বাংলাদেশে অন্ধকার ছাড়া আমি আর কিছু দেখি না : নিউইয়র্কে কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক
নিউইয়র্ক থেকে এনা: আমেরিকা প্রকাসী মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায়ের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর আমি ভীষণভাবে মুছড়ে পড়েছি, ভয় পেয়েছি। যারা অভিজিতকে হত্যা করেছে, তারা এটাই চায়। আমরা কলম বন্ধ করে দিই, মুখে কুলপ লেগে দিই। আমাদের কারোর কোন অধিকার নেই আরেকজনের প্রাণ কেড়ে নেয়ার। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পিএস ৬৯ এর অডিটোরিয়ামে নিউইয়র্কের মুক্তধারা আয়োজিত দুই দিনের গন্থমেলার প্রধান অতিথি কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক এ কথা বলেন। যদিও গ্রন্থ মেলাটি অভিজিতের হত্যাকান্ডে প্রতিবাদ সমাবেশে রূপ নেয়। সেমন্তী ওয়াহেদের পরিচালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে মোমেন, ফেরদৌস সাজেদীন, সউদ চৌধুরী, হাসান ফেরদৌস, জন্মভূমির সম্পাদক রতন তালুকদার, নিনি ওয়াহিদ, আহমেদ মুসা, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্যাহ, আকবর হায়দার কিরণ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনিসুল হক আরো বলেন, নিউইয়র্কে আমার দ্বিতীয় রাজধানী মনে হয়। আমি অনেক বার এসেছি। যখন আমি শুনলাম যে নিউইয়র্কে মুক্তধারার আয়োজনে বই মেলা হবে, সেই সময় বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থ মেলার শেষ দিনটায় অনুপস্থিত থাকার মূল্য দিয়েই আমি নিউইয়র্কের বই মেলায় সানন্দে আসতে রাজি হয়েছি। আপনারা জানেন যে আজকের এই অনুষ্ঠানটা কেমন একটা দু:খ, শোক এবং প্রতিবাদের মধ্যদিয়ে আমাদের পালন করতে হচ্ছে। সত্যি করে যদি বলি, সততার সঙ্গে যদি বলতে হয়- আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বই মেলায় না গিয়ে আমি বিমান বন্দরে চলে গেলাম তাতে আমি নিজেই বেঁচে গেছি। বাংলাদেশে বই মেলাটা বাড়ানোর কথা হচ্ছিলো। বাংলা একাডেমি চায় না, প্রধানমন্ত্রী রাজি হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী রাজি, সাংস্কৃতিক মন্ত্রীও রাজি। সুতরাং বই মেলার সময় বাড়ছে। এইটুকু আমি জানতাম। আমি যখন ফোনে প্রকাশকদের সাথে কথা বলছি, তখনই মুক্তমনার প্রবক্তক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এবং নাগরিকত্ব পাওয়া অভিজিত রায় এবং তার স্ত্রীকে আঁততায়ী নির্মমভাবে আঘাত করে। একজন মানুষ কেন আরেকজন মানুষকে আঘাত করবে এটা আমি ভেবেই পাই না। তিনি উধাহরণ টেনে বলেন, আলেকজান্ডার গিয়েছিলেন একজন দার্শনিকের কাছে। দার্শনিক তখন বাথটবে গোসল করছিলেন বাড়ির প্রাঙ্গণে। আলেকজান্ডার গিয়ে বললেন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি? সেই দার্শনিক বলেছিলেন দয়া করে আপনি সরে দাঁড়ান, আপনি আমার রোধ আকড়ে রেখেছেন। ছায়া দিচ্ছেন। যা আপনি আমাকে দিতে পারেন না, তা আপনি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেন না। আমি সব সময় মনে করি, আমাদের কারোর কোন অধিকার নেই আরেকজনের প্রাণ হরণ করার। কারণ প্রাণ আমরা দিতে পারি না। এই বই মেলার একই জায়গায় ১০ বছর আগে হুমায়ুন আজাদকে মারা হলো। একইভাবে শামসুর রাহমানের বাসায় গিয়ে তাকে চুরিকাঘাত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। একজন লেখক এভাবে মারা যাবেন, এটা খুবই বেদনাদায়। আমি মুছড়ে পড়েছি, ভয় পেয়েছি, সেটাই সবচাইতে বড় ক্ষতি। এটাই তারা চায় হত্যাকারীরা- আমরা সবাই যেন ভয় পেয়ে যাই। আমরা যেন আমাদের কলমগুলোর সামনের খাপটা এঁটে দিই, মুখের মধ্যে কুলপ পরিয়ে দিই। ভয়ের শাসন যেন কায়েম হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা সবাই একটা ভয়বহ সময়ের মধ্যে পৌঁছালাম। অন্ধকারের বিরুদ্ধে তরবারি দিয়ে লড়াই করা যায় না, আমার যে বন্ধুরা তরবারি দিয়ে লড়াই করার কথা ভাবছেন/ বলছেন, তাদের রাগ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, তারুণ্যটা আমি বুঝি। আমি মনে করি এক মাত্র উপায় হচ্ছে- আলো জ্বালানো। বই পড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় আমি দেখি না। আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশের ৯৮% ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, এদের হাতে পাঠ্য বই ছাড়াও বাইরের বইগুলো তুলে দিতে হবে। একবার যদি আলোর সন্ধান পায়, এদের প্রত্যেকের মধ্যে মোম আছে, স্বলতে আছে আগুন জ্বলে যেতে পারে। আলোর নিয়ম হচ্ছে, আলোতো পরশ মনি। এটা আরো অনেকজনকে আলোকিত করতে পারে। কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও যখন অশিক্ষার অন্ধকার দেখি, প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্যগুলো যখন দেখি তখন আবার মুছড়ে পড়ি। আলো এবং অন্ধকারের সংর্ঘাত চিরকালের। এটা থাকবেই। কিন্তু আমাদের চেষ্টা হবে যতখানি পারি আমাদের তরুণ প্রাণগুলোকে আলোকিত করা। সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, তরুণরা একটি ধুব্বা ঘাসের ডগার মধ্যে শিশির দেখে যেন আনন্দিত হয়, পানির মধ্যে পিপড়া পড়লে যেন সেটাকে হাত দিয়ে তুলে বা একটা পাতা দেয়- সেই রকম করে আমরা যদি আমাদের বাচ্চাদের গড়তে পারি তাহলে আজ থেকে ২০ বছর পরে বা ৩০ বছর পরে হয়ত বাংলাদেশটা ভাল হবে। এ ছাড়া আমি বাংলাদেশে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখি না।