রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ রাজশাহীর হযরত শাহ্ মখদুম (রহ:) বিমানবন্দরে বাংলাদেশ ফ্লাইং অ্যাকাডেমি অ্যান্ড সিভিল অ্যাভিয়েশনের সেসনা-১৫২ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান সিভিল অ্যাভিয়েশনের গ্রুপ ক্যাপ্টেন নাজমুল আনামের নেতৃত্বে অপর সদস্যরা বুধবার বিকেলেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা রানওয়ের পাশে থাকা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কমিটিকে দুই দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ও প্রশিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
এছাড়া দুর্ঘটনার পর শাহ্ মখদুম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে মুখে ‘কলুপআটা’য় গভীর রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিমানবন্দরের ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, দুর্ঘটনাটি যখন ঘটেছে তখন ঘড়ির কাঁটায় সময় দুপুর ঠিক ১টা ৫৮ মিনিট। তখন বিমানবন্দরে দায়িত্বরত দমকল বাহিনীর কর্মীরা জোহরের নামাজ ও দুপুরের লাঞ্চের বিরতিতে ছিলেন। প্রশিক্ষণ মুহূর্ত হলেও দমকল বাহিনীর অনুপস্থিতিতে বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণের সুযোগ নেই। অর্থাৎ বিমানবন্দরে দমকল বাহিনীর অনুপস্থিতিতেই নিহত প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক তামান্না রহমান ও তার প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন সাঈদ কামাল বিমান উড্ডয়ন করেন এবং অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পড়েন। দমকল কর্মীরা বিমানবন্দরে রেডি থাকলে দুর্ঘটনার পর অন্তত প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব ছিল।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, দুর্ঘটনার প্রায় ২০/২৫ মিনিট পরে দমকল কর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে বিমানের ককপিটে ইঞ্জিনসহ তামান্না রহমান জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়েছেন। তার প্রশিক্ষক সাঈদ কামাল গুরুতর আহত হয়েছেন। আহত প্রশিক্ষককে উদ্ধার হাসপাতালে পাঠানোতেও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাহিনী ও কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। নিরাপত্তা বাহিনী ও কর্তৃপক্ষের আগেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন স্থানীয় বহিরাগতরা। এসব বিষয় বৃহস্পতিবারের অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকায় এসেছে। এ থেকে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ও প্রশিক্ষকের দায়িত্বে অবহেলা সামনে চলে এসেছে।
তবে রাজশাহী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক এবং সিভিল অ্যাভিয়েশনের সিনিয়র উপ-পরিদর্শক উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করেন, দুর্ঘটনার জন্য প্রাথমিক কারণ হিসেবে জেনেছেন, বিমানটি উড্ডয়নের পর ঘুরেই কিভাবে জরুরি রানওয়েতে অবতরণ করা যায় সে বিষয়ে তামান্না প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। কিন্তু বিমানটি উড্ডয়নের পর ডান দিকে ঘুরতেই প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় দুর্ঘটনায় পড়ে। এসময় দ্রুত সিগনাল পাঠিয়ে নামতে গিয়ে পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে বিমানটি রানওয়ে ছুয়েই ছিটকে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। উদ্ধারকারীরা প্রশিক্ষক সাইদ কামালকে বের করে আনতে পারলেও তাঁর পাশে থাকা কো-পাইলট তামান্না রহমান হৃদি ককপিটেই জীবন্ত দগ্ধ হন।
সিআইডি পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটনাস্থল থেকে তামান্নার মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়। লাশের ময়নাতদন্তের সময় তার পিতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তামান্নার বড় ভাই শুভ পেশায় চিকিৎসক। ময়নাতদন্ত শেষে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারেই তামান্নার মরদেহ ঢাকায় পাঠানো হয়।
এদিকে বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানটির যান্ত্রিক ত্রুটি মুক্ততা এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ মুখে কলুপ আটায় কোনো উত্তর মিলছে না। কর্তৃপক্ষ শুধু বলছে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে কেন বিমানটি বিধ্বস্ত হলো।
জানা যায়, গত ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল রাজশাহীতে একটি প্রশিক্ষণ বিমান নামার সময় রানওয়ে থেকে দূরে সটকে পড়ে দুই পাইলট আহত হন। এরপর ঘটনাটি তদন্ত করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই প্রশিক্ষণ বিমানটির ইঞ্জিন ত্রুটিযুক্ত ছিল। যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর এই বিমানবন্দর থেকে সকল বিমান উঠা নামার আগে ইঞ্জিনসহ সকল যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নিদের্শের মধ্যেই সীমা বদ্ধতা রয়েছে।
তামান্না রাজশাহীতে পার্সোনাল পাইলট লাইসেন্স (পিপিএল) কোর্সে ২০১৩ সালে ভর্তি হয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, এ কোর্সে এককভাবে ৫০ ঘণ্টা বিমান চালাতে পারলে সনদ দেয়া হয়। এরপর কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স (সিপিএল) কোর্সে ভর্তি হতে হয়। সেখানে এককভাবে ১৫০ ঘণ্টা বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করলে সনদ দেয়া হয়। গত মঙ্গলবার তামান্নাকে পিপিএল কোর্সের অধীনে এককভাবে বিমান চালানোর অনুমতি দেয়া হয়। বুধবার তাঁর এককভাবে বিমান চালানোর কথা থাকলেও তাঁর সঙ্গে প্রশিক্ষক সাইদ কামাল ছিলেন। ২০১৬ সালে তামান্নার প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এককভাবে বিমান চালনার অনুমতি পাওয়ায় বুধবার সন্ধ্যায় বিমানবন্দর সিভিল অ্যাভিয়েশনের কার্যালয়ে তার অনুষ্ঠান ছিল। এ জন্য খাসিসহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও করা হয়েছিল। কিন্তু দুপুরের দুর্ঘটনায় তামান্নার মর্মান্তিক মৃত্যু ও তার প্রশিক্ষকের গুরুতর আহত হওয়ায় সবকিছ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।