বিধবা, পরিত্যক্তা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এ রাষ্ট্র ও সমাজের এগিয়ে আসা প্রয়োজন

Womens Rightsসমীক্ষা থেকে জানা যায়, মাত্র ৪৮.২৪% মুসলিম বিধবা নারী শরীয়া আইন সম্পর্কে জানেন। যেখানে স¦ামী এবং পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে বলা আছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, খুব নগণ্য সংখ্যক নারী সম্পত্তিতে তাদের অধিকার দাবি করতে পেরেছেন। কিন্তু বিধবাদের ক্ষেত্রে এখনও সম্পত্তিতে তাদের আইনগত অধিকারের দাবি উঠানো কঠিন এবং অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। বিশেষত যাদের কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দানে সক্ষম পুুরুষ নেই যে দুঃস্থ নারী তথা বিধবারা একই সঙ্গে দুঃখী এবং হতাশাগ্রস্ত। তারা আইনী সহায়তার প্রয়োজনে পরিবারের বাইরে চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না।
স¦ভাবতই এবং তারা ন্যায্য জমি ও সম্পত্তি টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে পরাজিত হয়।

বয়স কাঠামোর ক্ষেত্রে এখানে রয়েছে মিশ্রতা। কারো বয়স সবেমাত্র পঁচিশের কোটা অতিক্রম করেছে। আবার কেউবা পঞ্চাশোর্ধ্ব কিংবা তদূর্ধ্ব। বয়সের ভারে কেউ কেউ ন্যুব্জ। আক্ষরিক অর্থে যাকে আমরা পরিবার বলি, সেটি তাদের বেশির ভাগের মধ্যে নেই। সমাজের নিম্ন অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থাকা এ মানুষগুলোর প্রতিদিনকার জীবন কাটে অনিশ্চয়তার মধ্যে। তাদের মধ্যে যাদের বয়স তুলনামূলক কম, তাদের বিভিন্ন হয়রানিরও শিকার হতে হয়। একজন বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত কিংবা স¦ামী পরিত্যক্ত নারীর ভরণপোষণই যেখানে প্রধান সমস্যা, সেখানে আর ১০টি সাধারণ মেয়ের মতো স¦াভাবিক জীবনের অন্যান্য উপকরণের কথা ভাবা অবাস্তব।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী শতকরা ৪৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নারী। বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা হিসাবে প্রায় আশিজন গ্রামে বাস করে। তাদের মধ্যে আবার অর্ধেকজনই হচ্ছে নারী। গ্রামের অধিকাংশ নারীরা আজো অবহেলিত।
বিধবা, পরিত্যক্তা ও তালাকপ্রাপ্তা তাদের প্রতি বঞ্চনা হয় আরও বেশি। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় তো বটেই অন্য নারীদের থেকেও তারা পিছিয়ে, পারিবারিক কাঠামোতেও তারা অবহেলিত। সমাজে মানুষ হিসেবে যতটুকু মর্যাদা থাকার কথা তা তাদের নেই। স¦ামী না থাকার কারণে সন্তানের পিতৃপরিচয় দেয়া, সন্তানদের বিয়ে দেয়ার সময় পিতার পরিচয় ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজে অনেক সময়ই বলা হয়- যার মা স¦ামীর ভাত খেতে পারেনি, তার মেয়েও স¦ামীর সংসার করতে পারে না। এটা মূলত সামাজিক কুসংস্কার। তালাকপ্রাপ্ত নারীদের অনেকেই আবার খারাপ মেয়ে বলে আখ্যা দেয়। তাই বিচ্ছিন্ন ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের ক্ষেত্রে খুবই প্রকট। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র নারীদের জন্য এই সমস্যার তীব্রতা আরও বেশি। সমাজে নারীদের উপার্জনক্ষম হওয়ার সুযোগ খুব সীমিত। দরিদ্র নারীদের এই সমাজ বাস্তবতার মধ্যে থেকেই উপার্জনের চিন্তা করতে হয়, সংসার চালানোর সব দায়িত্ব নিতে হয়। নিম্ন মজুরির কাজের সামান্য কিছু সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক কাজ যেমন তারা পান না, অবার যে কাজগুলো জানেন বা যে কাজে দক্ষ সে অনুসারে অর্থ উপার্জনমূলক কাজের সুযোগও সমাজে নেই। অন্যদিকে নিজেদের এমন কোন সম্পদ নেই; যেগুলো কাজে লাগিয়ে তারা ভালভাবে উপার্জন করতে পারেন। নিজেদের থাকার মতো জায়গা জমি নেই অনেকের। অধিকাংশ নারীই বাবার বাড়িতে থাকেন। সেখানে তাদের মর্যাদা নেই এবং পিতার সম্পত্তিতে তাদের অধিকার থাকলেও তাদের সে অধিকার তারা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা, স¦ামী পরিত্যাক্তা নারীরা বিশেষভাবে পিতার সম্পত্তির ন্যায্য উত্তরাধিকার কোন নারী পান না। বোন জানেন যে, ভাই নামমাত্র সম্পত্তি তাকে দিচ্ছে। কিন্তু ভাইবোনের আন্তরিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে পারে মনে করে কোন প্রতিবাদ করতে পারে না, কোন বিপদে পড়লে ভাই তাকে আশ্রয় দেবে। এই আশার স¦াভাবিক সম্পর্কে বোনটি রক্ষা করতে চায়।
বিধবা, স¦ামী পরিত্যক্তা, স¦ামীর বহুবিবাহের কারণে ভরণপোষণের সমস্যা, দীর্ঘদিন পৃথক বসবাস, তালাকপ্রাপ্ত ও স¦ামী থাকা সত্ত্বেও কোনো না কোনো কারণে ভরণপোষণ করতে না পারা নারীর সংখ্যা লাখ থেকে কোটি হলেও তাদের সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে অদ্যাবধি তৈরি হয়নি।
একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে ধরনের মর্যাদা প্রয়োজন তাও তাদের বিধবা, পরিত্যক্তা বা তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার মধ্য দিয়ে হারাতে হয় এবং রাষ্ট্রীয় কোন প্রচেষ্টা তাদের জন্য পরিলক্ষিত হয় না। পরিবার এবং সমাজে তাদের প্রতি যে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি সে কারণে তারা নিজেরাও নিজেদের গুরুত্বহীন বলে মনে করেন, ভাগ্যকে দায়ী করেন। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় তাদের অবস্থা চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হচ্ছে না। ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের নিয়ে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়ে আছে। যার কারণে তারা আরও বেশি অসম অবস্থানে রয়ে যাচ্ছে। এই দুস্থ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আর্থিক, সামাজিক এবং মানসিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো প্রয়োজন। রাষ্ট্র ও সমাজের এক্ষেত্রে যুগপৎভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।