ডিএনএ টেস্ট : আইনজীবী নজরুলই শিশু সামিয়ার বাবা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নাম তার সামিয়া ইসলাম। বয়স মাত্র ছয়মাস। ফুটফুটে চাঁদের মতো মুখ। হাসি তার যে কারোরই মন কেড়ে নেয়ার মতো। তাতে কি? তার বাবা থেকেও নেই। তার পিতৃস্বীকৃতির জন্য মা তাকে কোলে নিয়ে ফেরেন আদালতের দ্বারে দ্বারে।
একটি রেজিস্ট্রিবিহীন বিয়ের ফলে জন্ম হয়েছে সামিয়ার। মা তাজেদা বেগমের দাবি- অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ভুইয়া হচ্ছেন সামিয়া ইসলামের বাবা। কিন্তু পুরো বিষয়টিই অস্বীকার করেন অ্যাডভোকেট নজরুল। অথচ ভালোবেসেই তারা বিয়ে করেছিলেন একদিন। তাদের ভালোবাসার ফসলই এই নিরপরাধ সামিয়া।
শিশু সামিয়ার জন্ম-বিতর্ক নিরসনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর তার মা তাজেদা বেগম আদালতের দ্বারস্থ হন। ততদিনে তাজেদা বেগম বুঝতে পারেন সামিয়ার পৃথিবীতে আগমন সন্নিকটে। পরিবারের সম্মানহানি হওয়ায় তাজেদা বেগম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। প্রায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন গর্ভবতী তাজেদা। অনাগত সন্তানের পিতৃস্বীকৃতির জন্য শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে নামেন। এসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অ্যাডভোকেট সাবিনা ইয়াসমিন লিপি। আদালতের আইনি লড়াই থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত পরম মমতায় তাজেদাকে আগলে রাখেন লিপি।
এরই মধ্যে গত ২৩ সেপ্টেম্বর তাজেদার কোল আলো করে জন্ম নেয় সামিয়া ইসলাম। আনন্দের পরিবর্তে দুঃস্বপ্ন আরও ঘিরে ধরে মা তাজেদা বেগমকে। কীভাবে লালন-পালন করবেন মেয়েকে। কি পরিচয়ে বড় হবে তার কন্যা? এসব ভাবতে ভাবতেই অশ্রুসজল দিন কাটে তার।
এরই মধ্যে সামিয়ার পিতৃত্ব নির্ধারণের জন্য ডিএনএ টেস্টের আদেশ দেন আদালত। গত ১১ মার্চ ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি (এনএফডিপিএল) থেকে আদালতে দাখিল করা হয় প্রতিবেদন। তাতেই সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ভুঁইয়াই হলেন তাজেদা বেগমের সন্তান সামিয়া ইসলামের পিতা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির (এনএফডিপিএল) প্রধান অধ্যাপক ড. শরিফ আক্তারুজ্জামান ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিএনএ বিশ্লেষনের ফলাফল এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যথেষ্ট যে, মো. নজরুল ইসলামই বিতর্কিত সন্তান (Disputed Child) সামিয়া ইসলামের পিতা (Biological Father)। শিশু সামিয়া ইসলামের ডিএনএ’র সাথে আসামি নজরুল ইসলামের ডিএনএ’র সামঞ্জস্যতা প্রায় শতভাগ (৯৯.৯৯৯৯%)।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৯ জুন অ্যাডভোকেট তাজেদা বেগম ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আসামি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা করেন।
ওইদিন সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক এনামুল হক ভুইয়া আশুলিয়া থানার ওসিকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, গত ২০১০-১১ সালের ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম সদস্য পদে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে নিজের জন্য ভোট চাইতে গেলে অ্যাডভোকেট তাজেদা বেগমের সাথে পরিচয় হয় নজরুলের। এসময় নজরুল ইসলাম তাজেদা বেগমকে তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে অনুরোধ করলে তাজেদা রাজী হন এবং নির্বাচনী কাজ করেন। তখন থেকেই নজরুল ও তাজেদার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অতঃপর প্রেমে মগ্ন নজরুল তাজেদাকে দৈহিক মেলামেশার প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখান করেন তাজেদা। এরপর গত বছরের ১০ অক্টোবর কোর্টের কাজ শেষে সাভার নবীনগর পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ওঠেন নজরুল ও তাজেদা। সেখানে রাসেল ও সুমন নামে দুইজন সাক্ষির উপস্থিতিতে একজন মৌলভি তাদের বিয়ে সম্পন্ন করেন এবং ওই বিয়েতে কোনো ধরনের কাবিন রেজিস্ট্রি হয়নি। এরপর নজরুল বিভিন্ন স্থানে তাজেদার সাথে মেলামেশা করেন। কিন্তু তাকে নিজ বাড়িতে উঠিয়ে না নিয়ে নানাভাবে টালবাহানা করতে থাকেন।
পরে তাজেদা এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি নজরুলের বাসায় যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলে নজরুল কাবিননামা রেজিস্ট্রি করার কথা বলে তাজেদাকে সাভার নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে বিয়ে পড়ানো মৌলভিকে না পেয়ে হতাশ তাজেদা কান্নাকাটি শুরু করলে নজরুল তাজেদাকে গাজীরচট মধ্যপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে নিয়ে গিয়ে বলে যে, ‘আমাকে বিশ্বাস করো না, এই যে, মসজিদ, আল্লাহর ঘরকে বিশ্বাস করো, চল আল্লাহর ঘরকে সাক্ষি করে এখনই তোমাকে আবার বিয়ে করবো’। সেখানে ওই মসজিদের ইমাম সাহেব মওলানা আব্দুর রহিম হেলালের মাধ্যমে পুনরায় ৩ জন সাক্ষির মাধ্যমে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। তবে এবারও কৌশলে কোনো কাবিন রেজিস্ট্রি করেননি নজরুল।
তবে মেলামেশা চালিয়ে যেতে থাকেন তারা। একপর্যায়ে তাজেদা গর্ভবতী হয়ে পড়লে নজরুলকে বিষয়টি জানান। কিন্তু নজরুল তার সাথে বিয়ে ও মেলামেশার কথা অস্বীকার করে এবং গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ দিতে থাকে।
এ বিষয় জানার পর তাজেদাকে তার বাবা-মা বাসা থেকে বের করে দিলে তিনি তার খালার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন। নজরুল ওই বাসায় গিয়েও তাকে গর্ভপাত করানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। তাজেদা কাবিননামা রেজিস্ট্রি করার শর্তে গর্ভপাত করাতে রাজি হয়। গত ১ মার্চ নজরুল তাজেদাকে নিয়ে আদ-দ্বীন হাসপাতালে গেলে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পর ডাক্তার তাকে গর্ভপাত করার ঝুঁকি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিলে নজরুল তাজেদাকে মুক্তি ম্যাটার্নিটিতে নিয়ে যান। সেখানকার ডাক্তাররাও একই ঝুঁকি সম্পর্কে জানালে তাজেদা সেখান থেকে ভয়ে বেরিয়ে যান। এরপর নজরুল তাকে রাস্তায় একা রেখে চলে যান।
এরপর তাজেদা গত ১৫ মে বিষয়টি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদককে জানালে ২৯ মে উভয়পক্ষকে একটি মীমাংসা বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য দিন ধার্য করেন। কিন্তু ওই বৈঠকে তাজেদা উপস্থিত হলেও নজরুল উপস্থিত হননি। শেষতক তাজেদা অনন্যোপায় হয়ে এই মামলা দায়ের করেন।
গত বছরের ১০ আগস্ট রোববার ঢাকার কোর্ট রিপোর্টাস এসোসিয়েশনে তাজেদা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মামলার আসামি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকউটরের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উত্থাপন করেন।