শেষ চিঠি : মোঃ শামীম মিয়া

shamim miahshamim miahshamim-miahগ্রাম আমদির পাড়া। চারদিক সবুজে ঘেরা, আমাদের পাড়া। মাঠে, মাঠে, রাখালের বাঁশি বাজানো সুর, চলে যায় গ্রাম পেড়িয়ে বহুদুর। গাছে, গাছে, হরেক রকম ফুল, ফল,পাখির ডাক। রাতে জোনাকী পোকার মিটমিট আলো,আহা খুব সুন্দর লাগে দেখতে ভালো। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে, আছে একটা বটগাছ। বটগাছটার বয়স প্রায়, একশত বছর হবে। এই বটগাছটার চারদিক দিয়ে গড়ে উঠেছে জনপদ। বটগাছের দেিন যমুনা নদী, এবং পশ্চিমে বাঙ্গালী নদী। বটগাছের আশে পাশে বেশ কয়টা দোকান আছে। দক্ষিনে জুমারবাড়ী বাজার, উত্তরে সাঘাটা থানা, কয়েক কিলো দুরে গাইবান্ধা জেলা। বটগাছের নিচে বসে অনেক শ্রমজীবি লোকজন বিশ্রাম নেয়। বটগাছটা থাকার কারনে ভ্যান চালক ভাইয়েরা ও গ্রামের লোকেরা এর নাম দিয়েছে বটতলী। বটতলী নামেই এই জায়গাটা বর্তমানে পরিচিত। এই বটগাছের ইতিহাস বলা বাহুল্য।
১৯৭১ সালের কথা বলেছেন আমাকে আমার দাদা। এই বটগাছ থেকে প্রায় দুইশত গজ পশ্চিমে থাকতো সাদিকরা। তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। মা-বাবার আদরের একমাত্র সন্তান ছিলো সাদিক। সাদিক পড়তো পঞ্চম শ্রেণীতে। বটগাছের নিচে ছিলো পাকিস্তানিদের মূল আস্থানা। তারা এখানে বসেই ঠিক করতো কোথায় আক্রমণ করবে। সাদিকরা ছিলো গরিব। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হলেও ছিলো একজন কৃষক। পড়াশোনা কিছুই জানত না সাদিকের বাবা সাদেক আলী। ঢাকা থেকে কোনো চিঠি এলে বাবা সাদেক আসতো সাদিকের কাছে। সাদেক প্রায় দেড় মাস ধরে রাতে বাড়িতে আসে না দিনেও আসে না। যদি পাকিস্তানি বাহিনীরা তাকে দেখে তাহলে তার প্রাণ হারাতে হবে। সাদিক বাবার কাছে গিয়ে মাঝে মধ্যে টাকা নিয়ে আসে। বাজারে গিয়ে খরচ করে আনে সাদিক। মা ছেলে রান্না বান্না করে খায়। আবার কোনো কোনো দিন খেতে পায় না, না খেয়ে থাকতে হয় তাদের। বাবার কাছে তো সব সময় টাকা থাকে না। যেদিন বাবা টাকা দেয়, সেই দিন খাবার জোটে তাদের । বাবা তো আবার সব সময় থাকে না। সেদিন সাদিক আসছে তার বাবার কাছ থেকে। আসতেই সাদিকের সামনে পড়লো পাকিস্তানি বাহিনীরা। সাদিককে তারা জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাওয়া হয়েছিলো? সাদিক বললো আমি আমার বাবার কাছে গিয়েছিলাম। টাকা নিয়ে আসবো বলে ঘরে তো চাল নেই। আগামীকাল যাওয়ার কথা ছিলো বাবার কাছে। আমি আজই গিয়েছিলাম কিন্তু বাবাকে তো পেলাম না চাল কেনা বুঝি আজ আর হল না। আজও মনে হয় না খেয়ে থাকতে হবে। এক পাকিস্তানি বললো তোমার বাবা কী মুক্তিযোদ্ধা ? এই কথা বলতেই পেছন থেকে হারুন বললো, মাথা নাড়িয়ে বলিস না। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা । সাদিক যেন বুঝে চুপ করে থাকলো। এদিকে অন্য গ্রামের গুলির আওয়াজ শুনতে পেল পাকিস্তানিরা। সাদিকের উত্তর না নিয়ে তারা ছুটলো সেখানে। হারুন আর এক পাকিস্তানি থাকলো এখানে। সাদিক বললো আমি তাহলে আসি। পাকিস্তানি বললো না তুমি যেতে পারবে না। এই কথা হারুন শুনে ভাবলো ওরা যুদ্ধ করতে গেলো যদি ফেল খায়, খাবেই তো। তাহলে সাদিককে গুলি করবে এসেই। হারুন পাকিস্তানি কে বললো ভাই একে ছেড়ে দেন। পাকিস্তানি বললো না একে ছাড়া যাবে না। নিয়ে আসো আমাদের আস্তানায়। এই হলো মুক্তিযোদ্ধাদের সেই ছেলে। যে আমাদের খবর নিয়ে যাওয়া আসা করে। হারুন মনে মনে ভাবলো সাদিককে এইখান থেকে বিদায় দিতে হবে তা না হলে ওরা মেরে ফেলবে সাদিককে। আস্তানায় গিয়ে হারুন দেখলো সেখানেও কেই নেই। পাকিস্তানি হারুনকে বললো আমি পাশের রুমে আছি। তুমি বন্ধুকটা পরিস্কার কর। হারুন বললো ঠিক আছে। পাকিস্তানি যখন রুমে গেলো তখন হারুন সাদিককে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বললো। সাদিক পালালো। তার বুকটা কাপঁছে। সে দৌড়ে গেলো বাড়িতে। মা মা বলে ডাকছে সাদিক। মা নামাজে কোনো কথা বলতে পারছে না। সাদিক মনে করলো তার মাকে হয়তো পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে। আস্তে আস্তে ভয়ে সে ঘরে ঢুকলো। সাদিক তার মাকে খুজছে। এ ঘরে ও ঘরে কোথাও নাই। মা রান্না ঘরে নামাজ পড়ছে। তারপর যেন সাদিকের বুকে প্রাণ এলো। সাদিকের চোখে জল ছলছল করছে এবং মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মা বললো বাবা সাদিক কী হয়েছে তোর? আমাকে বল। সাদিক বললো মা আমি আজ পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলাম। মায়ের বুকটা কেঁপে উঠলো এবং বললো, বাবা কীভাবে ধরা পড়েছিস? আর এলিই বা কী করে? সাদিক তার মাকে সব খুলে বললো। এদিকে হারুন পড়ে যায় বিপদে। কিছুণ পর পাকিস্তানিটা দৌড়ে এলো। এসে দেখলো সাদিক নেই। হারুনকে জিজ্ঞাসা করলো ওই ছেলেটি কোথায়? হারুন বললো আমি ছেড়ে দিয়েছি। পাকিস্তানি হারুনকে মারতে চাইলো কিন্তু সেই সুযোগ হারুন দিল না। হারুন সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানিকে তার বন্দুক দিয়ে গুলি করলো। সেখানে পাকিস্তানিদের কয়েকটা বন্দুক ছিলো। হারুন সেগুলো নিয়ে ওই আস্তানায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। হারুন সেখান থেকে যায় বাঙ্গালী নদীর পাশে মুক্তিবাহিনীর আস্তানায়। বন্দুক দিয়ে সাদেককে বললো তার ছেলে সাদিকের কথা। কমান্ডার রফিক বললো, হারুন তুমি যে সাদিককে বাঁচিয়ে এক পাকিস্তানিকে হত্যা করে তাদের আস্তানা পুড়িয়ে দিয়েছো, যদি ওরা জানতে পারে তাহলে। হারুন বললো রফিক ভাই আপনি একটা বুদ্ধি দেন, যাতে ওরা বুঝতে না পারে। এক মুক্তিযোদ্ধা বললো তুমি আর যেও না ওখানে। এখানেই থাকো আমাদের সাথে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করো। রফিক বললো না। আমাকে ভাবতে দাও কী করা যায়। সাদেক বললো রফিক ভাই হারুন ওখানেই থাক কারণ হারুনের দ্বারাই আমরা জানতে পারি পাকিস্তানিরা কোথায় আক্রমণ করবে? তুমি যাবে হারুন তবে তোমার উপর অনেক চাপ আসবে যদি দেখে তোমার গায়ে আঘাতের কোনো দাগ নাই। তাই তুমি তোমার গায়ে আঘাত করে যাবে। ওখানে বলবে মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে মেরে এই অবস্থা করেছে। শাহজাহানও একজন মুক্তিযোদ্ধা। শাহজাহান বললো তা কী করে হয় ? নিজের গায়ে নিজে আঘাত করবে কীভাবে? রফিক বললো শাহজাহান আমরা শপথ নিয়েছি। আমাদের মাতৃভুমির জন্য জীবন দিব। হারুন বললো, হ্যা ভাই আমি রাজি। সবাই খুশি হয়ে বললো ঠিক আছে। তাহলে তুমি আসো আর খবর দিও পাকিস্তানিরা কোথায় কখন আক্রমণ করবে। হারুন বললো ঠিক আছে আজ তাহলে আসি। আল্লাহ্ হাফেজ। এদিকে হারুন আস্তানায় আসতেই দেখলো, তিনশত গজ দূরে পাকিস্তানিরা আসছে। হারুন নিজে গায়ের অনেক জায়গায় আঘাত করলো নিজেই। এবং বুদ্ধি করে বটগাছের নিচে একটা জমিতে শুয়ে পড়লো। শরীরে কাঁদা দিয়ে মেখে নিলো হারুন। পাকিস্তানিরা দূর থেকে দেখতে পেল তাদের আস্তানায় আগুন লেগেছে। তারা মনে করলো মুক্তিবাহিনীরা এসেছে। তাই ওখান থেকে প্রস্তুতি নিল যুদ্ধ করার জন্য। দুই একটা গুলি ছুড়লো আকাশের দিকে। কাছে ভয়ে ভয়ে এসে দেখলো বীর মুক্তিযোদ্ধারা নেই। তাদের সঙ্গীও নেই। হারুন উহ্ আহ্ করে ডাকছে স্যার আমি এখানে। তারা সবাই এলো হারুনের কাছে। হারুন ঠিক ঐ কথাগুলো বললো। সাদিকের কথা আর জিজ্ঞাসা করলো না পাকিস্তানিরা।
পাঁচ দিন পর গোলাগুলি আবার শুরু হলো। বটতলায় সেখানে শহিদ হলেন তাদের কমান্ডার রফিক ও আরো দুইজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সম্মানের সাথে কবর দেওয়া হলো। তারপর ঠিক করা হলো সাদেক হবে কমান্ডার। তাই হলো। তারপরের দিন সাদেক এলো বাড়িতে। এসে দেখলো তার স্ত্রী ও ছেলে ুধার জ্বালায় ঠিকভাবে কথা বলতে পারছে না। সাদেক চোখের পানি ফেলে বলছে সাদিক বাবা কেমন আছিস? সাদিকের মা তুমি কেমন আছো? সাদিক আর সাদিকের মা বললো ভাল আছি। তুমি কেমন আছ? সাদিকের বাবা সাদিককে কিছু টাকা দিয়ে বললেন যাও বাবা বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে আনো। সাদিক বললো ঠিক আছে বাবা আমি এুনি যাচ্ছি। সাদেকের বাড়ির পাশে থাকতো আনোয়ার নামের এক মধ্য বয়সী লোক। সে ছিল একটা রাজাকার। তার ধন-সম্পদ অনেক। পাকিস্তানিদের আস্তানা পুড়ে যাওয়ার পর থেকে পাকিস্তানিরা আনোয়ারের বাড়িতে থাকে। আনোয়ার যাচ্ছিল সাদেকের বাড়ির পাশ দিয়ে। তখন সে সাদেকের কন্ঠ শুনতে পেল। সাদেকের সাথে তার আগে থেকেই শত্রুতা ছিল জমি নিয়ে। আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর দিলো পাকিস্তানিদের যে সাদেক বাড়িতে এসেছে। হারুন পাশের রুমেই ছিলো। সে সব শুনতে পেলো। পাকিস্তানি ঠিক দশ মিনিট পর যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হারুন এমন অবস্থায় আছে যে সে বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না। হারুন মনে করলো কারো হাতে এই খবরটা দেই। পাকিস্তানিদের ফাঁকি দিয়ে হারুন পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে এলো। পাকিস্তানিরা এর মধ্যে সাদেকের বাড়িতে রওনা হলো। হারুনের বুক কাঁপছে কী করা যায়। হারুন নিজে দৌড়ে গেলো মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। গিয়ে বললো এই কথাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও এলো সাদেকের বাড়ি। এসে দেখলো পাকিস্তানিরা সাদেকের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। সাদেক ভয়ের মধ্যে পড়ে গেলো। সাদেক চিন্তা করছে তার স্ত্রীর কথা, ছেলের কথা। এর মধ্যে শুরু হলো গুলাগুলি। এসেছে মুক্তিযোদ্ধারাও। সাদেকের মনে একটু সাহস এলো। সাদেকও গুলি করতে লাগলো। এরই মধ্যে বাজার থেকে এলো সাদিক। এসে এই অবস্থা দেখে ভাবলো আমার এখন যাওয়া যাবে না একটু পরে যাই। বাড়ির সামনে মসজিদ সাদিক তার আড়ালে লুকিয়ে থাকলো। সাদেক তার স্ত্রীকে নিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে যেতেই গুলি লাগলো সাদিকের মায়ের পায়ে। তারপর তার বাবার হাতে। মা-বাবার চিৎকার শুনে সাদিক আর থাকতে পারলো না লুকিয়ে। ছুটতে লাগলো মা-বাবার কাছে। সামনে এসে দাড়ালো হারুন। হারুনের হাতে অস্ত্র। হারুন বললো বাবা সাদিক খালি হাতে নয় এই বন্দুকটা নাও তাহলেই যেতে পারবে সামনে। সাদিক একবার বন্দুকের দিকে তাকিয়ে হাতে তুলে নিলো অস্ত্র। ছুটলো গুলি ছুড়তে ছুড়তে মা-বাবার দিকে। ধ্বংস করে দিলো পাকিস্তানিদের আমদির পাড়া গ্রাম থেকে। এই যুদ্ধে শহিদ হলো পাচঁ জন সাদিকের মা সহ। সাদিক মায়ের সাথে কোনো কথা বলতে পারলো না। বাবার যায় যায় অবস্থা। বাবাকে নিয়ে গেলো মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সাদিকের মনের মধ্যে অনেক কষ্ট। মাকে হারিয়ে সে একা হয়ে গেলো। মা ছিলো সাদিকের সবচেয়ে আপন মানুষ। সেই মা আর থাকলো না চলে গেলো এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে। সাদিকে কাছে এসে শাহজাহান বললো, বাবা সাদিক আমি জানি তোমার মনের অবস্থা। তারপর ও বলছি বাবা তুমি আর কান্না করো না। বরং তুমি বাংলাদেশের জন্য কিছু করো। সাদিক বললো আমি ছোট্ট ছেলে। আমি কীভাবে যুদ্ধ করবো। সাদেক অসুস্থ হওয়াতে শাহজাহান এখন কমান্ডার। শাহজাহান বললো বাবা সাদিক তুমি যুদ্ধ করতে পারবে না তা ঠিক কিন্তু তুমি খোঁজ খবর আনা নেওয়া করবে। সাদিক বললো না না তা কেমন করে হয়। শাহজাহান বললো এই বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হোক তা কী তুমি চাও না? তুমি কী চাওনা যারা তোমার মাকে হত্যা করেছে তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে? সাদিক শুনছে আর ভাবছে কী করা যায়। হঠাৎ সাদিক বলে উঠলো হ্যাঁ আমি রাজি, আমি রাজি। বাবা পাশের ঘর থেকে বলছে শাহজাহান সাদিককে নিয়ে এসো আমার কাছে। শাহজাহান আর সাদিক এসে বললো, কী বলেন? সাদেক বললো আমি দেশের জন্য প্রাণ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রাণ গেলো না আমাকে পঙ্গু হয়ে থাকতে হলো। হয়তো আমি আর ভালো হতে পারবো না। তবুও আমি আমার মাতৃভুমির পতাকা মাটিতে পড়তে দিবো না। এক হাত গেছে তো কী হয়েছে আরেকটা হাত আছে আমার। এই হাত দিয়ে আমি যুদ্ধ করে যাবো। বাবার চোখে পানি ছলছল করছে। শাহজাহানের চোখে পানি আর সাদিক তো কাঁদছে আর কাঁদছে। সাদেক বললো হয়তো সাদিকের মায়ের নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে না তবে শহিদের খাতায় গণনা হিসেবে থাকবে সাদিকের মাও। সাদিক তখন চিৎকার দিয়ে উঠলো মা ও মা বলে। তখন ক্যাম্পে থাকা ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটে এলো সাদেকের রুমে। তারা মনে করলো হয়তো কমান্ডারের কিছু হয়েছে। সাদেক সবাইকে ল্য করে বললো তোমরা সবাই এসেছো খুব ভালো হয়েছে। তাহলে শুনো আমার সাদিক আজ থেকে হবে তোমাদের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো এর নাম থাকবে না তোমাদের খাতার পৃষ্ঠায়। সাদিক থাকবে তোমাদের মনের মাঝে মনে গাথা। এক মুক্তিযোদ্ধা বললো সাদেক ভাই সাদিক কী আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে? সাদেক বললো না সাদিক যুদ্ধ করবে না। তবে সাদিক আমাদেরকে অন্যান্য খবর এনে দিবে। কোন বাড়ি থেকে কাকে ধরলো, কোন মাকে ধরে নিয়ে গেলো পাকিস্তানিরা কোথায় নিয়ে যাবে তাদের। এইসব খবর রাখাই সাদিকের প্রথম কাজ। তারপর ঠিক করবো সাদিক কোথায় কীভাবে কী করবে? একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো ভাই হারুন তো আছে এর জন্য। সাদেক বললো হারুন অনেক সময় আমাদেরকে খবর দিতে পারে না। তাই হারুন আর সাদিক মিলে এই কাজ করবে। আর একটা বাড়তি কাজ করবে সাদিক সেটা হলো আমাদের মুক্তিবাহিনীর মধ্যে থেকে কেউ পাকিস্তানিদের সাহায্য করছে না কী এই তথ্য সাদিক নিবে। সেগুলো কাউকে না বলে সাদিক একটা কাগজে লিখে কমান্ডারকে জমা দিয়ে যাবে। কমান্ডার তার বিচার করবে। সবাই বললো হ্যাঁ সাদেক ভাই আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। তাই হবে তবে সাদিকের মতটা জানা উচিত। শাহজাহান বললো বাবা সাদিক তুমি রাজি তো। সাদিক বললো চাচা রাজি কেন হবো না। আমার মা জীবন দিয়েছে দেশের জন্য। বাবাও মৃত্যু সয্যায়। এখন আমি যদি দেশের জন্য কিছু না করি তাহলে কী হয়, বলুন। আমি একা সাদিকের প্রাণ গেলে যদি ল ল সাদিক বাঁচে তাহলেই আমার জীবন সার্থক। বাবা সাদেক সাদিকের কথা শুনে বাম হাতটা বাড়িয়ে বললো আয় বাবা আমার বুকে আয়। বুকে জরিয়ে আদর করলো সাদিককে ওর বাবা।
হঠাৎ গুলির শব্দ শুনা যায়। শাহজাহান মুক্তিযোদ্ধাদের কে তৈরি হতে বললো। অপারেশনে যেতে হবে। তারা সবাই বাহিরে এসে দেখলো এই শব্দ যমুনা নদীর ওপারে। তারা সবাই ঠিক করলো ঘুমাবে। রাত বাজে বারোটা। ১০ জন জেগে থাকবে দুই ঘন্টা। আর ৩০ জন ঘুমাবে দুই ঘন্টা পর। আবারো ১০ জন পাহাড়া দেবে ১০ জন ঘুমাবে। এইভাবে রাত কাটিয়ে দিলো তারা।
পরের দিন সকালে সাদিক বের হলো অনুসন্ধান করতে। এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে সাদিক। কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছে না। কিছু দূর যাওয়ার পরে দেখলো মন্ডলের বাড়িতে কান্না শুনা যাচ্ছে। সাদিক সেখানে গিয়ে দেখলো একটা মেয়ের লাশ। সাদিক বললো কে মেরেছে? এই মেয়ে কার কে হয়? এক বৃদ্ধ বললো এটা আমার মেয়ে। আমি আমার মেয়েকে রা করতে পারলাম না বাবা। সাদিক বললো চাচা পাকিস্তানিদের আস্তানা কোথায়? বৃদ্ধ বললো ওই যে প্রাইমারি স্কুলের পাশে এক বাঁশঝাড়ের মধ্যে। সাদিক বললো চাচা আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাদেকের ছেলে। গ্রাম আমদির পাড়া। আপনাদের গ্রামে এসেছি গতকাল। বৃদ্ধ বললো বাবা আমিও যুদ্ধ করতে চাই। রুখে দাঁড়াতে চাই ঐ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সব অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সাদিক বললো ঠিক আছে। আপনি আমার সাথে আসুন আমার বাবার ক্যাম্পে। বৃদ্ধ তৈরি হলো যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ পেছনের বাড়ির মরিয়মের মা বললো বৃদ্ধকে বাবা আমাদের বাঁচান। বৃদ্ধ বললো কেন মা কী হয়েছে? মরিয়মের মা বললো, বাবা আমার মরিয়মের বয়স ১৭ বছর। তাকে না কী আজ রাতে পাকিস্তানি হানাদার শয়তান বাহিনী তুলে নিয়ে যাবে। বৃদ্ধ মাথা নিচু করে থাকলেন কারণ গতকাল তার মেয়েকে পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করেছে। তারপর হত্যা করেছে। বৃদ্ধ বাবা কিছু বলার আগে সাদিক বললো মা আপনি বাড়ি যান। আপনাদের কোনো তি হবে না। মা বললো তুমি কে বাবা? সাদিক বললো, আমি সাদিক। আমার বাবার নাম কমান্ডার সাদেক। মহিলা বললো, বাবা সাদেক ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলো। তিনি এখন কোথায়? সাদিক বললো বাবা এখন অসুস্থ। তবে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আপনি যান। আপনাদের দায়িত্ব এখন মুক্তিযোদ্ধারা নিয়েছে। তবে মা আপনার স্বামী অর্থাৎ মরিয়মের বাবা কী বেঁচে নেই? মা বললো ছিলো, এখন বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কয়েকদিন পর মরিয়মের বাবা শহিদ হোন। সাদিক বললো ঠিক আছে আপনি কিছু ভাববেন না। আমরা আসি।
কিছু দূর গিয়ে সাদিক মাঠে বসলো এবং চিঠি লিখলো তার বাবার কাছে।
এই বৃদ্ধ বাবাকে যেন তাদের সঙ্গী করে নেয়। আর আজ রাতে মন্ডলের বাড়ি থেকে পাকিস্তানিরা এক মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। হয়তো রাতে আসবে তাই আপনারা যদি পারেন একটু আগেই আসবেন। মেয়ের নাম মরিয়ম। তার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা তবে শহিদ হয়েছেন। বাবা আজ এই পর্যন্ত। আল্লাহ্ হাফেজ।
বৃদ্ধ তাদের ক্যাম্পে এলো এসে সাদেককে এই চিঠিটা দিলো। সাদেক অন্য একজনকে দিয়ে চিঠিটা পড়ে নিলো। তারপর তাকেও তাদের সঙ্গী করে নিলো। এবং দুপুর দুইটার দিকে সেখানে যায় এবং যুদ্ধ করে রা করলো মরিয়মকে। সেখানে মারা যায় পাকিস্তানি দুইজন।
এইভাবে কেটে যায় প্রায় দুই মাস। এই দুই মাসে সাদিকের দেওয়া খোঁজে মুক্তিবাহিনীরা রা করে ১১টি গ্রামেরও বেশি। তারা এখন অবস্থান করছে কচুয়া প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। সেখানে ছিলো পাকিস্তানির বড় টিম। বাঙ্গালী মাত্র ৩৭ জন। আর পাকিস্তানি ছিলো ২৫০ জন। সাদেক এক হাত দিয়েই যুদ্ধ করে তবে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে শাহজাহান। পাকিস্তানিরা এখনো জানে না মুক্তিযোদ্ধারা এখানে।
পরের দিন সাদিক এলো কচুয়া। এসে মুক্তিাযোদ্ধাদের খুজে বের করলো। বাবা সাদেকের সাথে দেখা করে চলে যাবে এমন সময় শাহজাহান বললো বাবা সাদিক আজ আমাদের বাড়ি যাবে। আমার মেয়ে চাঁদনীর কথা আমার খুব মনে পড়ছে। শাহজাহানের চোখটা ভরে গেলো যেন পানি দিয়ে। সাদিক বললো, চাচা জানি আপনার বাড়ি জুমারবাড়ী। তবে কোন দিক দিয়ে যাবো বলেন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো তারা কেমন আছে। শাহজাহান তার বাড়ি কোন দিক দিয়ে যেতে হবে বলে দিলো। সাদিকের আজ প্রথম কাজ শাহজাহানের বাড়ি যাওয়া। তার পরিবার সম্বন্ধে কিছু জেনে আসা তারা কেমন আছে। সাদিক এলো শাহজাহানের বাড়িতে। এসে সে চারদিক ভালো করে দেখছে। হঠাৎ এক বৃদ্ধ মা চোখে পানি নিয়ে এসে বললো, বাবা তুমি কে? সাদিক বললো দাদী আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাদেকের ছেলে। বৃদ্ধ তখন বললো বাবা আমার খোকা শাহজাহান কেমন আছে? ও কোথায়? সাদিক বৃদ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো আপনার খোকা ভালো আছে। মা তখন বললো আমি জানি আমার খোকারা বাংলাদেশ স্বাধীন না করে কোথাও যাবে না। সাদিক বললো শাহজাহান চাচার মেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? বৃদ্ধ মা বললো আছে ঐ ঘরে। সাদিক ঘরের দরজায় গিয়ে দেখলো মা মেয়ে দুই জনে মিলে চাচার সেই বিবাহ বন্ধনের ছবি নিয়ে মাটিতে বসে কাঁদছে। সাদিক অবাক হয়ে গেলো। এতো ভালোবাসে তারা শাহজাহান চাচাকে। আর তিনি যুদ্ধ করছেন এই দেশের জন্য। আমাকে জানতে হবে কে পাঠিয়েছে শাহজাহান চাচাকে যুদ্ধ করতে। সাদিক বললো, চাচী। চমকে উঠলো মা ও মেয়ে। সাদিক বললো আমি বাঙালী আমদির পাড়া গ্রামের সাদেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের ছেলে। আমার নাম সাদিক। আমি এসেছি আপনাদের খোঁজখবর নিতে। আপনারা কেমন আছেন? শাহজাহানের স্ত্রী বললো বাবা দেখছোই তো আমরা কেমন আছি। চোখের পানি ছলছল করছে। সাদিক বললো বুঝলাম তবে আপনি বলেন তো শাহজাহান চাচাকে যুদ্ধে কে পাঠিয়েছে? শাহজাহান চাচার স্ত্রী চাচার মায়ের ছবি এনে দেখালো এবং বললো এই মহিলা। সাদিক বললো ইনি তো চাচার মা। চাচী বললো হ্যাঁ বাবা তার আদরের সস্তান শাহজাহানকে তার মা-ই যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। এই দেশ থেকে শয়তান পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে দিতে। আজও আমার শাশুড়ী বারান্দায় বসে থাকে বিজয়ের পতাকা নিয়ে কখন তার খোকা আসবে ফিরে। হঠাৎ সাদিক পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো শাহজাহান চাচার মা নতুন একটা শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে। সাদিককে চাচার মা বললো আমরা ভালো আছি শাহজাহানকে বলবে। আমাদের মনটা তাকে দেখার জন্য ব্যকুল। কিন্তু খালি হাতে না বিজয়ের পতাকা হাতে আমি আমার সন্তানকে দেখতে চাই বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সাদিক চোখের পানি মুছে কাঁপা গলায় বললো ঠিক আছে আমি বলবো। তবে শাহজাহান চাচা চাঁদনীকে নিয়ে যেতে বলেছে। মা চাঁদনীকে বললো মা চাঁদনী তোর বাবা তোকে যেতে বলেছে। তুই কী যাবি? গেলে যা। চাঁদনী বললো হ্যাঁ আমি যাবো বাবার কাছে।
রওনা হলো চাঁদনী আর সাদিক। রাস্তার মধ্যে চাঁদনী সাদিককে বললো জানো আমার মা আর দাদী রাতে ঘুম আসে না এক মিনিটের জন্য। তারা বারান্দায় বসে থাকে কবে আসবে কখন আসবে বাবা। লাল সবুজ রঙের সেই পতাকা নিয়ে। দাদী নামাজে বসে রোজ বাবার জন্য দোয়া করে। বাবারা যেন যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে হানাদারদের হাত থেকে আমাদের সোনার বাংলাদেশ। সাদিক বললো জানো তোমার মা-বাবার তুলনা হয় না। এই কথা বলতেই চাঁদনীর পায়ে কাঁটা ফুটে যায়। এবং চাঁদনী ওখানে পড়ে যায়। সাদিক অনেক কষ্টে চাঁদনীর পায়ের কাঁটা বের করলো। তারপর সাদিকের গেঞ্জি ছিড়ে চাঁদনীর পায়ে বেধে দিলো। সাদিকের দিকে তাকিয়ে আছে চাঁদনী। সাদিককে দেখতে তো ফুটন্ত গোলাপের মতো দেখা যায়। সাদিক সুন্দর, চাঁদনীও সুন্দরী। সাদিকও তাকিয়ে আছে চাঁদনীর দিকে। চাঁদনী বললো তুমি কোন শ্রেণিতে পড়ো? সাদিক বললো পঞ্চম শ্রেণিতে। আর তুমি? আমিও পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। হঠাৎ সাদিকের মনে হলো আমাকে তো তাড়াতাড়ি যেতে হবে। খবর আনতে হবে পাকস্তানিরা আজ কোথায় আক্রমণ করবে? কচুয়া প্রাইমারি স্কুলের সামনে এসে গেলো তারা। সাদিক চাঁদনীকে বললো আমরা এসে গিয়েছি তোমার বাবার আস্তানায়। চাঁদনী খুশি হয়ে দৌড়ে গেলো তার বাবার কাছে। শাহজাহান চাঁদনীকে দেখে অবাক হয়ে বললো মা রে তুই কেমন আছিস? চাঁদনী বললো আমরা ভালো আছি। সাদিক সব কিছু শাহজাহানকে বললো। সব শুনে শাহজাহানের দু চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। শাহজাহানের পাশে থাকা ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শুনছে শাহজাহানের মায়ের, স্ত্রীর বলা কথাগুলো। সবার চোখ দিয়ে পানি দিয়ে ভরে য়ায়। তখন শাহজাহান বললো শুনো তোমরা, আজ আর আমরা কাঁদবো না। এবার শুরু হবে সেই যুদ্ধ। মুক্তির যুদ্ধ । তোমরা কী বলো? সবাই বললো হ্যাঁ। তাই হবে, আমরা রাজি। শাহজাহান খুশি হয়ে বললো চাঁদনীকে বাড়ি পৌছে দিতে। তাই করলো সাদিক। শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। কৃষক, মজুর, ছাত্র, শিক, তরুন, প্রবীণ, গৃহিণী, কর্মচারী সকলেই রাস্তায় নেমে পড়লো সেøাগান নিয়ে। জয় বাংলা বাংলার জয় সর্বত্র বাতাসে মিশ্রিত হলো। এক সত্য এককথা সবাই বলছে চাই বাংলার স্বাধীনতা। আমাদের মহামানব মহান নেতা, জাতির পিতা স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। কোকিল কন্ঠস্বরে বললেন- তোমাদের যা কিছু আছে নাও হাতে তুলে, তা দিয়েই শত্রু মোকাবেলা করতে হবে। হারাতে হবে পাকিস্তানি বাহিনীদের আমাদের সোনার বাংলাদেশ থেকে। বাংলার যুবক যেন হয়ে উঠলো দামাল। কেউ নিলো ঝাড়ু, লাঠি অনেক কিছু নিলো সাথে কোদাল। বলছে তারা আমরা বাংলার যুবক দামাল, হানাদাররা থাকবে না আর আগামীকাল। এই ভাষণ শুনে সাদেক শাহজাহানদের বাহিনী বাঘের মতো গর্জে উঠলো আমরা স্বাধীন করে ছাড়বো আমাদের সোনার বাংলাদেশকে। সারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা জেগে উঠলো। আজকের যুদ্ধ হবে শেষ যুদ্ধ। সাদিক আজ গিয়েছে মধুপুর ক্যাম্পে তাদের খোজ আনতে। সেখানে পৌছতে তার রাত হয়ে গেলো। সেখান থেকে সে তথ্য নিচ্ছে অমনী হঠাৎ চারদিক থেকে গুলি ছুটছে। সাদিক ভয়ের মধ্যে পড়ে যায়। ক্যাম্পের কমান্ডার মুনতাজ মুক্তিযোদ্ধাদের বললো তোমরা জীবনের আশা করো না। আজ রা নয় প্রাণ, রা করবো দেশটাকে। গোলাগুলি করে জয় করলো মধুপুর এলাকা। সাদিক এই সব লেখে চিঠি নিয়ে যাচ্ছে মুনতাজের কাছ থেকে । আধার রাত তখন বাজে ঠিক বারোটা। সাদিক আস্তে আস্তে আসছে। ভয়ে ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানায় এসে গেলো। সেখানে কারো সাথে তার দেখা হলো না। তারা সবাই যুদ্ধ করছে। সাদিক বাইরে বের হতে পারছে না। চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। সাদিক কিছুণ চুপ করে বসে থাকলো। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো কে যেন। বাম দিকে কুদ্দুছদের বাড়ি কুদ্দুছ বলে ডাকছে। সাদিক মনে করলো হয়তো শহিদ হয়েছে। আসলে তাই। ডান পাশে কুদ্দুছের চাচার বাড়ি। ঐখান থেকে কটকট হাসির শব্দ শুনা যাচ্ছে। হাসছিলো কদ্দুছের দাদী। কারণ তার ছেলে খয়বর ছিলো একজন রাজাকার। দেশের প্রতি ছিলো না তার একটুও ভালোবাসা। দাদী বলছে তুই দেশের সঙ্গে তোর মাতৃভুমির সঙ্গে বেঈমানি করেছিস । আমি তোর মা হয়ে বলেছিলাম যা তুই দেশের জন্য লড়াই কর, রা কর তোর মাতৃভুমি। আর তুই হলি রাজাকার। এই কথাগুলো শুনছে সাদিক আর ভাবছে তার মায়ের কথা। মা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তাকেও বলতো। যা বাবা সাদিক তোর মাতৃভুমি রা কর। চোখ দিয়ে ঝর্ণার মতো পানি ঝরছে সাদিকের। আজ কেন জানি মনে পড়ছে তার মায়ের কথা। কুদ্দুসের দাদী সবশেষে বললো তোর এই অপবিত্র গায়ে আমি স্পর্শ করবো না। আমি হাত দেবই না। তোকে খাবে বাংলার কুত্তা-শকুনেরা। মা চোখ মুছে বললো আমি আমার নাতীর কাছে যাবো। সাদিক অবাক হয়ে গেলো। এদিকে ৩৭ জন নিয়ে যুদ্ধ করছে সাদেক আর শাহজাহান ২৫০জন পাকিস্তানিদের সাথে। এর মধ্যে মারা গেলো পাকিস্তানির ১৫০ জন আর শহিদ হলো বাঙ্গালীর মাত্র ৫ জন। সাদেক এক হাত দিয়েই যুদ্ধ করছে। শাহজাহানের মনে একটু ভয় হলো। পাকিস্তানিরা আরো একশত জনের মতো আছে। আর আমরা মাত্র ৩২ জন। হারুন কাউকে না বলে গেলো মুনতাজের কাছে মধুপুর। গিয়ে বললো তাদের সাহায্যের প্রয়োজন এই ক্যাম্পে। মুনতাজ তার বাহিনীদের নিয়ে ছুটলো কচুয়া। তারা সবাই যুদ্ধ শুরু করলো হারুন সহ। এক সময় শহিদ হলো হারুন আরো কয়েক জন। পাকিস্তানিদের আরো মারা গেলো ৫০ জন। তখনো পাকিস্তানিরা যুদ্ধ বন্ধ করেনি। কচুয়া স্কুল মাঠ হয়েছে রক্তের নদী। সাদিক জানালা দিয়ে দেখছে কাউকে চেনা যাচ্ছে না। সাদিকের মনে হলো হঠাৎ চাঁদনীর কথা। আবার ভাবছে ধুৎ আমি কেন এই সব ভাবছি। আমি তো কেবল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন আমি বড় হবো। পড়াশুনা করবো তখন বুঝা যাবে কী করবো। আজ রাত অন্ধকার। চারদিকে ধূ ধূ করছে মায়ের কান্না, বাবার কান্না আর গুলির শব্দ ছাড়া চারদিকে যেন আর কিছুই শুনা যাচ্ছে না। শাহজাহান সাদিকের সামনে থেকে যুদ্ধ করছে। শাহজাহানের পাশেই ছিলো সাদেক। তাকেও চেনা যাচ্ছে না। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন আত্মসমর্পণ করবে। হঠাৎ তার সহযোগী পাকিস্তানি গুলি করবে সাদেককে, দেখে ফেলে সাদিক। আকাশের ঝলকানিতে তার আলোয় দেখলো সাদিক। তার বাবা তো এটাই, হাত নেই একটা। সাদিক দৌড়ে এসে ধাক্কা দেয় বাবাকে আর অমনি বুকটা পেতে দেয় সাদিক। পাকিস্তানি সাদিকের উপর গুলি চালালো। তিনবার গুলি করলো। আবারও রুখে দাড়ালো শাহজাহান, সাদেক বাহিনী আর মুনতাজের বাহিনী। ধ্বংশ করে দিলো পাকিস্তানিদের। তারপর তাদের মুক্তিবাহিনী দল ছুটে এলো সাদিকের কাছে। হারুনের মৃতদেহের পাশে। সাদিক মৃত্যু সয্যায় চোখ দুটো মেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। শুনছে বিজয়ের বাজনা। সাদেক চোখের পানি ঝরাচ্ছে পানির ফোঁটা সাদিকের গায়ে পড়ছে। সাদিক রক্তমাখা মুখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো বাবা তুমি কাঁদো কেন? আজ তো কাঁদার দিন নয়। আজ আনন্দের দিন। বাবা তুমি আর কান্না করো না। আমি তো দেশের জন্য প্রাণ দিলাম। বাবা কাঁদে আর বলে সাদিক তুই আমাকে কেন বাচালি? আমিই মরে যেতাম দেশের জন্য। সাদিক বললো বাবা তোমার নাম তো আছে মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডারের খাতায়। আমার নাম নাই কোথাও আমি প্রাণ দিয়ে শহিদের খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় আমার নাম লেখাতে চাই। এই প্রথম বারো বছরের একটা শিশু দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। শাহজাহান, সাদেক, মুনতাজ এবং তাদের সহপাঠীরা কাঁদছে আর চোখের পানি পড়ছে কচুয়া প্রাইমারি স্কুল মাঠে। দূর থেকে সুমধুর কন্ঠে মিছিল আসছে শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এই মিছিলে আছে শাহজাহানের মেয়ে চাঁদনী, স্ত্রী, তার মা অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের আপনজনেরা। তারা সবাই সেøাগান দিচ্ছে জয় বাংলা, বাংলার জয়। মিছিল এলো স্কুল মাঠে। এসে দেখলো এখানে কোনো আনন্দ ফুর্তি হচ্ছে না। প্রাইমারি স্কুল মাঠে এসে থেমে গেলো তারা। সাদিকের কাছে এলো সবাই। শাহজাহানের মা এসে বললো সাদিক বাবা তুমি এমন করছো কেন? সাদিক বললো দাদীগো ও বাবা গো আমাকে একটু তুলে বসাও। আমি দেখতে চাই বাংলার মানুষদের তারা কেমন করে জয়ের আনন্দ করছে। সাদিককে তুলে বসানো হলো। সে দেখলো চাঁদনীও কাঁদছে। সে তার পকেট থেকে নিজের হাতে আঁকা লাল সবুজ রঙের পতাকা বের করে চাঁদনীকে দিলো। দিয়ে বললো পতাকাটা তোমার কাছে রেখো সবসময়। শেষে পকেট থেকে সাদিক একটা চিঠি বের করলো। সবাই তাকিয়ে আছে চিঠির দিকে। সাদিক বললো বাবা এটাই আমার শেষ চিঠি। এতে লেখা আছে আমার দেশের বেঈমান রাজাকারদের নাম। বাবা চিঠি হাতে নিয়ে কাঁদছে। সাদিক বললো বাবা তুমি আর কেঁদো না। আমি তোমার একা সন্তান না। সারা দেশের দামালরা এবং শিশু যারা তারা সবাই তোমার সন্তান। আমি তোমাদের ল ল বার সালাম করি। সালাম জানাই জাতীয় পতাকাকে। তখন হাজার হাজার মিছিলের লোক এক সাথে সাদিককে সালাম দিলো। অমনি সাদিক চলে গেলো এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে। সাদিকের লাশটা শ্রদ্ধার সাথে দাফন করা হলো ঐ স্কুল মাঠেই। এখনো আমরা সবাই বিশ্বাস করি সাদিকের মতো দেশপ্রেমিক আছে সোনার বাংলাদেশে। ও আমাদের দেশ সোনার বাংলাদেশ তোমাকে জানাই হাজার হাজার বার সালাম। তোমাকে নিয়ে লেখা কেউ করতে পারবে না শেষ। ও আমার সোনার বাংলাদেশ।
আল্লাহ হাফেজ।