈতর’। বিশেষ করে পুরনো স্থাপণা, মসজিদ, মন্দির এমনকি অনেক বাসা বাড়ির নিরিবিলি জায়গাটুকু তাদের নিরাপদ ঠিকানা ছিলো তাদের। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে বিলীন হবার পর্যায়ে চলে এসেছে জালালের আদরের এই প্রাণীটি।
হযরত শাহজালাল (রহ.) যখন সিলেটের মাটিতে তার পদচিহ্ন রাখেন, তখন থেকেই এই জালালী কবুতরের বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ সিলেটের হাজার বছরের ঐতিহ্য আর জালালী কবুতর যেন এক সুতোয় গাঁথা। কয়েক বছর আগেও সেই সুনাম ঐতিহ্যের সঙ্গে বহমান ছিলো। পর্যটকদের কাছেও এই কবুতরের কদর ছিলো বেশ পুরনো। শুধু হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এলাকা নয়, শান্তির Jalali-Kobutorপ্রতীক এই কবুতর এক সময় সিলেটের সর্বত্র দেখা যেতো। বিশেষ করে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বীনব্রীজের লোহার পাতের ফাঁকে ফাঁকে সারি সারি কবুতর অবাধে বিচরণ করতো। বিকেল হলেই দূর দূরান্ত থেকে উড়ে এসে তারা ক্বীনব্রীজকে মুখর করে রাখতো।
এই দৃশ্য শুধু সিলেটবাসীকে নয়, দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদেরও মুগ্ধ করতো। সন্ধ্যার পরও ক্বীনব্রীজ এলাকায় উপচেপড়া কবুতরের খুনটুসি পথচারীদের দিতো নির্মল আনন্দ। সময়ের বিবর্তনে ক্বীনব্রীজ জুড়ে জালালী কবুতরের সেই আদি রুপ, সেই লাবণ্য আজ আর নেই। ক্বীনব্রীজ ছাড়াও সিলেটের অনেক পুরনো বাসাবাড়ি, ছাত্রাবাস, পুরনো স্থাপত্য জুড়ে কবুতরের ছিলো নিত্য বসবাস। দেখা যেতো সিলেট ওসমানী হাসপাতাল, শহীদ সামসুদ্দিন হাসপাতাল, প্রাচীন বাসাবাড়ির মধ্যে শেখঘাট জিতু মিয়ার বাড়ি, শেখঘাট লাল ব্রাদার্সের বাড়ী, তৎকালীন খাজাঞ্চি বাড়ি, মজুমদার বাড়ীসহ অনেক প্রাচীন দালান কোঠায় তাদের ছিলো স্বাধীন বিচরণ।
একইভাবে দেখা যেতো, সিলেটের পুরনো রেলস্টেশন এলাকায়। ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের উড়াউড়ি স্টেশনে অপেক্ষমান যাত্রীদের কাছে ছিলো অন্যরকম এক ভালোলাগার, প্রশান্তির। সেই সঙ্গে মসজিদ মন্দির ঘিরেও প্রবাহমান ছিলো তাদের প্রাত্যহিক জীবন। প্রতিদিন ভোর হলে নগরীর কাজিরবাজার, শেখঘাট এলাকার বৈদ্যুতিক তারের উপরও দলে দলে বসে থাকা তাদের সরব উপস্থিতি নজর কাড়তো শহরের প্রকৃতিপ্রিয় মানুষের। কারণ শেখঘাট এবং কাজির বাজার এলাকায় রয়েছে প্রচুর ধান চালের আড়ত। এসব আড়তের সামনে খাবারের সন্ধানে হয়তো প্রতিদিন ভিড় জমাতো তারা। একইভাবে দেখা যেতো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে এসবের কোথাও এখন আর তাদের সারি সারি পদচিহ্ন চোখে পড়ে না। ফলে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে জালালী কবুতরের পৃথিবী।
বর্তমানে হযরত শাহজালাল এবং হযরত শাহপরানের মাজারসহ আরো কয়েকটি মাজারের প্রাঙ্গণ জুড়ে যে কয়টি জালালী কবুতর আছে-তারাই ধারণ করে আছে ঐতিহ্যের শেষ অস্তিত্ব। তবে,এসব মাজারেও দিন দিন কবুতরের সংখ্যা কমে আসছে। মানুষের হিংস্রতাই যেন ক্রমশও জালালী কবুতর বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
চলমান হিংস্রতা থামাতে না পারলে একদিন সিলেট থেকে বিলীন হয়ে যাবে জালালী কবুতরের অস্তিত্ব। কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে সিলেটের ঐতিহ্য থেকে কবুতরের সোনালী দিন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র সদস্য সাংবাদিক সামির মাহমুদ বলেন, ‘কবুতর হারিয়ে যাবার অন্যতম কারণ হলো পরিবেশ বিপর্যয়। কবুতরের বাসযোগ্য বসবাস আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। তাছাড়া খাদ্য দ্রব্যের সঙ্গে যে সকল কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়-এসব কেমিক্যালযুক্ত খাবার খেয়েও তাদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিলেটের ধর্মপ্রাণ মানুষ একসময় জালালী কবুতরকে হযরত শাহজালালের আমানত হিসেবেই দেখতো। পরবর্তীতে এক শ্রেণীর মানুষ অবাধে কবুতর শিকার করে খেতে শুরু করলো। এর ফলে ক্রমান্বয়ে কবুতরের সংখ্যা কমতে শুরু করলো। তবে এখনো ইচ্ছে করলে সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসন কবুতর প্রজননের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে সংরক্ষণ করা সম্ভব।