ইসলামী আন্দোলনে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)

আখতার হোসাইন জাহেদ

Photo-Jahed Bai-4অজস্র মানুষের আধ্যাত্মিক রাহনুমা, ইসলামী আন্দোলন কর্মীদের দিকপাল, সংগ্রামী চিন্তা-চেতনার মূর্ত প্রতীক, বাতিলের মোকাবেলায় বজ্রকন্ঠ, এ উপমহাদেশ তথা গোটা বিশ্বের মশহুর মনীষী তিনি। সর্বোপরি বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ট মুজাদ্দিদ। তিনি আমাদের রাহবার আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)।

জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি তার চিন্তাই ছিল ইসলামী সংস্কার, দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসার, মানুষদেরকে সীরাতে মোস্তাকিমের পথ দেখানো আর ইসলামকে ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে নিরাপদ রাখার। যদি তার পুরো জীবনের দিকে তাকানো যায় দেখা যাবে বৃটিশ, পাকিস্তান, স্বাধীনবাংলা তিন আমলেই ইসলামী আন্দোলন অঙ্গনে তার ছিল সরব উপস্থিতি। কোনো আমলেই তিনি ইসলামকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হতে দেননি। করতে দেননি ইসলামের বিকৃত উপস্থাপন কিংবা ইসলাম বিদ্বেষী কার্যকলাপও। । জীবনের শুরুর দিকটা তিনি কাটিয়েছেন নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের করিমগঞ্জে। লেখা-পড়া শেষ করে তিনি সেখানকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, কুরআনুল কারিমের যুগশ্রেষ্ঠ ক্বারী, সমাজ সংস্কারক, পীর, মুর্শিদ, আরোও কত কিছুতে রূপান্তরিত হন। তাই তিনি সে সময় লড়েছেন এ সকল মানুষের অধিকার আদায়ে, ইসলাম বিরোধী সকল তৎপরতা প্রতিরোধে।
১৯৫১ সাল, ইতিমধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে উপমহাদেশ। তার লাখো মুরিদের আবাসভূমি আসাম প্রদেশে মুসলিম এডুকেশন বোর্ড বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানকার সরকার। খবর এল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর কাছে। তার মুরিদীন,মুহিব্বীনসহ মুসলমানরা সেখানে চেতনারুদ্ধ। গর্জে উঠলেন ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। ইসলাম বিদ্ধেষী এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেবার নয়, মানাও যাবেনা। আন্দোলনের ডাক দিলেন সে দেশের পীর বীর আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। প্রতিবাদ হুংকারে থরথর আসাম রাজ্যের মসনদ। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল ফুলতলী আহুত মিছিল-সমাবেশে। গ্রেফতারী পরোওয়ানা মাথায় নিয়ে ছাহেব কিবলাহ থামলেন না, চালিয়ে গেলেন আন্দোলন। অবশেষে তার উপর গুলির অর্ডার, কিন্ত ইসলামী আন্দোলনের মর্দে মুজাহিদ তা তোয়াক্কা করলেন না, সভা সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জনমত সৃষ্টি করলেন বীরদর্পে। ইসলাম ও মুসলমানদের মনের আকুতি প্রকাশ করলেন আপন ভাষায়, আপন কথায়। বর্ণিত ঘটনা তার ভারত বর্ষে ইসলামী আন্দোলনের এক কিয়দাংশ মাত্র।
১৯৭১ সাল পরবর্তী বাংলাদেশে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) ইসলাম দেশ ও মানবতার দূরাবস্থা দেখে হয়ে উঠলেন পুরোপুরী উদ্বিগ্ন। দেশের ছাত্র সমাজকে বিভ্রান্তির ভেড়াজালে ফেলে এদের সম্ভাবনাময়ী জীবন বিনষ্ট করে দিচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। এমন পরিস্থিতিতিতে এদেরকে এ বেড়াজাল থেকে উদ্ধারকল্পে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন তিনি। সুন্নিয়তের দিকদিশারী হিসেবে ভ্রান্তির করালগ্রাসে নিমজ্জিত এ ছাত্র সমাজকে দেখালেন আলোর পথ। ১৯৮০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তাদেরকে উপহার দিলেন বাংলাদেশ আন্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া নামে সুন্নি মতাদর্শী একটি ছাত্র সংগঠন। পরে এই ছাত্র সংগঠনকেই তিনি বেঁছে নিয়েছেন তার ইসলামী আন্দোলনের উত্তম হাতিয়ার হিসেবে। স্বার্থক বেঁচে নেয়া, তার এ হাতিয়ার কোনদিন ভেঙ্গে পড়েনি, তাতে ক্ষয়ও ধরেনি বরং সময় সময় নিপাত করেছে ইসলাম বিদ্ধেষী সকল কর্মকান্ডের, এদের মূল হোতাদের। যার জন্যে তিনি এ কাফেলার কর্মীদেরকে শিকারী পাখির সাথে তুলনা করেছেন। আর দোয়া করেছেন আকন্ঠচিত্তে। বলেছেন আমার ইন্তেকালের পর যদি আমাকে কোন ভাবে দোয়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে আমি তালামীযের জন্য দোয়া করব।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) স্বদেশে ইসলামী আন্দোলনে ছিলেন সকলের রাহবার। যখনই এদেশে ইসলাম ও মুসলমান কোন অপশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, মাঠে দেখা গেছে ফুলতলী ছাহেব কিবলা’র তীব্র প্রতিবাদ।
১৯৮০ সাল, ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুন রক্ষার অনন্য মূখপত্র দৈনিক ইনকিলাব বন্ধ করে দিল তৎকালীন সরকার। দেশ-বিদেশে আন্দোলন চলছে ইনকিলাব খুলে দেয়ার, ছাহেব কিবলাহ থেমে নেই, তার শিকারী পাখিদের দ্বারা ডাক দিলেন আন্দোলনের। সিলেট রেজিষ্ট্রারী মাঠে তার দৃপ্ত ঘোষণা “যদি ইনকিলাব খুলে না দেওয়া হয় তাহলে সারা দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে, আমি থাকব সবার সামনে”। তার এ হুংকার বৃথা যায়নি। ইনকিলাব খুলে দিতে বাধ্য হল সরকার।
১৯৯৪ সাল, নারীবাদী লেখিকা তাসলিমা নাসরিন ইসলাম বিদ্ধেষী লিখা লিখল। নাস্তিকতার পরিচয় ফুঠে উঠল তার লিখায়। তাসলিমা বিরোধী আন্দোলন শুরু হল সারা দেশে। এদিকে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) ক্ষোভে অগ্নিশর্মা, সিলেটের ইসলামী নেতৃবৃন্দকে নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। তার আন্দোলন সিলেট থেকে ছড়িয়ে পড়ল দেশের সর্বত্র। তৎকালীন সরকারের হাবভাবে কিছুটা তাসলিমাপ্রীতি পরিলক্ষিত হলেও অদূর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ভেবে দেশ থেকে বিতাড়িত করল তারা তাসলিমাকে। আজও তাসলিমার মাথা গোঁজাবার ঠাঁই হয়নি এদেশে।
১৯৯৯ সাল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের নামকরণ বিতর্কিত ব্যক্তিদের নামে করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র অনুমতি নিয়ে তারই প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলনের অতন্দ্র প্রহরী ছাত্র কাফেলা তালামীযে ইসলামিয়া আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সিলেট নগরী সহ শাহজালাল (রহ.) এর স্মৃতি রক্ষার এ আন্দোলন পৌঁছে গেল সিলেটের সর্বত্র। শুরু হয় মিছিল-মিটিং প্রতিবাদ সমাবেশ। গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। ২৫ ডিসেম্বর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে পঙ্গুত্ব বরণ করেন তালামীয কর্মী মুকিত রহমানী, বাক্বী খালেদ সহ অনেকে, শাহাদাত বরন করেন বেলাল নামে ইসলামী আন্দোলনের আরেক কর্মী। এ খবর পেয়ে ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহ.) আরো ফুঁসে উঠলেন ডাক দিলেন মহা সমাবেশের। ২০০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিলেট কোর্ট পয়েন্টে সেদিনকার ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে তিনি বজ্রকন্ঠে বললেন “সরকার যদি নামকরণ পরিবর্তন না করে তাহলে আমি ডাক দিলে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে” তার এ প্রতিবাদী হুংকারে টনক নড়ল সিন্ডিকেট সহ শেল্টার প্রদানকারী মহলের। থমকে দাড়াল সিদ্ধান্ত।
২০০৪ সাল, ধর্ম মন্ত্রনালয় কর্তৃক হাজীদের জন্য প্রণিত হজ্জ গাইডে লিখে দেয়া হল জিয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র হজ্জে যাওয়া যাবেনা। ইসলাম বিকৃত এমন লিখিত বক্তব্যও দৃষ্টিগোচর থেকে বাদ পড়েনি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র। দূরদর্শী ছাহেব কিবলাহ বুঝতে পেরেছিলেন এটি নিচক মুসলমানদের ঈমান বিধ্বংসী একটি ষড়যন্ত্র। ততক্ষণাৎ তিনি সে সময়ে সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শানে রিসালত মহাসম্মেলনে পরিস্কার ভাষায় ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “সরকারের পেটে ক্রিমি ঢুকে গেছে, এরকম ঈমান বিধ্বংসী বই যদি সরকার বেন্ড না করে তাহলে সরকারের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ হবে”। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর এ হুশিয়ারী সাথে সাথেই আঘাত হানল সে সময়কার ক্ষমতাসীনদের কর্ণকোহরে। বেন্ড করে দেয়া হল বিতর্কিত হজ্জ গাইড।
২০০৬ সাল, মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র, মাদরাসার ফাযিল ও কামিলকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যাস্ত সহ মাদরাসায় ৩০% মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগের সিদ্ধান্তের সকল আয়োজন মোটামোটি সম্পন্ন। দেশের ইসলামী চিন্তাবিদদের ধারণা তলিয়ে যাচ্ছে মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন দেশের আলেম-উলামা, পীর মাশায়েখ সহ ইসলামী নেতৃবৃন্দ। ঐদিকে প্রতিবাদমূখর আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.), যেন জীবন বাজি রাখবেন। সিলেট থেকে সাত শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে লংমার্চ করলেন ঢাকা অভিমুখে। স্মরণ কালের শ্রেষ্ঠ লংমার্চ পরবর্তী বায়তুল মুকাররাম মসজিদের উত্তর গেটে অনুষ্ঠিত জনসমুদ্রে তার সাহসী হুংকার স্তব্দ করে দিল সকল আয়োজন, সকল ষড়যন্ত্র। সেদিন রক্ষা হল মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব ঐতিহ্য।
এ রকম আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) আজীবন, আমরণ। তার সাহসিকতা, নির্ভিকতা কারো কাছে মাথা নত করেনি বরং বীরদর্পে চলেছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
লেখকঃ- সংগঠক, বিভাগীয় সম্পাদক পূর্বদিক ডটকম
মোবাঃ ০১৭২৯ ৪৩৩৪৬১