কোন কারণে খুন? আবদুল আলী হত্যাকান্ড
ছামির মাহমুদঃ সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পাথরব্যবসায়ী আবদুল আলী হত্যার মূল আসামি গ্রেফতার হয়ে আদালতে জবানবন্দি দিলেও হত্যার কারণ আর পেছনে কারা এ নিয়ে রহস্য কাটছে না। কোন কারণে খুন? এ প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে। এনিয়ে চলছে না জল্পনা কল্পনা। মামলার এজহারে হত্যা পরিকল্পনা করা হয় বলে একজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম উল্লেখ করে আরও আটজনের নাম রয়েছে। আবার মামলায় পরিকল্পনাকারীদের আসামিও করা হয়নি। মূল আসামি অবিশ্বাস্য রকম দ্রুততার সঙ্গে আটক ও পরবর্তী সময়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির সময় পর্যবেক্ষন করে প্রশ্ন ওঠছে। জবানবন্দিতে আলফু বলেছেন, হত্যার পর তাকে ফোন করে বলা হয়। বর্ণনায় পরিকল্পনার কথাও আছে। জবানবন্দি আর মামলার এজহার কি তাহলে এক হাতে লেখা?
এই যোগসূত্র বিশ্লেষণ করে কোম্পানীগঞ্জে চাঞ্চল্য থামছে না। কোন কারণে খুন? খুনের পেছনে কারা? প্রশাসনের কেউ এই হত্যাকান্ডের পেছনে রয়েছে কি না, এ প্রশ্নে তোলপাড় চলছে সর্বত্র।
আবদুল আলী হত্যার পরিকল্পনা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এক এডভোকেটের চেম্বারে বসে হয়েছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই এডভোকেট হচ্ছেন, জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক মাহফুজুর রহমান। আবদুল আলী খুনের পরিকল্পনাকারীর তালিকায় আছেন কোম্পানীগঞ্জের পাড়–য়া গ্রামের পাথর ব্যবসায়ী শামীম, রফিক, ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াদুদ আলফু মিয়া, আকদ্দছ আলী, আলী হোসেন, বর্ণি গ্রামের এডভোকেট টিপু, শামীমের সহযোগি সফিক মেম্বার,এডভোকেট আজমল হোসেন। এরা দুইদফা বৈঠক করেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এই নয়জনের নাম হত্যার পরিকল্পনাকারী বলে এজাহারে উল্লেখ করা হলেও এদেরকে হত্যা মামলার আসামি না করায় এ নিয়ে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন মামলার এজহার হত্যার পরিকল্পনকারী হিসেবে এডভোকেটসহ নয়জনের নাম উল্লেখের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের আসামি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি তদন্তনাধীন বলে তিনি এড়িয়ে যান।
এজহারে বর্ণিত হত্যা পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা নেতা এডভোকেট মাহফুজুর বলেন, পেশাগত ও রাজনৈতিকভাবে হেনেস্তা করতেই এ অভিযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আবদুল আলী কাচা টাকার মালিক। কাজে-অকাজে টাকা খরচ করতেন। পাথর কোয়ারিতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ঘুষও দিতেন। এসব খবর সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে। আমার জানা মতে তার (আবদুল আলী) বিরুদ্ধে হত্যা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ঘটনার অন্তত ৩২টি মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলা পরিচালনা করতে আমার কাছ থেকে কোনো অবৈধ সুবিধা না পেয়ে হয়তো তার পরিবার আমার নাম জড়িয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আবদুল আলীকে গুলি ও বল্লম দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন পালানোর সময় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ.লীগের সদস্য কাজী আবদুল ওদুদ ওরফে আলফু মিয়াকে আটক করে পুলিশ। আলফু মিয়া ওই দিনই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ওই রাতেই নিহত আবদুল আলীর স্ত্রী হালিমা বেগম বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় লিখিত এজাহার দাখিল করেন। এতে হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত ৩১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এজাহারভুক্ত আসামিরা হচ্ছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিলাজোড় গ্রামের কাজী আবদুল ওয়াদুদ আলফু মিয়া (৪৪), গৌখালের পাড়ের আকদ্দছ আলী (৩৪), আলী হোসেন (২৮), আলী বক্স (২৪), কাছিম আলী (৪২), কাছাব আলী (৪০), আতাবুর রহমান (৫২), সফিক মিয়া (৩২), রুস্তম আলী (৩৫), নূরুল ইসলাম (৪৩), মোশাহিদ আলী (৩৬), আলীরাজ (২২), আলী আব্বাস (২৫), মোছব্বির আলী (৩৮), মসলিম (৩১), বুড়িডহর গ্রামের আবদুল হাই গাজী (৪০), বুড়দেও গ্রামের মহন (৩২), কোম্পানীগঞ্জ গ্রামের জমির আলী (৪৫), আলী আহমদ (৫৫), গৌখালের পাড়ের কামাল (২৮), সোয়েদ (২৭), আলাল (৩২), দক্ষিণ বুড়দেও গ্রামের রহিম আলী (২৭), গৌখালের পাড়ের আবদুল মজিদ (৪১), হেলাল (২৮), দলইর গাঁও’র সফিক মেম্বার (৫০), গৌখালের পাড়ের ওয়াস কুরুনি (২৪), দুদু মিয়া (৩০), ফজর আলী (২৮), দিলাল (২২)।
এরমধ্যে প্রধান আসামি আলফু মিয়া। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে জানান। তবে হত্যার আগে ও পর তাকে মোবাইলফোনে খুনিরা সরাসরি ঘটনা জানিয়েছে বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। মামলার এজাহারে হত্যার কারণ পাথর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও ঠিকাদারি কাজে বাধার দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। হত্যার আগে সিলেট আ.লীগ নেতা মাহফুজুর রহমানের চেম্বারে এক দফা ও পরে অভিজাত একটি রেস্তুরায় বসে পরিকল্পনা হয়। এ বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিলেন এ বিষয়ে কোনো বর্ণনা নেই। তবে আবদুল আলীর সঙ্গে আ.লীগের নেতা মাহফুজ, আকদ্দছ আলী (নিহতের ভগ্নিপতি)সহ আরও সাতজনের বিরোধ রয়েছে বলে তাঁদের নাম হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে পাথর ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আবদুল আলী বোমা মেশিন বাণিজ্যের জন্য পরিচিত ছিলেন। কোম্পানীগঞ্জের সাবেক এক ইউএনও স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও আলোচিত হয়েছিলেন। ঘুষ দিয়েও কাজ না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে আবদুল আলী এ বিষয়টি নিজেই ফাঁস করে দিলে এ নিয়ে গত ১২ জুলাই একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘ইউএনওর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে পাথর ব্যবসায়ীর ৩০ লাখ টাকা/ বোমা মেশিন চালাতে ঘুষ?’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল।
সুত্র মতে, ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন যে, ‘যদি আমার নামও চলে আসে’। যারা আবদুল আলীর কাছ থেকে নিয়মিত বখরা নিতেন তারা নিজেকে রক্ষা করতে এই খুনের পেছনে মদদদাতা হিসেবে থাকতে পারেন বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করছেন।
আরেকটি সূত্র জানায়, আলফুকে যে স্থান থেকে ধরা হয়, তার সঙ্গে আ.লীগের একটি দলও ছিল। তারা সবাই ছিল, জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে এক সরকারদলীয় এমপির বাসায়। গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যে আসামিদের আশ্রয়স্থল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ওই এমপির আস্থাভাজনেরা হত্যাকান্ড পরবর্তী অবস্থা ভিন্নখাতে প্রবাহে ভূমিকা রাখছে কি নাএ নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন।