সুনামগঞ্জ : লোক সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ জনপদ
সুনামগঞ্জ ঃ লোক সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ জনপদ
এডভোকেট জিয়াউর রহিম শাহিন
রাধাraবাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের এক অপরিহার্য নাম সুনামগঞ্জ। কবিতার দেশ, গানের দেশ নামে রয়েছে এর সুপরিচিতি। দেশের লোক সংগিতের ধারায় সুনামগঞ্জের লোকজ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত ও শাহ আব্দুল করিম প্রমূখের সৃষ্টিকর্ম সত্যিই বৈচিত্রময়। ইতিহাসের সাদামাটা, শুকনো ও নির্দয় পাতায় তাদের স্থান অমলিন। সৃষ্টিকর্মে তারা বাঙময়। ভাটি বাংলার নিসর্গ হতদরিদ্রদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে তাদের দ্যোতনা এবং সুরের মায়াবি বন্ধনের মাধ্যমে গনমানুষের চিত্তে সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনার ফোয়ারা বইয়ে দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জননন্দিত সমৃদ্ধ কবি সাহিত্যিকেরা।
রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ। বৈষ্ণব পদাবলির মহারাজা। অনেকে বলেন সুনামগঞ্জের রবিন্দ্রনাথ। জন্ম ১৮৩৩ সনে সুনামগঞ্জের আট আউলিয়ার পদধুলিতে ধন্য জগন্নাথপুরের কেশবপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা রাধা মাধব দত্ত, মাতা সুবর্ণ দেবি। তত্ত্ব পিপাসু রাধারমণ বাল্যকালেই পিতাকে হারান। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল রাধারমণ কাগজে কলমে গান লিখেছেন বলে প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। তিনি লোক সঙ্গিত সহ বিভিন্ন ধরণের গান রচনা করতেন ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। লোক সঙ্গিত এদেশের লোক সাহিত্যের জনপ্রিয় একটি শাখা। লোক সঙ্গিতের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ধামাইল গান। নান্দনিকতায় ভরপুর সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং আসামের বরাক উপত্যকায় আঞ্চলিক নৃত্যগীতি বেশ জনপ্রিয়। রাধারমণ ধামাইল নৃত্যের স্রষ্ঠা না হলেও তিনি ধামাইলকে উজ্জ্বিবিত ও সঞ্জিবিত করেছেন বাংলা লোকনৃত্যে। হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম ও রাধারমণের গানে রয়েছে প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, বিরাগ, বিচ্ছেদ, আধ্যাত্বচেতনা যাহা চিন্তা জগতকে অনেকটা আলোড়িত করেছে বিশেষ এক সুষমায়। অসামান্য আবেগ আর আকর্ষনে তাদের গান উচ্চকিত। রাধারমন, দুরবিন শাহ্, হাছন রাজা, আব্দুল করিম, সিতালং শাহ, আরকুম শাহ, সৈয়দ শাহনুর, আছিম শাহ, ইউসুফ শাহ প্রমূখ আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। রাধারমণ দত্ত মুলতঃ ভাবালোকের কবি, জীবন-যৌবনের কবি, প্রেমের কবি, সৌন্দর্যের কবি। জীবন জিজ্ঞাসায় পরম প্রিয়কে পাওয়ার দুরন্ত বাসনাই কবিকে শান্তির নীড় ছেড়ে নলুয়ার হাওরে যেতে বাধ্য করেছে। কবি যখন বলেন,
অরন্য জঙ্গলার মাঝে বাধিয়াছি ঘর
ভাই নাই বান্ধব নাই কে লইব খবর-
তখন আমরা অনুভব করি এ-তো সত্যিই বাউল। হযরত শাহজালালের সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন, অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ওলি আউলিয়া এবং গুণিজনের পদধূলিতে ধন্য এ সিলেট মুসলমান, হিন্দু ও অন্যান্যদের ধর্ম-কর্ম সাধনায় তীর্থস্থান হিসাবে পরিগণিত। শ্রী চৈতন্য দেবের পিতৃভূমি হযরত শাহজালালের সাধনকেন্দ্র সিলেটের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্ব। তাইতো সিলেট আধ্যাত্বিক রাজধানী।
সিলেট শরিফে ধর্মের বাড়াবাড়ি নেই বললেই চলে। এখানে সুফিবাদ অত্যন্ত প্রসারিত। সিলেটের উর্বর মাটিতে মানবতার কল্যাণে সুফিবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এখানে চৈতন্যবাদের অস্থিত্ব খুজে পাওয়া যায়। চৈতন্যবাদে উদ্ভুদ্ধ হয়ে বাউল রাধারমণ যখন বলেন,
ভ্রমর কইও গিয়া
শ্রী কৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে-
তখন তাকে সত্যিকারের ভাববাদি বলেই মনে হয়। আধ্যাত্বিক রাজধানি, গানের রাজধানী সিলেটকে গান, ইসলামী গজল ও সুরের মুর্চনায় মুখরিত করেছেন এখানকার কবি সাহিত্যিকেরা। বাউল সাহিত্য মুলতঃ মুসলমান এবং হিন্দুরই সাহিত্য। এখানে কেউ কাউকে আঘাত করেনা, করতে পারে না। রাধারমন, হাছন রাজা, আব্দুল করিম স্রষ্টার অস্তিত্বে সর্বান্তকরনে বিশ্বাসী ছিলেন, ইসলাম ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মানে অটুট ছিলেন। আজকাল কেউ কেউ তো গর্ব করেই নিজের সৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারই করেন। অত্যাধুনিকতার নামে অশ্লীলতা আমাদেরকে বর্জন করতেই হবে। যুগে যুগে কবি সাহিত্যিক তথা সচেতন জনগোষ্টির কন্ঠে এ কথাটি উচ্চারিত হয়েছে বারবার। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত ওলি আউলিয়া, নন্দিত আলেম-উলামা, গুনিজন এবং জাতির গর্বিত সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের লালন ভূমি এই বাংলাদেশে কোন ধর্মদ্রোহী কিংবা মানবতা বিরোধীদের স্থান নেই, থাকতে পারে না। সমাজ সামাজিকতা জীবন মরন প্রেম ভালবাসা ইত্যাদি নিয়ে তথ্য সাহিত্যের কবি- বৈষ্ণব কবি রাধারমন তিন হাজারের ও বেশি হৃদয়স্পর্শি গান রচনা করেছেন। তার প্রতিটি গানের গভিরতা যেন নদীর তলদেশ স্পর্শ করে, গানের আবেদন যেন পর্বতের উচ্চতাকে ও হার মানায়। যে নামটির বিভা বা সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি প্রচারাভাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশের বরেন্য এ কবি বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতা সংগ্রহ, বহুল আলোচিত বাংলা পিডিয়ায় একেবারেই অনুপস্থিত। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে ঐতিহ্য মন্ডিত জগন্নাথপুরের সন্তান রাধারমন নানা অনিয়মের গ্যাড়াঁকলে বন্দি হয়েই আছেন। কবির প্রতিটি গান কাল থেকে কালান্তরে টিকে থাকবে আপন মহিমায়। তার গানগুলো এ অঞ্চলের সঙ্গিত প্রিয় অসংখ্য ভাবুকদের প্রতিনিয়ত আলোড়িত করে। জীবনের কবি, যৌবনের এ কবির,
জলের ঘাটে দেইখ্যা আইলাম কি সুন্দর শ্যামরায়
শ্যামরায় ভ্রমরায় ঘুইরা ঘুইরা মধু খায়-
গানটি সত্যিই অপূর্ব, অনবদ্ধ। রাধারমনের শব্দ চয়ন মাধুর্য্যমন্ডিত, সুরের মুর্ছনায় অসাধারণ। তাহার সঙ্গিতের অখন্ড ভাবই হচ্ছে সহজিয়া দর্শন। রাধারমনের গানের সুনির্দিষ্ট স্বরলিপি নেই বলেই বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে গাইছেন তার গাণ। বাউল কবির গীত বাণী আমাদের লোক সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। ৫০ বছর বয়সে কবি ইটা ঢেউপাশার রঘুনাথ ভট্টাচার্য্যরে শিয্যত্ব গ্রহণ করে বিচরণ করতে থাকেন ভিন্ন এক জগতে। মরমি এ কবিকে নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আসর হয়েই যাচ্ছে। ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৩। সকালের তীর্যক রোদ বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার তখনও বেশ বাকী। জগন্নাথপুর স্বরূপ চন্দ্র সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে রাধারমন উৎসবে যোগ দিতে চারিদিকে অসংখ্য মানুষের ভিড়। পড়ন্ত বিকেলে আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থিত হন উপজেলা, জেলার শীর্ষ কর্তাব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের বরেন্য ব্যক্তিবর্গ। বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার সুযোগ হয়েছিল আমার। রাধারমন দত্তকে জাতীয় পর্যায়ে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জোর দাবী উঠেছিল ঐদিন। কিন্তু এ কবি আজও জাতীয় পর্যায়ে উপেক্ষিত।
হাছন রাজা। বাংলার এক মরমি মুকুট। এ সাধক গৃহি হলেও ছিলেন বিবাগি। ১২৬১ বাংলা সনের ৭ পৌষ সুরমা তীরের সুনামগঞ্জের এক জমিদার পরিবারে তার জন্ম। মৃত্যু ১৩২৯ সনের ২২ অগ্রহায়ন। বাংলা সাহিত্যের আকাশে হাছন রাজা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ১৯২৫ সনের ১৯ ডিসেম্বর কলিকাতার সিনেট হলে ভারতীয় দার্শনিক কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে এবং ১৯৩০ সনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হিবার্ট লেকচারে বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘পুর্ব বাংলার হাছন রাজার গান শুধু বাংলা সাহিত্যেই চমক সৃষ্টি করেনি-বিশ্বের বিভিন্ন দার্শনিক ও ভাবুকদের ভাবিয়েছে দারুন ভাবে’। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে হাছন রাজা তার পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরীকে হারান, কিছুদিন পর মা হুরমত জাহান বিবিকে হারিয়ে তিনি ভোগবাদি জীবন থেকে ভাববাদি জীবনে পদার্পন করেন। রাজা বিজয় সিংহের অষ্টম অধঃস্থন বংশধর হাছন রাজার ৭৭টি ঘোড়া ছিল বলে জানা যায়। যাদের মধ্যে জং বাহাদুর, কদমবাজ, দুলদুল, বীরবাহাদুর, বাংলা বাহাদুর ও ইয়াছির উল্লেখ যোগ্য। যে প্রেমে জ্বলে সেই জানে দহনের জ্বালা। মানব প্রেমের প্রজ্জ্বলিত আগুনের যন্ত্রনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাছন রাজা বলেন,
আগুন লাগাইয়া দিল কুনে, হাছন রাজার মনে
নিভেনা নিভেনা আগুন, জ্বলে দীলে জানে।
কবির স্মৃতি বিজড়িত সুনামগঞ্জের বাড়ীটি সত্যিই নয়নাভিরাম। ইহকাল পরকালে বিশ্বাসি এ কবি মানুষকে ঈমানি শক্তিতে বলিয়ান থাকতে আহবান জানিয়ে বলেন,
লা ইলাহা ইল্লাল লাহু জানিবায় সার
মোহাম্মদ মোস্তাফা নবি রসুল আল্লাহর।
যতদিন পুর্বাকাশে সুর্য উদিত হবে এবং পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হবে ততদিনই হাছন রাজা তার হৃদয় উদাস করা গানের মাধ্যমেই মানুষের হৃদ মাঝারে বিরাজ করবেন স্বগৌরবে। গান ও ভাবের জগতে নানা গুণে সমৃদ্ধ বিচিত্র এ মরমি কবির,
লোকে বলে, বলেরে ঘর বাড়ি ভালানায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার-
গানটি দারুন মর্মস্পর্শি। বাউলা এ কবি ছিলেন পাঞ্জাবের কামেল পীর সৈয়দ মাহমুদ আলী (রহঃ) এর মুরিদ। এ সাধক মহান আল্লাহর প্রেমে বিভোর থাকতেন অনেক সময়। তার,
‘বাউলা কে বানাইল রে
হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইল রে’
‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে
না কইলাম তার কাম’-
ইত্যাদি গানের ফরিয়াদ ভাবরাজ্যের বাসিন্দাদের অভিভুত করে। সুনামগঞ্জের অধিবাসিরা সেই পনেরশ শতাব্দি থেকে সংস্কৃত, বাংলা, সিলেট নাগরি, আরবী, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য সাধনা করে আসছেন। এ জেলা সিলেট বিভাগের সাহিত্য চর্চায় পথিকৃৎ বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। যে মৃত্তিকার ঘ্রাণে, যে নদীর স্রোতে, যে আকাশের নীলে এবং যে উর্বর মাটি শুধুই ফোকলের কথা বলে তারই নাম সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ লোক সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ জনপদ।
[ শাহ আব্দুল করিম। উর্বর এ জনপদের সফল ও স্বার্থক কবি। এ বাউল সম্রাটের জন্ম সুনামগঞ্জের কালনির উপকন্ঠে উজানধলে ১৯১৬ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারী। পিতা ইব্রাহিম আলী মায়ের নাম নাইয়রজান বিবি। দুঃখ কষ্টে তার বেড়ে উঠা। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত আব্দুল করিমের গান ও শিল্পে রয়েছে মানুষের নাড়ীর স্পন্দন। আর এ কারনেই তিনি কালজয়ী সমৃদ্ধ কবি। তার কালনির ঢেউ, গণসঙ্গিত, ধলমেলা ইত্যাদি সাহিত্যের পাতায় অমর। মরমি বাউল সাধক এবং সুফিদের মনুষ্যহৃদয়কে অনুভব করেই কবি বলেছেন, ‘মক্কাতে ক্বাবার ঘর, আদি ক্বাবা আদম শহর’। করিম যেন সত্যিই সুরে স্রোতস্বিনি-তার সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। কবির বাড়ী এবং তার কবরটি পড়ে আছে অনেকটা অবহেলা আর অবজ্ঞায়। প্রায় দুই হাজারের বেশী গানের রচয়িতা চারণ কবি আব্দুল করিম সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে এক অসাধারণ দিকপাল। সুনামগঞ্জের গরিয়ান সাহিত্য সংস্কৃতিকে তিনি বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করে আমাদেরকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। জীবন সংগ্রামে তিনি ক্ষত বিক্ষত হলেও গনমানুষের মুক্তির অন্বেষায় কাজ করেছেন অত্যন্ত মননশীলতার সাথে। তার জীবন ও সংগীত সকলের কাছে সমান বিস্ময়। কবির,
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটুগান গাইতাম’
‘আমি কুল হারা কলংকিনি
আমারে কেউ ছৈওনা গো সজনী’
গানগুলোর মাধুরি সাধারণ মানুষের লোহিতকণায় শিহরণ যোগায় প্রতিমুহুর্তে। আবহমান বাংলার লোকায়ত জীবনের সমঝদার কবি করিমের ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে’ গানটি জীবন যৌবনের পরিসমাপ্তিতে দেহতত্ত্ব ও পরজগতের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। একুশে পদকপ্রাপ্ত এ কবি ২০০৯ সনের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বৎসর বয়সে পাড়ি জমান না ফেরার জগতে। একুশ শতকের বাংলাদেশের হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম এবং রাধারমন চর্চার জোয়াড়কে নতুন ভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ তিন কবি আমাদের অমূল্য সম্পদ- এরা সত্যিই ত্রিরতœ। মরমি ও লোক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তাদের। মানব সভ্যতার উষালগ্নেই লোক সাহিত্যের সৃষ্টি। এ সাহিত্য অত্যন্ত প্রাচীন। লোক সাহিত্য মূলতঃ মৌখিকই। নানা যৌক্তিক কারণে সুনামগঞ্জকে লোক সাহিত্যের খনি বলা চলে। সুনামগঞ্জের লোক সাহিত্য দেশের পুরো লোক সাহিত্যকেই করেছে সমৃদ্ধ। মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাহিত্যরতœ সিলেটের লোক সাহিত্য সম্পদকে সাইত্রিশটি ভাগে ভাগ করেছেন। সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে সুনামগঞ্জের গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের আলোয় বিভাসিত বিশ্বের ফোকলোর পুরো জগৎটাই। ধামাইল, ঘাটু গান, রূপসি ব্রতের গান, বান্ধা গান, ধুরাগান, হিরালির গান, পাচালি, মরমি গান, প্রবাদ, ছড়া ইত্যাদি আমাদের পুরো লোক সাহিত্যকে করেছে সতেজ ও সজীব। হাছন রাজা, আব্দুল করিম ও রাধারমন সর্বত্রই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। সুনামগঞ্জের এ ‘ত্রিরতœ’ অন্তরের গহিনে রক্ষিত আলোর অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে খোঁজেছেন স্বীয় স্রষ্টাকে। রাধারমনের বিশ্বজনিন রক্তস্রোতের সাথে আব্দুল করিমের গণমুখি চেতনা একাতœ হয়ে হাছন রাজার আরাধনাকে করেছে মহিমান্বিত। তাদেরই কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা যায়। আত্মা পরমাত্মারই অংশ। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, দুর্যোগ, দুর্বিপাকের মাঝে তারা গানের জগতে সুনামগঞ্জকে সমৃদ্ধ করেছেন। গানের সংখ্যার বিচারে রাধারমন তাবৎ ফোকলের সাহিত্যের শীর্ষে হলেও তাকে নিয়ে আমরা কি রয়ে গেলাম শুধু আঞ্চলিকতার চত্বরেই? কবি রাধারমনের,
‘ভাইবে রাধারমন বলে শুনোগো সকলে
পঙ্গি না উড়িয়া যাইতাম ফিরিয়া কালের ঘাটে’-
গানটির ভাষা, চরন বিন্যাস সত্যিই অপূর্ব বৈচিত্রময় যা প্রত্যেক আউল বাউল মনকে স্পর্শ করে, আপ্লুত করে নানা ভাবে। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুনামদির সুনামগঞ্জের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়।
আউল বাউলের চারন ভূমি সুনামগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক কবি মোহাম্মদ আলী খান ভাবাবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলেছেন, ‘যদি কেউ শুনতে চান সমুদ্রের কল্লোল, অবগাহন করতে চান শরৎ রজনীর ঝিলিক ফোটানো জ্যোৎস্না ধারায়, কেউ যদি অনুভব করতে চান হৃদয়ের গহিনতম প্রদেশকে এবং অনুধাবন করতে চান মহান সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা তাহলে তাকে আসতে হবে রাধারমনের গাণের ভূবনে’। গীতি কবি, মরমি কবি ও লোক কবি হিসাবে অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন রাধারমন, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম লোক সঙ্গিতে সমাদৃত সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন অবলিলায়। গুণিজনের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন মানুষের সহজাত ধর্ম। এ তিন কবি সহ এ মাটির কবি সাহিত্যিকদের অসংখ্য গান আমাদের সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে। নিজস্ব গ্রামীণ সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ কবি সাহিত্যিকদের বাচিয়ে রাখতে আমাদেরকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে এবং অপসংস্কৃতির কালো ধোয়ায় আচ্ছন্ন এ জনপদের মানুষ যাতে কোন ক্ষেত্রেই শেকড় থেকে হারিয়ে না যায় সেদিকে নতুন প্রজন্মকে কড়া নজর রাখতে হবে। দেশ আমাদের মাতৃসম। এটি কি এখন মলিন? এটি কি আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে? জাতীয় সঙ্গিতের,
মাগো তোর বদন খানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি-
এর মর্মবাণী স্মরণে রাখতে হবে আমাদেরকে। কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা মরমী কবি রাধারমন দত্ত গোটা জগন্নাথপুরের সম্পদ, শতাধিক আউল বাউলের চারন ভূমি সুনামগঞ্জের এক আলোকবর্তিকা- দেশের বরেন্য কবি। রাধারমন দত্ত ১৯১৬ ইং সনে ৮২ বৎসর বয়সে তাঁর জন্মভূমি কেশবপুরে পরলোক গমন করলে তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে জাতির গর্বিত এ সাধকের অবস্থান এবং তাঁর সমাধিস্থলের পারিপার্শ্বিকতা অনেকের ন্যায় আমাকেও ক্ষুব্দ করে প্রতিনিয়ত। কবিদের প্রতি আমাদের সামাজিক অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাঝেও আমাদের হাছন রাজা, আব্দুল করিম, রাধারমন দত্ত সহ শেকড় সন্ধানী কবি সাহিত্যিকদের স্বগৌরবে বাচিয়ে রাখতে নতুন প্রজন্মের সময়োপযোগী সাহসী পদক্ষেপের কোন বিকল্প নেই। মূলতঃ শেকড় থেকেই শিকড়ে আরোহন। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে তৃণমূল থেকেই দায়িত্বশীলদের ন্যায় বিচারক হতেই হয়, অন্তত এদেরকে হীনমন্যতা এবং হীনস্বার্থে দলবাজির অশোভ নোংড়া খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ জাতির ললাটে আরো দুঃখ আছে। ধর্ম বিশ্বাসি ন্যায় বিচারকের মর্যাদাই আলাদা। কর্ম ক্ষেত্রে কবিকে কবি, লেখককে লেখক, শিক্ষাবিদকে শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদকে রাজনীতিবিদ হিসাবেই বিবেচনায় রাখতে হয়। জীবন একেবারেই ক্ষনস্থায়ী। আল্লাহর ফেরেস্তারা রয়েছেন পর্যবেক্ষনে। প্রতিটি মুহুর্তের কৃতকর্মের জন্য সকলকেই ‘এক জায়গায়’ অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। জগন্নাথপুর, দিরাই, সুনামগঞ্জ, সিলেট তথা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত এবং শাহ আব্দুল করিমকে পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতঃ জাতীয় পর্যায়ে সম্মানিত করা আজ সময়ের দাবী।
(সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিষ্ট)