পরিবেশ ধ্বংসেও লিয়াকত ॥ স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে জোর করে মানববন্ধন
ছামির মাহমুদঃ সিলেটের তিন উপজেলার পরিবেশ ধ্বংসের মূল হোতা আওয়ামীলীগ নেতা লিয়াকত আলী এখন নিজেকে রক্ষায় পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন করছেন!। লিয়াকত সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের পাশ্ববর্র্তী প্রকৃতিকন্যা জাফলং এলাকায় বন বিভাগের টিলায় স্থাপিত গ্রীনপার্ক দখল করে পাথর ড্রামপিংয়ের ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে। ওয়ান ইলিভেনের সময় গড়ে তোলা দৃষ্টি নন্দন ‘জাফলং গ্রীণপার্ক’ দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতো। জাফলংয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকরা সরকারি এই গ্রীণপার্কটি দেখে মুগ্ধ হতেন। কিন্তু ২০১১ সালে এই গ্রীণ পার্কটির দিকে নজর পড়ে ভূমিখেকো লিয়াকতের। একে একে পুরো গ্রীণ পার্কটি দখল করে সবুজ এই টিলাটি এখন ধুলোবালির রাজ্যে পরিণত করেছে লিয়াকত। ফলে প্রকৃতি কন্যা জাফলংয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকরা এখন ধুলোবালির জন্য জাফলংয়ে যেতে পারেন না।
জাফলংয়ের প্রকৃতিকন্যার প্রবেশ মুখ এই গ্রীণ পার্কটি জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে বন বিভাগ শুধু লিয়াকতের তদবিরের কারণে। পর্যটন অঞ্চল জৈন্তা ও জাফলং লিয়াকত বাহিনীর লুলোপ দৃষ্টির কারণে ভোলাগঞ্জের মতো শ্রীহীন হয়ে পড়ে। এছাড়াও এই লিয়াকত বাহিনী শ্রীপুর নদীর উৎসমূখে নদীর পানি দুষণ করে সেইভ মেশিনের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন করছে। ফলে নদীর নি¤œাঞ্চলে দু’পারের বাসিন্ধারা পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এদিকে লিয়াকতের নির্দেশে পরিবেশের নিয়ম ভঙ্গ করে জৈন্তাপুর থেকে নলজুরী পর্যন্ত সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের দু-পার্শ্বে গড়ে উঠেছে ব্যাঙ্গের ছাতার মত টম টম ষ্টোন ক্রাশার মিল। পরিবেশ ধ্বংসকারী টমটম ষ্টোন ক্রাশার মিল টিকিয়ে রাখতে সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইমরান আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনিত করে ২৭সদস্য বিশিষ্ট “জৈন্তা-গোয়াইনঘাট বেসরকারি পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি” গঠন করেন লিয়াকত। গত ১৮ডিসেম্বর ৭ দিনের আল্টিমেটাম নিয়ে কমিটির মাধ্যমে জৈন্তা-গোয়াইনঘাটের সর্বত্র দিনব্যাপি প্রচার অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় একটি সরকারি প্রচারপত্র টমটম সহ সকল ষ্টোন ক্রাশার মিল মালিকদের মধ্যে বিতরন করেন। দীর্ঘ প্রায় ২৭দিন অতিবাহিত হয়ে আসলেও পরিবেশ বিনষ্টকারী টমটমসহ সকল ষ্টোন ক্রাশার মিল তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। প্রচারপত্রে মূল রাস্তা থেকে ৫০ মিটার, মসজিদ- মন্দির, বসতবাড়ী, হাসপাতাল, স্কুল কলেজ মাদ্রাসা থেকে ৫০০ মিটার, এবং বাজার এলাকা থেকে ২০০ মিটার দূরে মিল স্থাপন করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া পাথর ক্রাশিংয়ের সময় পর্যাপ্ত পানি ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। পরিবেশ দূষণ মুক্তের নাম নিয়ে এই নেতা অপকটে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
দৈনিক সবূজ সিলেট ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের পর লিয়াকত বিষয়টি ধামাচাপা দিতে জৈন্তিয়া কেন্দ্রিক ‘জৈন্তিয়া পর্যটন উন্নয়ন ও পূরাকীর্তি সংরক্ষণ’ নামে কমিটি ঘোষণা করে। এই কমিটির মাধ্যমে বৃহত্তর জৈন্তার পরিবেশ ধ্বংসকারী সকল প্রকারের যন্ত্রদানবের হাত থেকে জৈন্তিয়াকে রক্ষার দাবীতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করার ঘোষনা দেন। এই ঘোষণার পর লিয়াকত বাহিনী গতকাল মঙ্গলবার সিলেট তামাবিল মহাসড়কের আলুবাগান এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। মানববন্ধন কর্মসূচীর নেতৃত্বে পরিবেশ ধ্বংসের মূল হোতা লিয়াকতকে দেখে এলাকাবাসীর মন্তব্য- পরিবেশ ধ্বংসকারীর মূখে পরিবেশ রক্ষার বাণী বেমানান। শুধু মাত্র নিজের অপকর্ম ঢাকতে তড়িগড়ি করে অনুসারীদের নিয়ে জৈন্তিয়া পর্যটন উন্নয়ন ও পূরাকীর্তি সংরক্ষন কমিটি ঘোষনা ও মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে।
এছাড়া ওই সংগঠনের নাম করে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেন লিয়াকত ও তার সহযোগিরা। মানবন্ধন শেষে রেশমা (১৬) নামের নবম শ্রেনীর এক ছাত্রী প্রখর রোদে অসুস্ত হয়ে পড়ে। পরে তাকে দ্রুত জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক সংগঠনের নাম করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহার করায় ক্ষুব্দ এলাকার অভিভাবকরাও ।
সম্প্রতি জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে আদিবাসি খাসিয়াদের পান-সুপারির জুম দখল করে পরিবেশ ধ্বংসে ওই জুমে স্টোন ক্রাশার মিল স্থাপনের চেষ্টা চালায়। এ বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে তারা জৈন্তিয়া পর্যটন উন্নয়ন ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ কমিটি নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে গতকাল মঙ্গলবার উপজেলার আলুবাগান এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। একই দিন গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংএ পর্যটন রেঁস্তোরা উদ্বোধন করতে পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
মন্ত্রীর অনুষ্টানে যোগ দেয়ার কথা বলে আওয়ামী নেতা লিয়াকত আলী, এখলাছুর রহমান , ফয়েজ আহমদ বাবর, আতাউর রহমান বাবুল, আব্দুল জলিল ও খায়রুল ইসলাম বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মানববন্ধন কর্মসূচীতে নিয়ে যান। উপজেলার সরীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়, জৈন্তাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বিগ্রেডিয়ার মজুমদার বিদ্যানিকেতন, বাউরভাগ উচ্চ বিদ্যালয়, ক্যাপ্টেন রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়, মোকামপুঞ্জি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ কয়েকটি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের মানববন্ধনে অংশগ্রহনে বাধ্য করেন লিয়াকত।
এ সকল বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে রয়েছেন সারীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের আওয়ামীলীগ নেতা ফয়েজ আহমদ বাবর, বিগ্রেডিয়ার মজুমদার বিদ্যানিকেতন এ আওয়ামীলীগ নেতা লিয়াকত আলী, ক্যাপ্টেন রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়ে আওয়ামীলীগ নেতা এখলাছুর রহমান ও বাউরভাগ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল জলিল। তারা প্রভাব খাটিয়ে মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের কর্মসূচীতে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশ গ্রহণ করান। এ ঘটনায় এলাকায় অভিভাবকদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। স্কুল পরিচালনা কমিটি গুলোর বেশির ভাগ সভাপতিও লিয়াকতের অনুসারি। তার সাঙ্গ পাঙ্গরাই এখন জৈন্তাপুর নিয়ন্ত্রন করেন।
এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন আহমদ জানান, কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতা ছাত্রীদেরকে পর্যটন মন্ত্রীর একটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার কথা বলে নিয়ে যায়। কিন্তু মন্ত্রীর প্রোগ্রামে না নিয়ে ছাত্রীদেরকে তাদের নিজের মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করানো হয়। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।
এ ব্যাপারে সারীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বদিউল আলম জানান, তাঁর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আওয়ামীলীগ নেতা ফয়েজ আহমদ বাবর এর নির্দেশে তিনি মানববন্ধনে ছাত্র-ছাত্রী পাঠান।
এবিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা হাওলাদার আজিজুল ইসলাম বলেন- জাতীয় অনুষ্ঠান ব্যাতিত অন্য কোন অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী নিয়ে অংশ গ্রহণ করতে হলে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের অনুমতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোন প্রতিষ্ঠান আমাকে কিছুই জানায়নি। আমি বিষয়টি শুনেছি এবং তাৎক্ষনীকভাবে মানববন্ধনে অংশ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের কাছে কারণ জানতে চেয়েছি। সুষ্টু জবাব না পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এবিষয় ক্যাপ্টেন রশিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি জৈন্তপুর এর সভাপতি বিজন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন- আমি পরিবেশ ক্ষতি হচ্ছে মর্মে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উল্টো পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না মর্মে রিপোর্ট প্রধান করে। আমি বেশ কয়েক দিন থেকে সিলেটের বাহিরে প্রশিক্ষনে আছি। মানববন্ধনে ছাত্রছাত্রী নেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। বিদ্যালয় হতেও এ বিষয়ে আমাকে কেই কিছু জানায়নি।
এবিষয় বাউরভাগ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি জৈন্তপুর এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বলেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য ছাত্র/ছাত্রীরা মানব বন্ধনে অংশ গ্রহণ করতে পারে এতে অসুবিধার কিছুই নেই।
আরও পড়ূনঃ
- জৈন্তায় লিয়াকত লীলা : লাগামহীন লিয়াকত
- জৈন্তাপুরে সাংবাদিককে আটকে রেখে আ’লীগের লিয়াকত বাহিনীর নির্যাতন
- আওয়ামীলীগ নেতা লিয়াকত আলী ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে খাসিয়াদের পান সুপারীর বাগান দখলে নিলেন
- লিয়াকতের সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তিন উপজেলা
- পরিবেশ ধ্বংসেও লিয়াকত ॥ স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে জোর করে মানববন্ধন