চাই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চির অবসান
॥ জিয়া খালেদ ॥
গত ৪ঠা জানুয়ারী সুযোগ পেয়ে বেড়ানোর জন্য সড়ক পথে ঢাকা রওয়ানা দেই। বিকেল ৫ টায় সিলেট হুমায়ুন চত্বর থেকে রওয়ানা দিয়ে রাত ১০ টায় ধানমন্ডি পৌঁছি। রাস্তা ছিল একেবারে ফাঁকা। কারণ পরদিন ৫ জানুয়ারী পল্টনে বিএনপির সমাবেশ। যানচলাচল প্রায় বন্ধ। ঢাকায় ঢুকতে বাঁধার/তল্লাশীর সম্মুখীন প্রতিটি যানবাহন। ফাঁকা রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ীতে এক অজানা আতংকে ছিলাম আমরা। কখন কি হয় এই ভয়ে। যাক শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে নিরাপদে পৌঁছে গেলাম। পরদিন ৫ জানুয়ারী। সরকারী দল দিনটিকে গণতন্ত্র দিবস এবং বিএনপি দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে উদযাপন করছে। শেষ পর্যন্ত ৫ জানুয়ারী বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ায় ৫ জানুয়ারী থেকে বিএনপি নেত্রী অবরোধের ডাক দেন। অনির্দিষ্টকালের লাগাতার অবরোধ ও বিচ্ছিন্ন হরতালে দিশেহারা মানুষ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতংক আর টান টান উত্তেজনা সর্বত্র। অবরোধে বিড়ম্বনার শিকার প্রায় সকলেই সাধারণ নিরীহ মানুষ। রেল স্টেশন এবং বাস টার্মিনালে যাত্রীদের উপচে পড়া ভীড়। এদিকে দিন দিন সহিংস হয়ে উঠছে অবরোধ। পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায় ১১ দিন কাটিয়ে দিলাম ঢাকায়। মাঝখানে চেষ্টা করেছি সিলেট ফেরার কিন্তু সাহস ও সুযোগ কোনটাই হয়নি। ট্রেনের মারাত্মক সিডিউল বিপর্যয়। তারপরও তুলনামূলকভাবে ট্রেন যাত্রা নিরাপদ মনে করে ১৮ জানুয়ারী সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছি সকাল ৮ টায়। কোন ট্রেন নেই, টিকেটও দিচ্ছে না। বেলা ১১ টায় ঘোষণা এলো জয়ন্তিকা দুপুর ১২ টায় ছাড়বে সিলেটের উদ্দেশ্যে। টিকেটও সংগ্রহ করলাম। বিকেল ৪ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করি ট্রেনের কোন খবর নাই। শেষ পর্যন্ত বিকেল ৫ টায় ট্রেন আসলো এবং সাড়ে ৫ টায় কমলাপুর ছাড়লো। ট্রেনটি পরদিন ৯ টায় সিলেট পৌঁছিল। ৫/৬ ঘন্টার জার্ণি ১৬ ঘন্টায়। আমি একা ছিলাম, আমার তেমন কোন কষ্ট না হলেও মহিলা এবং শিশু যাত্রীরা ছিল চরম কষ্টের মধ্যে। তাছাড়া এক্সটা একটা বগির টিকেট ইস্যু করা হলেও বগি দেয়া হয়নি তাই এ বগির যাত্রী অন্য বগিতে সিট না পেয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ে। একজন মহিলা যাত্রী টিকেট কাউন্ডারে গিয়ে এক্সটা বগি দেয়া হয়নি বললেও সেখান থেকে বলা হয় বগি দেয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বগি দেয়া হয়নি। প্লাটফরমে ইউনিফর্ম পরা দায়িত্বশীল কাউকে ট্রেন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, মাইকে ঘোষণা আসবে-অপেক্ষা করুন। ইউনিফর্ম পরা দায়িত্বশীলদের মানবতার ঘাটতি থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও মানবতা হারিয়ে যায়নি। মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ এখনও সমাজে আছে। অনেক যাত্রীই নিজের আসন ছেড়ে মহিলা ও শিশুদের জায়গা করে দিয়েছেন দেখে খুবই ভালো লাগলো। নিজেও যতটুকু সম্ভব তাদের সাহায্য করলাম। সারা রাত কাটলো অত্যন্ত ভীতির মাঝে। ট্রেনের লাইন কেউ উপড়ে ফেলে কি-না এই ভয়ে।
অবরোধের ১৩তম দিনে ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় প্রাইভেট কার, ট্রাক ও বাসে আগুন দেয়া হয়েছে, রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, দগ্ধ ও হতাহত হয়েছে অনেক মানুষ। তাছাড়া ট্রেনে দেখলাম অনেকের কাছে ভাড়া এমনকি নাস্তার পয়সাও নেই। ট্রেনে ইউনিফর্মধারী হেলপাররা(?) যাত্রীদের কাছ থেকে বাসের হেলপারের মতো ভাড়া সংগ্রহ করছেন তাদের মতো করে। ট্রেন থেকে নামার পর রিকশা, অটোরিকশা সবাই ভাড়া হাকছে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হরতাল-অবরোধের দোহাই দিয়ে। এমনিতেই সিলেটে গাড়ী রিকশা ভাড়া বেশী।
পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার অপার রহমতে ভরপুর আমাদের এ দেশ। এদেশের মানুষগুলোও আত্মশক্তিতে বলিয়ান। কৃষি প্রধান এ দেশটি উন্নত দেশগুলোর মতো সুখী ও সমৃদ্ধিশালী হতে রাজনৈতিক বাধা ছাড়া অন্য কোন বাধা নেই। ১৯৭০ সালে ৭ কোটি মানুষের জন্য যে জমিতে খাদ্য শস্য উৎপাদন হতো এক কোটি মেট্রিক টন, এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে আবাসস্থল নির্মাণে প্রতি বছর আবাদী জমি অনেক অনেক কমে গেলেও বর্তমানে দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য শস্য উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি মেট্রিক টনেরও অধিক। এক সময়কার খাদ্য ঘাটতি এ বাংলাদেশ থেকে এখন চাল রপ্তানী হচ্ছে। বিদেশ নির্ভরশীলতা আমাদের এখন অনেক কমে গেছে। শুধু চাল নয়, জাহাজ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এখন বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হচ্ছে। পোষাক শিল্পে এখন বাংলাদেশ ২য় শীর্ষ অবস্থানে, যদিও এখন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিভিন্ন ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হওয়া বিষয়টি ছেড়েই দিলাম। সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে নবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘সামাজিক খাত ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ভারত যা পারেনি বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে’।
হ্যাঁ। পারার এ শক্তি সুযোগ সম্ভাবনা বাংলাদেশে আগেও ছিল এখনও আছে। এসব পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার দয়ার দান। একমাত্র রাজনীতির অস্থিরতার কারণেই আমরা স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও পিছিয়ে আছি। এ লেখা যখন লিখছি (২৬ জানুয়ারী ২০১৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে বার্ন ইউনিটে রাজনৈতিক সহিংসতার আগুনে পোড়ে যাওয়া নিরীহ মানুষের উপচে পড়া ভীড়। বারান্দায় রোগী। করিডোরে রোগী। এক বেডে দুই রোগী। বেডের সংখ্যা ৩শ, রোগীর সংখ্যা ৫শ’। সহিংসতা দগ্ধদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের এ অবস্থা। বাংলাদেশে গদি রক্ষা ও গদি পাবার চরম নিষ্ঠুরতার শিকার আজ সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক মতবিরোধে সৃষ্ট সহিংসতায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন। বার্ন ইউনিটে কর্তব্যরত সাংবাদিকরা লিখছে-‘বার্ন ইউনিটে দগ্ধ মানুষের আর্তনাদ-আমরা আর লিখতে পারছি না।’ মানুষের জ্বলসানো মুখ, আড়াই বছরের দগ্ধ শিশু সাফিরের বুক ফাটা কান্না, রিকশা চালক অমূল্য চন্দ্র বর্মণের অসহায় স্বজনদের আর্তনাদ, কাস করতে যাওয়া ইডেন কলেজের ছাত্রী বিথি ও সাথীর আতংক, দরিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের একমাত্র অবলম্বন বাসের হেলপার শিশু মাসুম, মুহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ও ফাইনাল পরীক্ষার্থী রাজীব কর্মকার, কাজে যামু কেমনে? প্রশ্ন কারিনী যার জ্বলসানো মুখ দেখে তার শিশু সন্তান তাকে চিনতে না পেরে চিৎকার দিয়ে কাঁদে সেই নূরজাহান বেগম, রংপুরের মিঠাপুর থেকে পরিবারের ১১ জন সদস্য সহ ঢাকায় আসার পথে শিশু কন্যা ফারজানাসহ দগ্ধ মিনারা বেগম। তার সাথী ১১ জনের মধ্যে ২ জন মারা গেছেন। তাছাড়া এ তালিকায় আরো আছেন অটোরিকশা চালক মো: সিদ্দিকুর, লেগুনা চালক সেলিম, ৫৫ বছর বয়েসী বৃদ্ধ ট্রাক চালক পেয়ারম্যান, মনোয়ারা, রহিমা, রূপা, জেসমিন, রহিম বাদশা, তছিরুন নেছা সহ আরো অনেকে। দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম হচ্ছে এ তালিকা। এদের প্রায় সকলেই জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা সাধারণ নিরীহ মানুষ। কেউ কেউ আছেন ছাত্র শিক্ষক ও নিষ্পাপ শিশুও। দিন দিন মানুষ পোড়ার গন্ধে ভারী হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাতাস। রাজনীতিবিদরা রাজার নীতি অনুসরণ না করে জাহেলিয়াতি নীতি অনুসরণ করছেন বলে আমাদের এ অবস্থা। সাধারণ মানুষ যে রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন তারা এমন রাজনীতি চায় না, এমন বর্বরতাও চায় না। এ জন্য সাধারণ মানুষ আজ কারো ডাক শুনে না। কাউকে উদ্ধার করতে জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নামে না। যারা রাস্তায় পুড়ছে তারা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিশু-সবাই পথিক। নেতানেত্রীরা নির্বাচনের বর্ষপূর্তি গণতন্ত্র হত্যা দিবস উদযাপন করছেন আর বলির পাটা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সুশাসন চাইলে, গণতন্ত্র চাইলে, নির্বাচন দিতে ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধা থাকার কথা নয়। প্রধান দুই দলই একাধিকবার সরকারে ছিল, ছিল বিরোধী দলেও। দুই দলের আচরণ প্রায় একই ছিল। নিয়মনীতির পক্ষে, সুশাসনের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে তথা জনগণের পক্ষে তারা যতোটা ছিল তার চেয়ে শতগুণ বেশী ছিল নিজ দলের পক্ষে, দলীয় জনগণের পক্ষে। সরকারী দলে থাকলে ধর-পাকড়, বিরোধী দলে থাকলে হরতাল জ্বালাও পোড়াও আর সংসদ বর্জন। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন কোন এক দল আরেক দলের ইতিবাচক কাজগুলো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে, সমালোচনা করে। আসলে এ কাজ করতে গিয়ে তারা নিজেদের অজান্তে সরাসরি জনগণের বিপক্ষে চলে যায়। জনগণ এটা ভালোভাবে টেরও পায়। একেই বলে নোংরা রাজনীতি। সরকারের গঠনমূলক কাজে বিরোধী দলের সর্বাত্মক সমর্থন এবং সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা, আন্দোলনে সরকারের উচিত মূল্যায়ন করা, তাদের কর্মসূচী পালনে সহায়তা করা। সফল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা অত্যন্ত জরুরী। যা আমাদের দেশে মোটেও নেই।
আমাদের বাংলাদেশে একই দিন এক দল গণতন্ত্র রক্ষা দিবস, আরেক দল গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করতে গিয়ে গোটা দেশটাকে নরকে পরিণত করেছে। আমাদের দেশে রাজনীতি মানেই হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া এবং গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যুগ যুগ টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা।
বলেছিলাম সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা। এ দেশ আজ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নানা কৃতিত্বের অধিকারী। এ কৃতিত্বের পেছনে রয়েছে মানুষের কঠোর পরিশ্রম ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি। দেশের তরুণ-তরুণীরা বাহিরে লেখাপড়া করে, রাজনীতি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। তাদের সেবা নিচ্ছে বিদেশীরা। দেশে তাদের উপযুক্ত মূল্যায়ন হলে তারা দেশে ফিরে দেশের মানুষের সেবা করতে পারতেন। কিন্তু দেশে অস্থিতিশীল সংঘাতময় রাজনীতি তাদের ফিরে আসতে দেয় না।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে পণ্য সরবরাহে বিপর্যয় ঘটে। ফলে দেখা দেয় নানামুখী সংকট। এতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। ফলে অর্থনীতিতে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। শিল্প কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হলে উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটে। কাজেই দেশের এ দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে অবিলম্বে সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। অনেক হয়েছে। মানুষ পুড়িয়ে খাক করবেন না- পেট্রোলবোমার আগুনে, দ্রব্যমূল্যের আগুনে ও কষ্টের আগুনে। চাই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চির অবসান।
লেখক: কলামিষ্ট, সভাপতি, ফেঞ্চুগঞ্জ প্রেসকাব।