ছোটগল্প ‘অন্ধকার’


-এই কোথায় যাচ্ছ?
-পরাণবন্ধু ডাক্তারের কাছে।
কথাটি বলেই একটু মিষ্টি হেসে আড়চোখে আমার দিকে তাকাল শিমু। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে সদ্য পাশ করে বেরিয়েছে। দেখতে বেশ সুন্দর। ছিমছাম চেহারা। কাজী নজরুলের মত বাবরি দুলানো কুকড়াচুল। ওর কণ্ঠস্বর ভারী ফ্যাসফাসা। মিছিলে শ্লোগান শেষে বক্তাদের কণ্ঠস্বর যেমন হয় তেমনি আর কি! আমি কিছুটা অনুমান করেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুনঃ প্রশ্ন করলাম।
-কেন?
-গলাতে একটু প্রবলেম,
-ও, কফ জাতীয় কিছু কি?
– হ্যাঁ
অনেকটা নির্ভরতার কণ্ঠেই বললাম- ঠিক আছে যাও। তবে উর্মিরে সাথে নিলে ভাল করতে।
-ওর কি একটা দরকার পড়ে গেছে আজ, তাই টু¤পাকেই সাথে করে এনেছি। তুমি কোন চিন্তা করো না।

কথাটি বলেই সে মৃদু হাসল। ওর হাসির পরাগরেণু জুড়ে খেলা করে পৃথিবীর সব সাজানো সুন্দর। ইনকা সভ্যতার ‘মাচু পিচুর’ পরিকল্পনার প্রচ্ছদপট যেন তার সুশ্রী চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে । বয়স বাড়ন্ত হলেও এখনো শিশুর মতই কোমল তার হৃদয়। কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি জগৎবিখ্যত হিমালয়, আল্পস, মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতায় তার হৃদয় মন্দির। তার কথার ফুলঝুড়িতে মনে হবে ভিক্টোরিয়া, রাশিয়ার বৈকাল হ্রদের শীতলতায় ভরপুর। চোখ দুটি ছোট ছোট আঙুরের মত। কিন্তু তার চাহনির ভাঁজে ভাঁজে পিথাগোরাসের সব উপপাদ্য অনায়াসেই হার মানে। তার ভাবালুতা জুড়ে যেন কুরিল দ্বীপের নিটোল নির্জনতা নিভৃতে খেলা করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে, আমাজানের বিশালতা যেন তার মনের ভাঁড়ারের গোপন দহলিজে; রূপসী বাংলার সমগ্র সবুজের আল্পনায় রাঙা তার নীলা¤¦রী ঠোঁট।
মূলত সাহিত্য প্রীতির কারণেই শিমুর প্রতি আমার দুর্বলতা। ওর কবিতা আবৃত্তি শুনলে মুগ্ধতার জোয়ারে মন শীতলতায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায়। চিত্রাঙ্কনের প্রতি ছিল তার বেশ ঝোঁক। বিভাগীয় পর্যায়ে সে কয়েকবার পথম হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছে। গানের গলাও ভারি মিষ্টি। সবকিছু মিলিয়ে সে একজন সুস্থ ধারার সংস্কৃতিমনা মানুষ।
প্রায় বছর চারেক আগে কোন এক সাহিত্য আসরে তার সাথে আমার পরিচয়। সেই থেকেই বেশ একটা ভাব জমে ওঠে। ধীরে ধীরে তা গভীর হয়। এর মধ্যে আমিও ছোট-খাট একটি চাকরি করছি। কলেজে অধ্যাপনা। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীলতা বিকাশের জন্য এমন পেশাই আমার কাছে সর্বোৎকৃষ্ট মনে হয়। তবে বলে রাখি, ব্যক্তিভেদে এই অভিমত নাও টিকতে পারে। না টিকলেও হতাশ নই, আর টিকলেও আহলাদিত নই- এটি কেবল ব্যক্তি অভিমত, সম্প্রচারের জন্য নয়।
প্রায় মাস খানেক পর আজ অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই ওর সঙ্গে দেখা। অবশ্য প্রতিদিনই শিমুর সাথে কমবেশি কথা হয়, তবে কর্মব্যস্ততার কারণে দেখা হয়ে ওঠে না। শিমুর নিজের চাকরি নেই বলেই বিয়েতে মত দিচ্ছে না। বিয়ের কথা বললে তক্তপোষের মত চোয়াল শক্ত করে বলে- নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরই বিয়ে করব। আমি তখন রসিকতা করে বলি- এখন কি তুমি অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে? শিমু তখন অনেকটা প্রগলভ স্বরে বলে- তুমি না… একটা যা ইচ্ছে তাই! আমি মুচকি হাসি। সেই থেকে আমি তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় আছি।
আজ টু¤পাকে দেখে আমি অনেকটা নির্ভার হলাম। বৃদ্ধ বাবা যেমন শেষ বয়সে তার প্রতি অনুরক্ত সন্তানের জন্য নির্ভার হয় তেমনি আর কি! আমি কিছুটা সংশয় ও কিছুটা সোহাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম- সাবধানে যেও। ঔষধপত্র যাচাই করে নিও। আর হ্যাঁ, খাওয়ার সময় অবশ্যই ডাক্তারের নির্দেশ পালন করবে। ভাল থেকো। রাতে ফোন দিও। বাই।
-ওকে। তুমিও দেখে-শুনে যেও। বাই।

পরের দিন। বিকেল বেলা। সূর্য তখন অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। দূর আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে পক্ষিকুল তাদের স্ব স্ব নীড়ে ফিরছে। শহরের ভাসমান শ্রমিকেরা কর্ম স¤পাদন শেষে কোদাল-বেলচা কাঁধে নিয়ে যার যার ঘরের পানে ছুটছে। স্কুল, কলেজ পড়–য়া ছেলেরা মাঠ থেকে তাদের খেলার সরঞ্জামাদি নিয়ে ধীর গতিতে বাসার পানে ছুটছে। প্রকৃতির ¯িœগ্ধ উদ্যান ছুঁয়ে ফুরফুরে বাতাস বইছে। রাস্তার দুধারে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুল্মের শ্যামল সুশোভিত পাতাগুলোর ছন্দময় নড়াচড়া প্রকৃতির সুপ্ত উল্লাসেরই যেন দ্যোতনা প্রকাশ করছে। এমন মন্ত্রমুগ্ধ মায়াবী ক্ষণে শিমু সেই পরাণবন্ধু ডাক্তারের কাছে গেল। সাথে ছিল উর্মি। গতদিনের ঔষধ সেবনের পর সমস্যাটি আরও বেড়েছে বলেই আজ আসা।
পরাণবন্ধু এই জৈন্তা এলাকার নামকরা এক প্রসিদ্ধ ডাক্তার। সরকারি মেডিক্যাল থেকে কয়েক বছর আগে অবসর গ্রহণ করে এখন নিজেই চেম্বার খুলেছে। নিজেরটাতে তো করেনই পাশাপাশি আরও দু, তিন ফার্মেসিতেও সপ্তাহ অন্তর অন্তর বসেন। কলেজ, ভার্সিটি পড়–য়া কোন কোন ছেলে-মেয়ে যেমন সময় ব্যবস্থাপনা করে একইসাথে একাধিক কোচিং সেন্টারে পড়ায় তেমনি আর কি! তবে ওদের হল সম্মানি আর ডাক্তারের হল ভিজিট!
পুরো উপজেলা জুড়ে তার ডাক্তারির বেশ সুনাম রয়েছে। প্রতি শুক্রবার নিজের ফার্মেসিতে বসেই তিনি রোগী দেখেন। ওনার আরেকটা ব্যবসায়িক দিক হল প্রেসক্রিপশনের পর ঔষধগুলো ওনার ফার্মেসি থেকেই দেন। উল্লেখ্য যে, ঔষধের ন্যায্য মূল্যই তিনি রাখতেন। ঔষধের মূল্য অতিরিক্ত রেখেছে এমন অভিযোগ কখনো কারো মুখ থেকে শুনা যায় নি।
এই দিন তার ফার্মেসিতে তুলনামূলক রোগীদের ভীড় বেশি ছিল। সিরিয়াল অনুসারে শিমুও গেল। ডাক্তার প্রয়োজনীয় চেকাপ শেষ করে প্রেসক্রিপশন করলেন। তখনও শিমু একাধারে কাশতে ছিল। কাশতে কাশতে তার যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে। ফুসফুস যেন এখনি ছিড়ে যাবে! চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসবে! এমন ভয়ানক অবস্থা এর আগে তার কখনোই হয় নি। ডাক্তার অভয় দিলেন। ওনার সহযোগী অজিদ চন্দ্রকে বললেন- চার নং তাকের সর্বশেষ বোতলটি বের কর, পাঁচ নং তাকের এন্টিবায়োটিকের বক্স বের কর, …। অজিদ দ্রুত ঔষধগুলো বের করে দিল। ডাক্তার শিমুর অবস্থা বেশি বেগতিক দেখে বলল- এখনি কয়েক চুমুক খেয়ে ফেল। তবে বাসায় যাওয়ার পর পরিমান মত খাবে। শিমু শিশুর মত ডাক্তারের কথা অনুসরণ করল। ব্যস্ততার কারণে ডাক্তার আর চেক করলেন না ওটা সত্যিকার অর্থেই সিরাপের বোতল ছিল কি না!
ফার্মেসিটি রোগীদের বিচিত্র কথাবার্তায় সরব হয়ে ওঠেছিল। ডাক্তার অন্যরোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শিমু বোতল খুলতেই এক অদ্ভূত গন্ধ তার নাকে এল। বমি বমি ভাব হচ্ছে। শেষটায় নিজেকে খুব কষ্টে নিয়ন্ত্রনে আনে। নাক বন্ধ করে বোতলটিতে এক লম্বা চুমুক দিয়ে প্রায় অর্ধেক শেষ করে ফেলে। এরপরই শোনা গেল শিমুর তীব্র চিৎকার। উন্মাদের মত বিকট শব্দ করে বলছে- আমার গলা জ্বলে যাচ্ছে, পেট পুড়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচান ডাক্তার, আমাকে বাঁচান। উর্মির হাত ধরে বলে- আমাকে বাঁচা বইন। আমার মনে হচ্ছে বোতলে এসিড ছিল… এরপর ক্রমাগতই সে হাত-পা ছুড়তে থাকে। এক সময় সে পাংশুটে, নির্জীব হয়ে ওঠে।

তখন সূর্যবাবু অস্তরেখায় ¤¬ান হওয়ার পথে। চারদিকে অস্তরাগের লালিমা। দূর মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। রাতের গভীর অন্ধকার সন্ধ্যার কানে কানে যেন আঁধারের বার্তা নিয়ে নিরন্তর জানান দিচ্ছে। এই অন্ধকারের সাথে যেন অনেক মানুষের জীবনেরও রয়েছে গভীর মিতালি। কেউ স্বেচ্ছায় অন্ধকার ভালবাসে আবার কেউ বাধ্য হয়ে। মানব রুচি বড়ই বিচিত্র!
শিমুর তীব্র চিৎকারে আশেপাশের মানুষ মুহূর্তেই ফার্মেসিতে এসে জড়ো হয়। এসিডের কথা বলতেই উপস্থিত লোকজন বোতল পরীক্ষা করে। প্রমাণও পায়। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ঘটনাটি প্রায় পুরো এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ জনতা পরাণবন্ধুকে উত্তম মধ্যম দিয়ে পুলিশের হাতে সোপার্দ করে দেয়। মুহূর্তেই ধূলোয় মিশে যায় পরাণবন্ধু ডাক্তারের সারা জীবনের অর্জিত সম্মান।

উর্মি আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন করে। মোবাইলটি সাইলেন্ড থাকায় তার কলটি আর যথাসময়ে রিসিব করা হয়ে ওঠেনি। আমার একটি মারাত্মক বদ অভ্যাস হল, আমি যখন সাহিত্যের কোন বিষয় লিখতে বসি তখন মোবাইল সাইল্যান্ড করে দেই, দরজাও বন্ধ করে দেই। অবশ্য এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই দিকই রয়েছে। আমার ক্ষেত্রে যেন নেতিবাচক দিকটিই প্রধান হয়ে দেখা দিল।

গল্প লেখা শেষ হলে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমি মোবাইল চেক করলাম। ওমা! একি, ১০০ মিসড কল! তাও শিমুর। মিসড কল দেখামাত্রই আমি কলবেক করলাম। উর্মি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল- শিমু, এখন মৃত্যুপথ যাত্রী! … ডাক্তার সিরাপের জায়গায় এসিডের বোতল রাখে এবং তা ভুলক্রমে শিমুকে খেতে দেয়…। এরপর সে আর বলতে পারে না। তার গলা ধরে আসে। ওর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। আমি বারবার কল দিতে থাকি। কিন্তু কেবলি দুঃখিত, দুঃখিত এবং দুঃখিত শোনায়।
কথাটি শুনামাত্র আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমার দেহ নিশ্চল হয়ে আসে। চোখ জুড়ে আলো-ছায়া দেখতে থাকি। কিন্তু হঠাৎই মনে হল পিশাচ রূপী সেই ডাক্তারের কথা! মনে হতেই মাথায় প্রাগৈতিহাসিক চেতনা বহনকারী শত বছরের দূষিত রক্ত যেন মাথাচারা দিয়ে ওঠে। ডাক্তারকে যে কিভাবে আঘাত করে পৃথিবী থেকে বিদায় করব তার পুনঃপুন খসড়া মনের গোপন কোণে কষতে লাগলাম। হঠাৎই আবার ফোন আসল। নাম্বারটি অপরিচিত। – হ্যালো, উর্মি বলল-ভাইয়া, নর্থইস্ট তৃতীয় তলায় … কেবিনে। শেষবারের মত শিমুকে দেখতে চাইলে দ্রুত আসেন।
কথাটি শেষ হওয়ামাত্রই সে কলটি কেটে দেয়। আমি পুনঃ কল দেয়ার সাহস ও শক্তি কোনটাই আর পেলাম না। সহসা মনে হল আমার শরীরের শিরা উপশিরাগুলো যেন সঠিকভাবে কাজ করছে না। তবু অজ্ঞাত কিছু চিন্তা করে মনে কিছুটা শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করি। প্রায় ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই আমি নর্থইস্ট মেডিকেলের নিচ তলাতে পৌঁছে যাই। পৌঁছামাত্রই বিদ্যুৎ চলে গেল। বিদ্যুৎ না থাকায় মুহূর্তেই চারদিকে ভূতুরে অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মোবাইলে তখন হঠাৎ কল বেজে ওঠে। ক¤িপত হাতে রিসিভ করি। উর্মি হাও মাও করে কেঁদে বলে- ভাইয়া, আপনার আসতে দেরি হওয়ায় শিমু একাই না ফেরার দেশে চলে গেছে, …।
কথাটি শোনামাত্রই মনে হল আমার দেহ থেকে কেউ যেন হৃদপিণ্ড ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। বুলডেজার দিয়ে আমার সমস্ত স্পন্দন যেন নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ক্ষণমুহূর্তে পৃথিবীকে মনে হল বড়ই সার্থপর। প্রকৃতিকে মনে হল বড়ই নিষ্ঠুর। কাঁপতে কাঁপতে আমার হাত থেকে মোবাইলটি পড়ে যায়। শরীর অবশ হয়ে আসে। চোখ দুটি হয়ে ওঠে নিস্প্রভ। এই অন্ধকারের মধ্যেও আরো অন্ধকার হয়ে ওঠে আমার দৃষ্টি, আমার ভবিষ্যৎ।
…………………………………………..
২০.০৯.২০১৪
বোরহানবাগ, শিবগঞ্জ, সিলেট
মুনশি আলিম
বি এ অনার্স(বাংলা), এম এ (বাংলা) জাবি, এমফিল শাবিপ্রবি