গোলাম আযমের স্বাধীনতাবিরোধিতার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল : শিবির
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে মনে করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
গোলাম আযমের মৃত্যুর পর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রশিবির জানায়, ‘এ সিদ্ধান্ত (১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা) তাকে রাজনৈতিকভাবেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ব্যক্তিগতভাবেও তাকে এর জন্য দায়মোচন করতে হয়েছে।’
‘গোলাম আযম সাহেবের সঠিক জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশের অনুরোধ করছি’ শিরোনামে ছাত্রশিবিরের সহকারী প্রচার সম্পাদক মো. জামাল উদ্দিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন।
জামায়াতের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে পরিচিত গোলাম আযম মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড ভোগকালে গত বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ছাত্রশিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘তিন দিক থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা ভারতের শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকার কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গোলাম আযম স্বাধীনতার বিরোধিতা করার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, এ সিদ্ধান্ত তাকে রাজনৈতিকভাবেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ব্যক্তিগতভাবেও তাকে এর জন্য দায়মোচন করতে হয়েছে।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা উল্লেখ করেছে, ‘ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) মুক্তিযুদ্ধকালীন কোনো অপরাধে গোলাম আযম সরাসরি জড়িত নয় বলে স্বীকার করলেও ‘সুপ্রিম কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায়ে তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।’
‘আদালত মনে করেছিলেন, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে তিনি ও তার দল জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য দায়মোচনে বাধ্য।’
‘এর ফলে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই অধ্যাপক আযমের বিরুদ্ধে আদালত দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলে দণ্ড ভোগকালে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তিনি এখানে বন্দি ছিলেন।’
দণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম আযমকে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত উল্লেখ করে ছাত্রশিবির লিখেছে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এক পরিচিত নাম অধ্যাপক গোলাম আযম। জীবনের প্রথম দিকে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত হিসেবে স্মরণীয় হলেও শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কারাদণ্ড ভোগ করেছেন।’
জামায়াতের সাবেক এ শীর্ষ নেতার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে ছাত্রশিবির লিখেছে, ‘বৃটিশ উপনিবেশের বিদায়লগ্নে সংস্কৃতি আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পূর্ব বাংলার জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় জড়িয়ে পড়া অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর জিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখায় সবার উপরে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে দেওয়া স্মারকলিপি পাঠ করে ভাষাসৈনিক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন গোলাম আযম।’
গোলাম আযমের ব্যক্তিগত পরিচিতির বিষয়ে ছাত্রশিবিরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- ‘১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর (বাংলা ১৩২৯ সালের ৫ অগ্রহায়ণ) সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের শাহ সাহেব বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন গোলাম আযম। তার নানা শাহ সৈয়দ আব্দুল মোনায়েম শাহ সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন।
গোলাম কবির ও সৈয়দা আশরাফুন্নিসার সন্তান গোলাম আযমের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বিরগাঁও গ্রামে। তবে ঢাকার বড় মগবাজারের কাজী অফিস লেনের বাড়িতেই দীর্ঘদিন ধরে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন।
তার পূর্বপুরুষ শায়খ জাকি (র.) মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে বাংলাদেশে আসেন এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় বসবাস করেন। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা গোলাম আযম বিরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় লেখাপড়া শুরু করলেও একটি মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকার সরকারি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান কবি নজরুল কলেজ) থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ ও এম এ পাস করেন।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও লেখা হয়েছে, ‘১৯৫১ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করার পর থেকে তাবলীগ জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে বক্তব্য তুলে ধরতেন গোলাম আযম। ১৯৫৪ সালে সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ইসলাম প্রচার, ইসলামী রাজনীতি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করা গোলাম আযম ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খান মৌলবাদী ধর্মীয় কাজকর্মের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও গোলাম আযম দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন। তাকে আট মাস আটক রাখা হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির (সভাপতি) পদে অধিষ্ঠিত হন।’
গোলাম আযমের বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতির শীর্ষপদে আসীন হওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের নভেম্বর থেকে গোলাম আযম পাকিস্তানে থাকলেও ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফেরেন। জেনারেল এরশাদের সময় দেশে রাজনৈতিক দৈন্যদশা দেখা দিলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুপরেখা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে তাকে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর আমির ঘোষণা করা হলে দেশে ব্যাপক আন্দোলন দেখা দেয়। তবুও ২০০০ সাল পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন। রাজনীতির বাইরে শতাধিক বইও লিখেছেন গোলাম আযম।’