পূর্ণতা পাচ্ছে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ সিলেটের বাগানের চায়ের কদর বিশ্বজোড়া। বৃহত্তর সিলেটের বাউল সাধকদের সুরের মূর্ছনায় আজও মশগুল হোন শ্রোতারা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান সিলেটিদের। আব্দুস সামাদ আজাদ চৌধুরি, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরি, এম সাইফুর রহমান, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, ইলিয়াস আলী, শাহ এম এস কিবরিয়া কিংবা নুরুল ইসলাম নাহিদের মত দেশসেরা রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব এই সিলেটেরই। সিলেটর সন্তান এম এ জে ওসমানী যেমন সামনে থেকে সেনাপ্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন, ঠিক তেমনি সিলেটের আরেক কৃতী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচনার কারিগর। সৈয়দ মুজতবা আলীর মত পাঠকপ্রিয় সাহিত্যিক সিলেটের সন্তান। সিলেটের ভূমি পবিত্র বলে খ্যাত হযরত শাহজালাল (রহঃ), শাহ পরান (রহঃ) ও ৩৬০ আউলিয়ার পদধূলিতে। সিলেটের খ্যাতি দেশজোড়া তাঁর অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে, পর্যটনের সম্ভাবনার কারণে। প্রবাসী সিলেটিদের রক্ত ঘাম পানি করে দেশে পাঠানো রেমিটেন্সে সবল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। সিলেট আজ গোটা বাংলাদেশে উন্নতি ও সমৃদ্ধির এক রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
এসব নিয়ে সিলেটবাসীদের গর্বের অন্ত নেই। তবে অনেক দিন থেকেই সিলেটবাসীর মনের ভেতর এক চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। দেশে বাকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের মত ক্রীড়াক্ষেত্রেও সিলেটিদের সাফল্য ঈর্ষনীয়। ফুটবলার কাওসার হামিদ, তাঁর মা দাবাড়ু রাণী হামিদ, ক্রিকেটার এনামুল জুনিয়র, রাজিন সালেহ, অলক কাপালিরা সিলেটের অবদান। বিশেষত বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক হিসেবে এনামুল জুনিয়রকে নিয়ে সিলেটিদের আবেগ থাকে উত্তুঙ্গে। দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে সদর্প উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও যখন সিলেটিরা দেখেন তাদের নিজ ভূমিতে নেই কোন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ভেন্যু, তখন তাদের আক্ষেপ প্রায়ই কানে বাজতো।
বিশেষত যেদিন প্রথম সিলেটবাসী জানতে পারে বাংলাদেশে হবে ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপ, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনের কোণে জেগে উঠেছিল একটি আশা, ইশ! সিলেটে যদি বিশ্বকাপ হত! বাস্তবতা সিলেটবাসীও ভালই জানতেন। তাই কোন ধরনের অযৌক্তিক আবদার তাঁরা কখনোই করেন নি। শুধু নিঃশব্দে দাবি জানিয়েছিলেন, যেন সিলেটেও একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ভেন্যু তৈরি হয়। তখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নের এই রুপকার ঠিকই সেই দাবির যথার্থতা অনুধাবন করেছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্তে সিলেটে একটি ক্রিকেট ভেন্যু নির্মাণের পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়।
সিদ্ধান্ত নেয়া হলো শহরের নিকটে চা বাগান ও পাহাড়ী সৌন্দর্যে ঘেরা লাক্কাতুরায় হবে নতুন স্টেডিয়াম। কাজ চলতে থাকল দ্রুত গতিতে। ২০১০ এ কাজ শেষ হল। নতুন এ স্টেডিয়াম দেখে মুগ্ধ হলেন সিলেটবাসী।এ মাঠের উইকেট, আউটফিল্ড, গ্যালারি সবই তাক লাগিয়ে দিল। এ মাঠেই চলতে লাগল বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট। ইংল্যান্ড লায়ন্স, ইংল্যান্ড অনু. ১৯, শ্রীলংকা অনু. ১৯ দল এসে খেলে গেল নবীন এ ভেন্যুতে। ক্রিকেট এসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের কোচ সিলেট স্টেডিয়াম দেখে বলেছিলেন বাংলাদেশে এত সুন্দর স্টেডিয়াম যে থাকতে পারে তা তাঁর কল্পনারও বাইরে। ২০১১ বিশ্বকাপের পর সিলেটবাসী অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন। কখন স্টেডিয়ামের কাজ পূর্ণ হবে, এবং মাঠ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে।
সিলেট স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ শেষ হলে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্টেডিয়াম হবে এটি বলে মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ হোয়াইটমোর। প্রথম পরিদর্শনে এসে স্টেডিয়ামের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন আইসিসির প্রতিনিধি দল। আর আজ সেই স্টেডিয়াম কল্পম্না নয় বাস্তব, ইতিমধ্যে টি২০ বিশ্বকাপের মাধ্যমে অভিষেক হয়েছে লাক্কাতুরায় অবস্থিত সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের। সারি সারি চা-বাগান আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মাঝে গড়ে উঠা ৬১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৮৫ ফুট প্রস্ত বিশিষ্ট সিলেট বিভাগীয় ক্রিকেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যুর স্বপ্নপূরণ হয় সিলেটবাসীর। ক্রিকেটের জমজমাট ওই আসর মাঠে গড়ানোর পর সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম‘ন্যাচারাল ক্রিকেট গ্রাউন্ড’ হিসেবে বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে স্বীকৃতি লাভ করে।
চা বাগান এলাকায় অবস্থিত স্টেডিয়ামকে সাজানো হয়েছে প্রাকৃতি ও কৃত্রিমের সমন্বয়ে। রয়েছে গ্রীন গ্যালারী। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের আমলে শুরু হওয়া কাজের পূর্ণতা পায় আরেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সহায়তায়। তার আন্তরিকতায় ‘সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় আজ পরিপূর্ণ আমাদের স্বপ্নের সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম। প্রায় ৮৭ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শেষে অভিষেক ঘটে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের। প্রকল্পের আওতায় ছিলো গ্যালারি, গ্রিন গ্যালারি, মিডিয়াবক্স, ইলেকট্রনিক্স স্কোর বোর্ড, সাইটস্ক্রিন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ফ্লাড লাইটসহ, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড নির্মাণ।
আর সিলেট বাসীর প্রতিনিধি হিসেবে সেই কাজে সরাসরি তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিসিবি পরিচালক ও সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে আর আর মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সার্বিক সহায়তায় আমরা সিলেটবাসি পেয়েছিলাম আমাদের নিজ শহরে একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু। বিশ্বকাপের পূর্বে স্টেডিয়াম পরিদর্শনে এসেছিলেন আইসিসির ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো। ছোট ছোট টিলা আর চা বাগান ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে গড়ে উঠা মাঠ দেখে মুগ্ধ ক্রো সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে শুধু আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদাই দিয়ে জান নি সেই সঙ্গে দিয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের স্বীকৃতিও। স্টেডিয়ামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ক্রো বলেছিলেন, ‘সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম ওয়ান অফ দ্য বেস্ট স্টেডিয়াম ইন সাউথ এশিয়া।’
তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দিয়ে সুনাম কুড়ানো এ স্টেডিয়ামের পাশে কোনোও প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড ছিল না। ফলে পূর্ণাঙ্গ একটি আধুনিক ও উন্নতমানের স্টেডিয়াম বলতে যা বুঝায়, তা ছিল না সিলেটবিভাগীয় স্টেডিয়াম। অবশেষে প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের স্বপ্নও পূরণ হচ্ছে সিলেটবাসীর। ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে একটি পূর্ণাঙ্গ আউটার স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ৮.৭৩ একর খাস ভূমি বরাদ্দদিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। অকৃষি ও খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা ১৯৭৫এর ১০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রতিকী মূল্য ১,০১,০০১ টাকা সালামি ধার্য্য ও আদায়পূর্বক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুকুলে এই ভূমি বন্দোবস্তপ্রদান করা হয়।
সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড নির্মাণের জন্য অকৃষি খাসজমি বরাদ্দের আবেদনের প্রেক্ষিতে সিলেট জেলার সদর উপজেলার ৭৫ নং লাক্কাতুরা টি গার্ডেন মৌজার ১নং খাস খাতিয়ানভুক্ত ৪৩, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬৩, ৬৫,৬৬ ও ৬৯ নং দাগের ৮.৭৩ একর অকৃষি খাসজমি বরাদ্দ প্রদানে সরকারি সিদ্ধান্তেরকথা উল্লেখ্য করা হয়েছে।
আউটার স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ভূমি বরাদ্দ পাওয়ায় সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য আরেকটি মাইলফলক বলেই মনে করছেন স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠকরা। তাদের মতে, সিলেটে আউটার স্টেডিয়াম নির্মিত হলে সিলেটের ক্রীড়াঙ্গন আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবং লাক্কাতুরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম বাস্তবায়নের অন্যতম কান্ডারী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আমাদের জানান, ‘আউটার স্টেডিয়াম নির্মিত হলে সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ হবে। এখানকার খেলাধূলা অনেকখানি এগিয়ে যাবে। আমাদের সিলেটের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মাঠ। আউটার স্টেডিয়াম নির্মিত হলে সেই সমস্যাও কিছুটা হলেও দূর হবে।’