আল্লাহ আমাকে শাহজালালের মাটিতে বাঁচিয়েছেন ॥ মরতে মরতেই আমি বেঁচে গেছি
দক্ষিণ সুরমায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ ট্রাকচালক মিলন
নুরুল হক শিপুঃ জাফলং থেকে পাথর নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার পাড়ি দিয়ে যখন সাতমাইল এলাকায় যাই; তখনই চোখে পড়ে রাস্তার ডান পাশে দাড়িয়ে আছেন ৩ জন যুবক। মুহুর্তেই একজন হাতে থাকা পেট্রলবোমার মুখে আগুন ধরালেন। আরেকজন টান দিয়ে পেট্রলবোমাটি হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলেন আমার ট্রাকে। সাথে সাথে ট্রাকে দাউদাউ করে আগুর লেগে যায়। ওই সময়ই আমার বাম হাতেও আগুন লাগে। তখনই ‘আমি ভেবে ছিলাম এই বুঝি আমি শেষ।’ কারণ আমাদের নওগা জেলায় অনেক ট্রাক চালকের ওপর পেট্রলবোমা মারা হয়েছে। কেউ মরে গেছেন। কারও কারও মুখ পুড়ে গেছে। কেউ আন্ধ হয়ে গেছেন। আল্লাহ আমাকে শাহজালালের মাটিতে বাঁচিয়েছেন। মরতে মরতেই আমি বেঁচে গেছি। আমার পুরো বাম হাতটি পুড়ে গেছে। যন্ত্রনা হচ্ছে খুব বেশি। তার চেয়ে বেশি চিন্তিত আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে। আমি ছাড়া যে ভাত জোটেনা আমার পরিবারে। বুধবার রাত পৌনে ১০টায় লালাবাজার সাতমাইল নামক স্থানে পেট্রলবোমায় দগ্ধ চালক মো. মিলন হোসেনের কথা এগুলো। নওগা জেলার আতড়াই থানার বান্দাইখাড়া গ্রামের আহাদ আলীর ছেলে মিলনের ঠিকানা এখন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। গতকাল বৃহস্পতিবার ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে শুনা যায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ ট্রাক চালক মিলনের আর্তনাদ। তরতাজা টগবগে ২৫ বছরের যুবক মিলনের পুরো বাম হাতই জ্বলসে গেছে পেট্রলবোমার আঘাতে। তিনি যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। দগ্ধ মিলনের হাত, কিন্তু তার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরিই হয়ে গেছেন বিদগ্ধ। অঝোরে কাঁদছেন মিলন। আর বলছেন পরিবারের কথা। কিভাবে চলবে আমার পরিবার?
মিলন বলেন, বৃদ্ধা মা মোছা. মনুয়ারা বেগম, বাবা আহাদ আলী, ছোট একটি ভাই ইলন, মিলনের স্ত্রী এবং আড়াই বছরের মেয়ে জান্নাতুলকে নিয়ে ছোট্ট সাজানো সংসার তার। আর সংসারও চলে তারই উপর্জনে। ট্রাকের চাকা ঘুরলে ঘরের চুলোয় আগুন জ্বলে।
মিলন বলেন, জানিনা কত দিন হাসপাতালের বিছানায় পুড়া হাত নিয়ে থাকতে হবে। আর সুস্থ হতে কত দিন লাগবে তাও জানা নেই। এ অবস্থায় কি করে চলবে আমার সংসার? বাবা-মা’র ওষুধ আর মে জন্নিাতের দুধের টাকা যে ট্রাক চললে আসে। কিভাবে যাবে এই কয়টি দিন তাদের? মিলনে বলেন, দেশে এ কেমন আন্দোলন চলছে? যে পেট্রলবোমা মেরে মেরে ট্রাক চালকদের মারতে হবে? ট্রাক চালকরা কি মানুষ নয়? ট্রাক চালকদের কি পরিবার নেই?
কাঁদতে কাঁদতে মিলন আরো বলেন, যখন আমার হাতে আগুন লেগে যায়; তখন আমি লাফ দিয়ে ট্রাক থেকে নেমে যাই। আল্লাহ জানেন কিভাবে আগুন নিভে গেছে। একজন লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। গাড়িতে থাকা নগদ ৪০ হাজার টাকা, মিলনের মোবাইল ফোন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ড্রাইভিং সমিতির কাগজ, ট্রাক শমিক ইউনিয়নের কার্ড ও সম্পূর্ণ ট্রাক পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, নওগা সদরের কবির উদ্দিন ট্রাকের মালিক। গতকালই তিনি তাকে হাসপাতালে দেখে আসেন।
এদিকে ছেলে সিলেটে দগ্ধ হয়েছেন যেনে তার কাছে ছুটে আসতে ছটফট করছেন মিলনের বৃদ্ধা মা-বাবা। কিন্তু তারা যে সিলেটে আসবেন সে টাকাও তাদের কাছে নেই।
গতকাল ওসমানী হাসপাতালের দায়িত্বরত এক নার্স মিলনকে বলেন, আমরাতো আপনাকে সব ধরণের সেবা দিচ্ছি। তারপরও এই মুহুর্তে আপনার পরিবারের একজন লোক আপনার পাশে থাকলে ভাল হত।
নওগা জেলায় মোবাইল ফোনে কথা হয় মিলনের বাবা আহাদ আলীর সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, মিলনের মা মিলনকে দেখতে ছটফট করছেন। আমি নিজেও যেতে চাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কাছে গাড়ি ভাড়ার টাকা নেই। সারা দিন ঘুরে মানুষের কাছ থেকে ৭ টাকা দার করেছি। কাল ওর মাকে সিলেটে ওই টাকা দিয়েই ছেলের কাছে পাটাবেন বলে জানান তিনি।
হাসপাতালে অবস্থান করা ব্যবসায়ী রবিন জানান, তিনি বুধবার রাতে বালাগঞ্জ থেকে একটি সিএনজি আটোরিকশাযোগে সিলেট আসছিলেন। সাতমাইল নামকস্থানে আসার পর দেখতে পান একটি ট্রাক পুড়ছে। একজন লোক একটু সামনে পড়ে আছে। তিনি সাথে সাথে ওই আহত ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন ওসমানী হাসপাতালে। পড়ে যানতে পাড়েন ওই লোকটিই ট্রাক চালক মিলন।
দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল এই প্রতিবেদককে জানান, ট্রাক পুড়ানো ও চালক আহতের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার থানায় ২৫ থেকে ৩০ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।