দ্বন্ধ-অবিশ্বাসের দোলাচলে সিলেট বিএনপি : তৃণমূলের কাঠগড়ায় নেতৃবৃন্দ

BNP-Leader-MA-Hoque-Newsহাবিবুর রহমান তাফাদারঃ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘসূত্রতা চাপ বাড়াচ্ছে দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ওপর। সময়ের পরিক্রমায় এই আন্দোলন যখন ত্তুঙ্গে থাকার কথা, তখন সিলেট বিএনপিতে বইছে উল্টো হাওয়া। নেতাদের নির্দেশনাহীন এই আন্দোলন ঝটিকা মিছিলের মধ্যেই বন্দী। নেতাদের যেখানে অগ্রভাগেই থাকার কথা, সেখানে সিলেট বিএনপির শীর্ষ বেশিরভাগ নেতাই চলছেন নিজেদের গা বাঁচিয়ে। এছাড়া সিলেট বিএনপির নেতৃবৃন্দের নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধ-অবিশ্বাসের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরও কার্যকর কোনো ফল না আসায় তাদের অভিযোগের তীর এখন দলটির নেতৃবৃন্দের দিকে। তাদের অভিযোগ, দলীয় নেতারা নিজেদের ‘ব্যবসা আর সম্পদ বাঁচাতেই’ মাঠে নামছে না। আর তারা না নামায় কর্মীরা মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছেন না।
হরতাল-অবরোধের মধ্যে বিএনপি নেতাদের অনেকেই নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখছেন। যে কারণে ‘সরকারের সাথে আঁতাত’ করেছেন, এমন কানাঘুষাও শোনা যাচ্ছে সিলেট বিএনপিতে। শীর্ষ নেতাদের নি®িকৃয়তা, গা বাঁচিয়ে চলার নীতি আর সন্দেহ-অবিশ্বাসের দোলায় দিকনির্দেশনাহীন তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ।
২০ দলীয় জোটের লাগাতার হরতাল চলাকালে মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি এমএ হকের মালিকানাধীন সোবহানীঘাটস্থ ‘মেসার্স বেঙ্গল গ্যাসুলিন এন্ড সার্ভিসিং’ পাম্পও খোলা রেখে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছেন বানিজ্যিক কার্যক্রম।
সিলেট জেলা বিএনপির ১০ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি ও মহানগর বিএনপির ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি রয়েছে। এদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন মহানগর বিএনপির আহবায়ক ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, সদস্য সচিব বদরুজ্জামান সেলিম, সদস্য শমসের মুবিন চৌধুরী, আরিফুল হক চৌধুরী, হাবিবুর রহমান হাবিব, ও মাহবুব চৌধুরী। এমদাদ চৌধুরী গ্রেফতার হলেও ওই দিনই সন্ধ্যায় আওয়ামীলীগের এক প্রভাবশালী নেতার সহায়তায় ছাড়া পেয়ে রাতেই লন্ডন পাড়ি জমান। ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরকারের সাথে আতাত করে কারাগারে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কারাগারে থাকাবস্থায় জামিন প্রার্থনা না করায় এর আগে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর তার আইনজীবি জামিন আবেদন করলে তিনি জামিন পান। তবে কারা ফটক থেকে ফের কারাগারে যাওয়ার ব্যাবস্থা তিনি আগে থেকে করে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতাকর্মীদের।
এঁরা ছাড়া নেতাদের মধ্যে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্য আবদুর রাজ্জাক, আলী আহমদ, সামসুজ্জামান জামান, এমএ মান্নান, মহানগর বিএনপির সদস্য আজমল বখত সাদেক, মিফতাহ সিদ্দিকী, ডা. নাজমুল ইসলাম, আবদুল জব্বার তুতু প্রমুখ ও সৈয়দ রেজাউল করিম আলো।
বাকি ২৭ নেতাদের কাউকেই হরতাল-অবরোধে রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। নিষ্ক্রিয় নেতাদের মধ্যে রয়েছেন এডভোকেট নূরুল হক, এমএ হক, দিলদার হোসেন সেলিম, অ্যাডভোকেট আবদুল গফ্ফার, আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, তাহসিনা রুশদী লুনা, নাসিম হোসাইন, অধ্যাপক মকসুদ আলী, আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকি, এডভোকেট নোমান মাহমুদ, ফয়জুর রহমান জাহেদ, রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, একেএম আহাদুস সামাদ, হুমায়ুন কবির শাহীন, হাদিয়া চৌধুরী মুন্নী, ফরহাদ চৌধুরী শামীম, ওমর আশরাফ ইমন, সৈয়দ মিসবাহ উদ্দিন, সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, সৈয়দ মঈনুদ্দিন সুহেল, আলা উদ্দিন, মুফতি নেহাল, বদরুন নূর সায়েক, আবদুস সাত্তার, মুর্শেদ আলম মুকুল । বাকীরা রয়েছেন ফটো সেশন আর চোরাগপ্তা মিলাদ মাহফিল নিয়ে। বিএনপি’র অনেক অচেনা মুখ এখন চোরাগুপ্তা মিলাদ মাহফিল করে ফটো সেশনে নিজেদের নেতৃত্ব জাহির করতে ব্যাস্ত। অভিযোগ আছে, প্রসাশনের সাথে আতাত করে পাড়া মহল্লায় চোরা গুপ্তা মিলাদ/দোয়া মাহফিল করে ফটো সেশনের মাধ্যমে পত্রিকায় বিশাল মিলাদ মাহফিল বলে বিবৃতি দেয়াই তাদের মূল কাজ। যদিও এসব ছবিতে দেখা যায় বাস্তবে তিন অথবা চারজনের চেহারা; ততাপি বিবৃতিতে লেখা হয় বিশাল মিলাদ মাহফিল, নাম থাকে শতাধিক নেতাকর্মীর। জানা যায়, মিছিল প্রাক্কালে বিএনপি নেতৃবৃন্দকে ফোন করে জড়ো করালে নিজেদের অসুস্ততার কথা বলে সটকে পড়েন। পরে আবার ফোন করে বলেন ‘‘ ভাই, প্রেস রিলিজে আমার নামটা দিয়েন”।
এদিকে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় নেতাদের অনেকেই হরতাল-অবরোধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফিলিং স্টেশন, পেট্রোল পাম্প খোলা রাখতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ যোগাচ্ছেন এরকম সন্দেহ-অবিশ্বাস খোদ দলটির অভ্যন্তরেই বিরাজমান। এমনকি জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক আবদুল গফ্ফারের কারণেই আইনজীবীরা আদালতের কার্যক্রম চালাচ্ছেন, এমন অভিযোগ খোদ দলটির নেতাদের। নেতাদের এই নিষ্ক্রিয়তা, আন্দোলন থেকে গা বাঁচিয়ে চলা আর দিকনির্দেশনা না পেয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা ফুঁসছেন ক্ষোভে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠলে দলীয় শাস্তির খড়গে পড়তে হবে, এই শংকায় কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না। মহানগর বিএনপি’র কার্যনির্বাহী সদস্য আব্দুর রহিম’র নেতৃত্বে সিলেটে চলছে টাউনবাস। এছাড়া তিনি সিলেট ও সুনামগঞ্জে বাস মালিক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে তার বাসগুলো চলছে অবাধে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সিলেট জেলা ছাত্রদলের এক কর্মী বলেন, মামলা-হামলা-গ্রেফতার প্রতিনিয়তই মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। সিলেট ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটিকে আজ পর্যন্ত স্বাগত জানায়নি সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি। এনিয়ে বিএনপি-ছাত্রদলের মধ্যে দুরত্ব ও অন্তর্কলহ চলছে। সরকারবিধোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা অবরোধের প্রথম থেকেই সিলেট ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটি ও বিদ্রোহী ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ নিজ উদ্যোগে চালিয়ে যাচ্ছেন অবরোধ কর্মসূচী। প্রতিদিনই নগরীর কোননা কোন এলাকায় মিছিল মিটিং করছে ছাত্রদল। মামলা হামলার ভয়ে নেতৃস্থানীয়রা আত্মগোপনে থেকেও নিজ অনুসারী কর্মীদের দিয়ে মিছিল করাচ্ছেন। জিইয়ে রেখেছেন আন্দোলন কর্মসূচী। তাদের মতে বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি’র এমন সংকটময় মূহূর্থে সিলেট বিএনপি নেতৃবৃন্দ কোন ভূমিকা না রেখে পালটা সরকারের সাথে আতাত করে হরতালেও নিজ ব্যাবসা বানিজ্যে নিজে উপস্থিত থেকে কেন্দ্র ঘোষিট কর্মসূচীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। তারা মনে করেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ তৃণমূল কর্মী ও ছাত্রদল নেতৃবৃন্দের সাথে সমন্বয় করে আন্দোলন করলে রাজপথে আন্দোলন আরও তিব্রতর হতে বাধ্য ছিল।
যদিও তারা প্রত্যাশা করছেন, ঢাকায় আন্দোলন না হলেও সারা দেশ থেকে ‘রাজধানী বিচ্ছিন্ন থাকায়’ দ্রুতই সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে। এছাড়া ঢাকায় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের পথ আরো সহজ হতো বলে মনে করেন তারা। প্রায় দুই মাস ধরে সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন থাকলেও সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার কারণেই সরকার কোনো আলোচনায় বসতে চাইছে না। তবে ‘শত নির্যাতন’ সহ্য করেও তৃণমূল বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায় বলে জানান তারা।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, অনির্দিষ্টকালের অবরোধে বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্ব এখন অনেকটাই পরিশ্রান্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মামলা আর গ্রেফতার আতঙ্ক। এক বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় লাগাতার আন্দোলন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এ কারণে তাদের দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির ডাকা আন্দোলনে আগে থেকেই অসংখ্য মামলায় জর্জরিত তারা।
এর পরও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে তারা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন। তবে ঢাকার নেতাদের ভূমিকায় অখুশি তারা। কেন্দ্রীয় এসব নেতা কী করছেন, সেই প্রশ্ন তাদের। ঢাকা মহানগরের কর্মকা-ে আগের মতোই হতাশ তৃণমূল বিএনপি। রাজধানীর ব্যর্থতার কারণেই আন্দোলনের সুফল আসছে না বলে মন্তব্য আসছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি দিন (৫ জানুয়ারি) অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করেছেন এই সব নেতা-কর্মী। কিন্তু ঢাকায় কোনো আন্দোলন জমাতে পারেনি মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর বিএনপি। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না নেতা-কর্মীরা।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিম জানান, এই বৃদ্ধ বয়সেও আমি বিএনপি’র সব মিছিলেই অংশ নিই। বিএনপি’র সবকটি বিবৃতিই আমার মাধ্যমে যায়। যারা আন্দোলনে সক্রিয় নন তারাই আসলে এসব অভিযোগ উত্তাপন করছেন। ছাত্রদলের কমিটির ব্যাপারে তিনি জানান তাদের কোন কার্যক্রম থাকলেতো তাদের অভিনন্দন জানানো হত। তবে সকল ধরনের অভিমান ভূলে এই সময় বিএনপি ও জোট নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানান তিনি।
সিলেট মহানগর বিএনপি’র সাবেক সভাপতি এমএ হক বলেন আমি সিলেট জেলা বা মহানহর বিএনপি’র কোন দায়ীত্বে নেই। আমি বিএনপি’র একজন সমর্থক মাত্র। যারা দলের পদ পদবি নিয়ে আছেন এসব প্রশ্ন তাদের কাছে করলে যথাযত তথ্য পাবেন।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য, সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আজমল বকত সাদেক বলেন, গুপ্ত হত্যা, জেল, জুলুম-নির্যাতন ও পুলিশি হয়রনি স্বত্তেও সিলেট বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনে যথেষ্ট সক্রিয় আছেন। অচিরেরেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিকামী জনতার আন্দোলনের নিশ্চিত বিজয় আসবেই।