নিজ দায়িত্বে চলুন : দায়িত্বশীল লোকের অভাব
মীর আব্দুল আলীমঃ দেশে সড়ক, নৌ ও রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। রোধ হচ্ছে না। চোখের সামনে প্রতিদিনই তরতাজা মানুষগুলো লাশ হয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত হচ্ছে আমাদের নদ-নদী আর পিচঢালা পথ। যেন এত লাশ বহনে অপারগ হয়ে পড়েছে নদী আর সড়ক-মহাসড়ক গুলো। সব দুর্ঘটনাই দুখ্যজনক। সকলের মৃত্যুই আমাদের কষ্ট দেয়। কিন্তু কিছু মৃত্যু আছে যা মনে দোলা দেয়। ভোলা যায় না। হৃদয়ের গভীরে দাগকাটে। নাটোর বড়াইগ্রামের রেজুর মোড়ে ২০ অক্টোবর কেয়া পরিবহন একটি ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে অথৈ পরিবহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ৩৩ জন মারা গেছেন। এক লাশের ওপর পড়ে আছে আরেক লাশ। এক সঙ্গে এত লাশ কখনও দেখেনি বড়াইগ্রামের মানুষ। প্রশ্ন জাগে, জীবন কি এমনই? এতটাই তুচ্ছ? মানুষের জীবনের কি একদন্ডও নিরাপত্তা নেই? সবই কি মূল্যহীন? তাই যদি হয় তবে সড়কে এত লাশ কেন? হঠাৎ করে আচনক দানবীয় গতিতে দু’টি যাত্রীবাহী বাস মাখমুখি হয়। মুহুর্তে ঝড়ে যায় এসব তাজা প্রাণ। একি দুর্ঘটনা না কী হত্যাকান্ড !
আমরা মনে করি এসব দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ, মন্ত্রনালয় তথা সরকার দায়ী। এ ব্যাপারে তারা উদাসিন। তাই যা হবার তাই হয়। অতএব যাত্রীসকল হুশিয়ার সাবধান! নিজ দায়িত্ব রাস্তা কিংবা নদী পথ পাড়ি দিন। নইলে ডুবে গিয়ে, মরে গিয়েও কিন্ত আপনাদের নিস্তার নেই। সরকারের প থেকে বলা হবে, কিংবা মন্ত্রী বাহাদুর বলবেন, যাত্রীরার দৌড় ঝাপ দেয়ায় লঞ্চ ডুবে গেছে। উল্টো নিজেরাই নিজের দোষে মরেছেন এই দায় চাঁপবে আপনার উপর। তখন কি হবে? আতœহত্যার দায় নিয়েই আপনাকে দুনিয়া ছাড়তে হবে। এর আগে সর্বশেষ পিনাক-৬ যখন ডুবলো, দু’ শতাধিক মানুষের যখন প্রাণ গেলো, অনেকের লাশও খোঁজে পাওয়া গেল না তখন কিন্তু যাত্রীদের উপরই দায় চাপানো হয়েছে। দোষ সব যাত্রীদের আর দায় ছিলো খোদার এমন অবস্থা! মহান সংসদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন প্রকৃতির বৈরিতার কারনেই নাকি ঐ লঞ্চটি ডুবি হয়েছে। আর নিহতদের উদ্ধারও করা যায়নি প্রকৃতির কারনে। বলিহারি সব কথাবার্তায় জীবন ত্যাগের পরও আপনার বিদায়ী আতœার শান্তি মিলবে না এ কথা হলফ করে বলা যায়।
এদেশে দায় নেয়ার দায়িত্বশীল লোকের বড় অভাব। কেউ কখনো কোন ঘটনার দায় নিতে চান না। এখন অতীত নিকটের দণি কোরিয়ার একটি ফেরিডুবির ঘটনার উদাহরণ না টানলেই নয়। সাগর উপকূলে ফেরিডুবির ঘটনায় দণি কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চাং হং-উন ফেরিডুবি রোধে ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় এ ধরনের পদত্যাগের উদাহরণ প্রচুর, কিন্তু বাংলাদেশে এ রকম ঘটনা বিরল। কেউ কখনো দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন মনে পড়েনা। পদত্যাগের সময় দণি কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ফেরিডুবির পর ১০ দিনেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু যাঁরা এখনো তাঁদের হারানো স্বজনদের খুঁজে পাননি, তাঁদের কান্নায় আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।’ কতটা গণতন্ত্রমনা হলে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতে পারেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তাঁর পদত্যাগ জবাবদিহির একটি নতুন সোপান রচনা করল। ওই ফেরি দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়, আরও শতাধিক নিখোঁজ। এ ঘটনায় ফেরির পাইলট ও আরও ১৪ জন ক্রু গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। আরও বেশি যাত্রী আটানোর জন্য ওই ফেরির মূল কাঠামো পরিবর্তন করার অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে ফেরির ভারসাম্য সরে গিয়েছিল ও এ কারণে এতে যাতায়াত অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়। সে েেত্র একে সাদামাটা দুর্ঘটনা বলা চলে না, এটি ছিল মানুষের সৃষ্ট মর্মান্তিক ঘটনা। এঘটনায় দ:কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কতটা দায়ি? তবু তিনি বলেছেন ‘আমি ব্যর্থ’। দেশের জনগণকে রা করতে না পারার দায় নাকি তারই। কোথায় আমরা; কোথায় ওরা?
মোদ্দা কথা হলো, নিজ দায়িত্বে বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে চড়বেন না আর দুর্ঘটনায় মরবেন আপনি, এ দায়িত্বও কেউ নেবে না। আপনার মহা মূল্যবান লাশটাও উদ্ধার করা যাবে না এটা কোন মঘের মুল্লুক? এখনও শনাক্ত হয়নি পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ নামীয় লঞ্চটি। আজঅব্ধি খোঁজ মেলেনি আটকে পড়া হত্যভাগ্য মানুষের। আমরা দেখেছি সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা সব ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে নিয়োজিত হলেও ডুবে যাওয়া লঞ্চটি অধরাই থেকে গেল। আর মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চডুবির আট দিন পরও নৌযানটির অবস্থান যখন শনাক্ত হলো না, তখন উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে প্রশাসন। আমরা মনে করি, এ পরিস্থিতি এবং লঞ্চ উদ্ধার না হওয়া দুঃখজনক। পিনাক-৬ উদ্ধার না করেই উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ করায় সরকারের অমতাই প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন।
রাষ্টের লোকজন একই ঘটনায় হরেদরে মরবে আর প্রতিকার হবে না তা কি করে হয়। এ দায়তো সরকারেরই। সরকার ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা কমছে না কেন? সরকদুর্ঘটনা রোধে সরকোরে বড় ধরনের কোন পদপে আমাদের চোখে পরছে কি? এ অপরাধের আইনিতৎপরতাও নেই। বড় ধরনের কোন ঘটনায় কেবল সরকারের হাপিত্তেশ শুনি। হম্বিতম্বি মার্কা বক্তব্য দেন মন্ত্রীমহোদয়গণ। ছুটে যান লাশের পাশে। এক সময় ভাবনায় ছিল সরকারের মন্ত্রী আমলারা কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় কখনো মারা গেলে হয়তো আমাদেও সড়ক নিরাপদ হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সঠিক পদপে নেবে সরকার। প্রায়ত মন্ত্রী সাইফুর রহমান, সরকারের কজন সচিব আমলা, নাট্যব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকসহ অনেক গুনিজন একে একে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেও দুর্ঘূটনা রোধে পদপে কৈ ? আমরাও কম কোথায়? আমরা হরতাল জ্বালাও পোড়াও মার্কা আন্দোলন করতে পারি কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কোন আন্দোলনতো কখনো কেউ করেছি বলে তো মনে পওে না। আন্দোলন বলতে নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের “ নিরাপদ সড়ক চাই” এ পর্যন্তই সিমাবদ্ধ। গত ২১ বছরেও নিরাপদ সড়কের জন্য নড়ে বেচারা কাঞ্চন কিছুই করতে পারেননি। আল্লাহ মাফ করুক কখনই যেন তা না হয়। সরকারে সংশ্লিষ্ট কোন মন্ত্রীর আদুরে দুলাল কিংবা স্বজন মারা গেলে হয়তো কিছু একটা হবে। আবার তাতেও বিশ্বাস রাখতে পারিনা। সে েেত্রও বোধ করি সরকার যন্ত্রেরএ টনক নড়বে না। তা হলে উপায় কি? আল্লাহই শেষ ভরসা। আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে যাচ্ছে এমন শান্তনা নিয়েই আমাদের বেঁচে হবে; চলতে হবে পথে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। মানুষ মরছে অস্বভাবিক গতিতে। মৃত্যুও মিছিলে কেবল লাশ বাড়ছে তো বাড়ছেই। আপনজনেরা মরছে নেশাগ্রস্ত বেপরোয়া চালকদের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে। খাদে পরে মরছে মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকে। নির্বিচারে চলছে এধরনে হত্যাকান্ড। আর তা চালিয়ে দেয়া হচ্ছে নিছক দুর্ঘটনা বলে। এ হত্যাকান্ডের যেন কোনই বিচার নেই। মানুষ মরবে আর এর কোনই বিচার হবে না; তা কি করে হয় ? প্রশ্ন হলো এসব রুখতে হবে? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারো কাছেই কাম্য নয়।
দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে আটজন প্রাণ হারাচ্ছেন। আর বছরে তির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। শুধু গত এক যুগেই বাংলাদেশে ৪৪ হাজার ৭৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। ২০০১ সাল থেকে এ বছর জুলাই মাস পর্যন্ত এসব দুর্ঘটনায় মোট ৫৫ হাজার ৮৬২ জন নিহত হন। কেবল ২০১৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এক হাজার ৩৩ জন। পুলিশ বিভাগের রেকর্ডপত্র থেকে আরো জানা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ২২৬ জন মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন একই কারণে। সড়ক দুর্ঘটনার মাশুল দিতে গিযে প্রতি বছর বাংলাদেশের তির পরিমাণ সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটা আমাদের দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির দেড় শতাংশ। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ৫৪ শতাংশই ঘটে যানবাহনের ধাক্কায়। তা ছাড়া দু’টি যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ শতাংশ, একটি অন্যটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ায় ১১ শতাংশ এবং গাড়ি উল্টে যাওয়ায় ৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে মোট মৃত্যুর ৮৫ শতাংশই ঘটে থাকে এই চার কারণে। গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও খোদ একজন মন্ত্রী পরিবহন শ্রমিক নেতা রূপে ২৪ হাজার শ্রমিককে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সুপারিশ করেন, যাদের পরীাই নেয়া হয়নি। তদুপরি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিও কঠোর নয়। সড়ক দুর্ঘটনাকে নরহত্যা হিসেবে গণ্য করে দায়ী চালকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার আইন করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে সরকার সে আইন সংশোধন করে। এখন চালকের ভুলে দুর্ঘটনা হলে এক থেকে তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। এ আইনটি খুবই দুর্বল। দীর্ঘদিনের নাগরিক দাবি আইন সংশোধন করে শাস্তি বাড়ানোর। এবং তা ক্ষেত্র বিশেষ মোবাইল কোর্টে বসিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। আইনটি যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে একটি কমিটি করেছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। খসড়াও হয়। কিন্তু এখনো খসড়াটি গত ৭ বছরেও আইনে পরিণত হয়নি। প্রশ্ন হলো আইন না হলে, শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে দুর্ঘটনা রোধ হবে না কখনো। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ল্েয কর্তৃপরে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কাজীর গরুর মতো কেতাবি হয়ে থাকায় তা কোনো কাজে আসছে না। যেমন, ৮০ হাজার অনুপযোগী যান আটক করার ঘোষণা সত্বেও সরকারি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে সিকি শতাব্দী পুরনো ট্রাক এবং ২০ বছরেরও বেশি পুরনো বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। সড়ক মহাসড়কে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই ট্রাক প্রতিহত করা। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে বাধ প্রদানসহ নানা পদেেপর অভাবে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারন অদক্ষ গাড়ি চালক। এ জায়গাটিতে সরকারের দক্ষতা আর নজরদারির বড্ড অভাব আছে বলে মনে করি। চালকের পেশাকে এখনও আমাদের দেশে মর্যাদাপূর্ণ পেশায় রূপ দেয়া যায়নি। সবা আগে দক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়াতে চালকের পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ করতে হবে। পরিবহন চালকদের আয় রোজগার ভালো হলেও এ পেশার শিক্ষত লোকজন আসতে চায় না। কারণ এ পেশার লোকদের অন্য দৃষ্টিতে দেখা হয়। বিয়ে সাদি থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে ড্রাইভারদের মর্যাদা এ সমাজে একটু কমই আছে। তাই এ পেশায় শিক্ষিত লোকজন আসতে চায় না। কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা, অফিসের পিয়ন, কেরানীর চেয়েও ওরা কম মর্যাদা পূর্ণ। ড্রাইভারি পেশায় ভালো অর্থ উপার্যন করা গেলেও মর্যাদা না থাকায় শিক্ষত লোকজন কম বেতনে অফিসের চাকুরি করতে আগ্রহ দেখায়। তাই সরকারকে আগে ড্রাইভারি পেশাকে মর্যাদাপূর্ণ করতে সকল ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। ড্রাইভারি পেশা মর্যাদাপূর্ণ হলে দক্ষ এবং শিক্ষিত চালকের সংখ্যা বাড়বে। তাতে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা রোধ হবে বলে আমরা মনে করি।
(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিষ্ট। [email protected])