জেএমবির নতুন অস্ত্র ‘ইনজেকশন’
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ভয়ঙ্কর খুনের মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবির) ‘কিতাল গ্রুপ’। এদের কেউ কেউ বলে ‘জিহাদুল কতল গ্রুপ’। এদের কাজ কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে টার্গেট ব্যক্তিকে গোপনে হত্যা করা।
এমন একটি কিলার গ্রুপই বুধবার মিরপুরের মনিপুরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ফরহাদ হোসেন ও ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুর রহিমকে ইসলাম বিরোধি ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ প্রযোগ করে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।
তবে পুলিশের চেকপোস্টে বাধা পেয়ে তাদের এই মিশন ব্যর্থ হয়। গত বুধবার ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার জেএমবি সদস্য খোরশেদ আলম রুবেলকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ক্যান্টনম্যান্ট থানায় দায়েরকৃত মামলায় আদারতের নির্দেশে রুবেলকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুবেল পুলিশকে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে। টার্গেট ব্যক্তিদের হত্যা করতে তারা কতল পদ্ধতি (জবাই), গুলি, বোমার পাশাপাশি একটি বিশেষ ধরনের ‘ইনজেকশন’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ ধরনের একটি বিদেশি ইনজেকশন (বিষভর্তি) পুশ করে ১০ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত করা যায় বলে জানিয়েছেন রুবেল।
তাদের দৃষ্টিতে যাদেরকেই ইসলাম বিদ্বেষী মনে হয়, তারাই তাদের টার্গেটে রয়েছে। রুবেল পুলিশকে বলেছেন, ‘মনিপুরি স্কুলের প্রিন্সিপাল ফরহাদ হোসেন ও ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুর রহিম দুজনই ‘নাস্তিক’। তারা ইসলামের শক্র।
এরা দু’জন মিলে মনিপুরি স্কুলে মসজিদের জায়গায় ক্লাসরুম চালায় এবং শিক্ষককে দাড়ি কাটতে নির্দেশ দেয়। নারী শিক্ষককে হিজাব পরতে বাধা দেয়। এ কারনে জেএমবি তাদের হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের বেশ কয়েকবার সতর্ক করা হয়। তবে তারা আমাদের কথা রাখেননি। কয়েকমাস আগে সংগঠনের পক্ষ থেকে সিন্ধান্ত হয় তাদের বাঁচানো যাবে না।’
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হত্যার নতুন পরিকল্পনার বিষয়টি খুবই আতঙ্কের। তবে জঙ্গিদের গ্রেপ্তার অভিযান থেমে নেই। সারাদেশে জোরালো অভিযান অব্যাহত আছে।’
বৃহস্পতিবার রুবেলের মেস থেকে জব্দ করা কম্পিউটার ও জঙ্গি নথিপত্র ঘেঁটে পুলিশ জানতে পেরেছে, জেএমবির ইন্টারনেটের মাধ্যমে দলীয় সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। জেএমবির সদস্যরা ‘প্রটেকটেড টেক্সট’ নামে একটি ওয়েবপেজে মনিপুরি স্কুলের দুই প্রিন্সিপালকে হত্যার কৌশল লিখে রাখে। ওই ওয়েবপেজে লেখা হয়, ‘তোমরা ওইখানে যাবে, ছোট মামাকে (ভাইস প্রিন্সিপাল) আগে শেষ করবা, বড় মামা (প্রিন্সিপাল) থাকলে তাকেও হত্যা করবে।’
রুবেলের তথ্যমতে, অনেক আগে থেকেই মনিপুরি স্কুলের দুই প্রিন্সিপালকেই তারা হত্যার টার্গেট করেন। মনিপুরি স্কলের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল প্রতিদিন সকালে মনিপুরিপাড়া পার্কে হাঁটাহাঁটি করে থাকেন। সেই অনুযায়ী ১৫ দিন ধরে তাদের গতিবিধি অনুসরণ করেন। তাদেরকে ইনজেকশন পুশ করে হত্যা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ কারণে তারা ভোরে ওই পার্কে যাচ্ছিল। রুবেলসহ দলনেতা সোহেল ওরফে রবিন ওরফে মুসাসহ আরো দু’জন ভোরে একটি সিএনজি নিয়ে রমনা পার্কে এসে তাদের ঘনিষ্ট এক জনের কাছ থেকে তিনটি পিস্তল নেন। ফের তারা একই সিএনজিতে মিরপুরের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। তাদের কাছে অস্ত্রের পাশাপাশি বিশেষ ধরনের একটি বিদেশি ইনজেকশন ছিল।
পুলিশ জানায়, বুধবার সকাল ৬টার দিকে মিরপুর ফ্লাইওভারের ওপরে নিয়মিত তল্লাশি চৌকি বসিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এই সময় একটি সিএনজির গতিবিধি দেখে সন্দেহ হয়। থামানোর চেষ্টা করা হলে চালক পুলিশ নির্দেশ অমান্য করে পালানোর চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে অটোরিকশা আরোহী জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এতে আমিনুল ইসলাম (৪৫) নামে এক পথচারী ও এএসআই শফিকুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হন। এক পর্যায়ে সিএনজি আরোহীরা পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ আবারো গুলি চালায়। এই সময় খোরশেদ আলম রুবেল (২৩) নামে এক যুবক আহন হন। অন্যরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ২ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি পিস্তল, এক রাউন্ড গুলির খোসা ও বিষভর্তি দুটি সিরিঞ্জ উদ্ধার করে। পরে আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, পুলিশের তল্লাশির কারণে মনিপুরি স্কুলের দুই প্রিন্সিপালের জীবন রক্ষা পেল। রুবেলকে গ্রেপ্তার করার পর বুধবার বিকেলে তার তথ্যর ভিত্তিতে আব্দুলপুর কোর্টবাড়ি এলাকার রুম্মাম মার্কেটের পাশের মেসের তৃতীয় তলায় বিশেষ অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই ও একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গি রুবেলের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। তার বাবা-মা বেঁচে নেই। তার এক ভাই মিরপুর এলাকায় থাকে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীর উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর, রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যানে জঙ্গিরা নিয়মিত শারীরিক কসরত (ব্যায়াম) করে। জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন মিরপুর, শ্যামলী, উত্তরা, দক্ষিণখান ও আব্দুল্লাহপুর এলাকার মসজিদে নামাজের পাশাপাশি একত্র হন। তারা ‘কাট অফ’ সিস্টেমে চলা ফেরা করেন। যার অর্থ হলো অপরেশনের সময় কেউ কাউকে চিনবে না।
যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জেএমবির মতই প্রতিপক্ষের ওপর হামলার জন্য মরক্কো ও মিশরের জঙ্গিরা তাদের কিলার গ্রুপের নাম দেয় ‘স্লিপার সেল’। এ গ্রুপকে জঙ্গিরা বলে ‘কিতাল গ্রুপ’। এদের কেউ কেউ বলে ‘জিহাদুল কতল গ্রুপ’। কিলিং মিশনের অংশ হিসেবে এই গ্রুপের সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কিছুদিন অনুসরণ করতে থাকে। প্রথমে এ গ্রুপের দু’একজন সদস্য হত্যাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে মায়াময় একটি সম্পর্ক গড়ে তুলে সুযোগ বুঝে হত্যা করে।’
ক্যান্টনমেন্ট থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামরুল হোসাইন বলেন, ‘বুধবার হামলা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া রুবেলের তার দুই সঙ্গী মুশরাফ ও সোহেলসহ অন্যদের ধরার চেষ্টা চলছে।’