কুড়িটিলায় রহস্যময় কালোপাথর
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ৩৬০ আউলিযার পুণ্যভুমি বৃহত্তর সিলেটের এক কোণে অবস্থিত নবীর নামানুসারে ঐতিহ্যবাহী নবীগঞ্জ উপজেলা। অসংখ্য পীর, গাউস, কুতুব, আউলিয়া এবং বহু গুণীজনের জন্ম হয়েছিল এ উপজেলায়। পাশ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারের সীমান্ত ঘেষে উপজেলার এক প্রান্তে অবস্থিত নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগনা। অসংখ্য বাশ, গাছ ঘেরা এ পরগনার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট পূর্ব দেবপাড়া গ্রামে অবস্থিত সুউচ্চ একটি পাহাড়। এ পাহাড়ের দক্ষিণে রয়েছে আরো একটি উঁচু পাহাড় নাম মীর টিলা।
এছাড়া উঁচু-নিচু আরো অনেক টিলা এখানে বিদ্যমান। এরমধ্যে সবচেয়ে উচুঁ পাহাড় হচ্ছে ‘কুড়িটিলা’। আর এ কুড়িটিলাতে অবস্থিত হাজার বছরের ইতিহাস, কালের স্বাক্ষী নিখুঁত এক কালো পাথর। রহস্যময় এ পাথরটি আজো উৎসুক মানুষের মনের খোরাক যোগায়। এ পাথরটিকে এক নজর দেখার জন্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ছুটে আসেন দিনারপুর পরগনার ছোট্র এ গ্রামে।
পাথরটিকে নিয়ে একটি গল্প শুনে এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ৯ ফুট প্রস্থ রহস্যময় এ পাথরটির মাঝখানে একটি কুড়ালের ছেদ রয়েছে। পাথরের পাশে ছোট ছোট দু’টি গাছ এবং কিছু ওপরে একটি বিরাট গাছ অবস্থিত। পাহাড়ের আশপাশ ও এলাকার আবাল, বৃদ্ধ, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ অনেকের সাথে কথা হলো। এদের সবাই একই রকম তথ্য দিলেন। অজানা অনেকগুলো কথা শুনে রূপকথার গল্প মনে হলো। লোকজনের সাথে আলাপকালে জানাগেল রহস্যময় এ কালো পাথরের হাজার বছরের ইতিহাস। এই পাহাড়ের অদুরেই রয়েছে সদরঘাটের সুপ্রাচীন ইমামবাজার। শত শত বছর আগের কথা। সে সময় এই বাজারে বড় বড় মাছ কেটে বিক্রি হতো। মাছের নাড়িভুঁড়িসহ পরিত্যক্ত অন্যান্য অংশ ফেলে দিত স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা। আর ফেলে দেওয়া মাছের এই পরিত্যক্ত অংশগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যেতেন সাদা পোশাক পরিহিত এক দরবেশ। এর দৃশ্য প্রতিদিন মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করতেন পূর্বদেবপাড়ার সামছু মিয়া নামের এক ব্যক্তি।
অনেকেই বলেছেন, সামছু মিয়া ছিলেন বিখ্যাত ডাকাত। আর এর ফলে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ছিল তার স্বভাব। সেই সুবাধেই এ দৃশ্য ধরা পড়ে সামছুর চোখে। সামছু ভাবতেন কে এই দরবেশ। কী তার পরিচয়। প্রতিদিন ফেলে দেওয়া মাছের উচ্ছিষ্ট কোথায় নিয়ে যায়? কেন নিয়ে যায়? এসব জানার ও দেখার আগ্রহ জন্মে সামছুর মনে।
এমনি একদিন সময় সুযোগ বুঝে সামছু পিছু নেয় উক্ত দরবেশের। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আবছা অন্ধকার। প্রতিদিনের মতো উক্ত দরবেশ ইমামবাজার থেকে মাছের ফেলে দেওয়া অংশ কুড়িয়ে নিয়ে কুড়িটিলা পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছেন। পূর্ব থেকে ওৎ পেতে থাকা সামছু দরবেশের পিছু নেয়। কুড়িটিলা পাহাড়ের সরু আঁকাবাঁকা পথ, সারি সারি গাছ, নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতির ঝির ঝির আওয়াজ। পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে সামছু দেখতে পায় ছোট্র একটি পাথরের সামনে গিয়ে দরবেশ ইশারা করতেই পাথর সরে গিয়ে ঐ স্থানে একটি সুড়ঙ্গ রাস্তা হয়ে গেছে। আর ওই রাস্তায় দরবেশ ভেতরে ঢুকে গেল। সামছু মিয়া অতি সর্তকতার সাথে পিছু নিলেও দরবেশের স্বচ্ছ হৃদয়ের আয়নাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ধরা পড়ে যায় একজন আগন্তুক তার পিছু নিয়েছে। এই ভেবে দরবেশ পাথরের কপাট খোলা রেখেই ভেতরে চলে যায়। সামছু মিয়াও নাছুরবান্দা, তিনি দেখবেই এর রহস্য কি। এগিয়ে যায় পাথরের কপাটের কাছে। দেখতে পায় সেখানে একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। এ পথ দিয়ে তিনিও ভেতরে ঢুকে পড়েন। ভেতরে ঢুকে সামছু মিয়া হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
দেখতে পান এক কল্পপুরীর রাজপ্রাসাদের দৃশ্য। চতুর্দিকে বিচিত্র কারুকাজ খচিত এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। নানান ফুলের মিষ্টি সুভাস। এর মধ্যে বসে আছেন সাদা পোশাক পরিহিত ৭ জনের এক সুসজ্জিত বাহিনী। একপাশে বিলাসবহুল খাবারের আয়োজন। ৭ জনের দরবেশের সামনে খাবর প্লেইট এসেছে ৮টি। অবাক কান্ড। এ দৃশ্য দেখে দরবেশগণ একে অপরকে বলাবলি করছেন একটি প্লেট বেশি কেন? ভাবনায় পড়েন দরবেশগণ। এ সময় হঠাৎ দরবেশ দলপতি সবার উদ্দ্যেশে বলেন, আজ আমাদের একজন মেহমান আছেন। সামছু মিয়া তখনো লুকিয়ে সব কিছু দেখছিলেন এবং শুনছিলেন। দরবেশ দলপতির কথায় সকল দরবেশগণ অবাক হন এবং এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করেন। পরে দরবেশ দলপতির কথায় সামছু আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাৎক্ষণিকভাবে আদর অভ্যর্থনা দিয়ে মেহমান সামছু মিয়াকে খাবারের আসনে বসানো হয়। কি এক বেহেশতী খাবারের আয়োজন।
দুর্দান্ত সাহসী সামছু মিয়া উৎফুল্ল মনে নির্বিঘেœ তাঁদের সাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করেন। খাবার খেয়ে চরম তৃপ্তি অনুভব করেন সামছু। খাবার শেষে দরবেশ দলপতি কেন তার পিছু নিলেন এ কথা জিজ্ঞেস না করে সামছুকে বিপদে আপদে, সুখ-দুঃখে তাঁদের সাথে দেখা করার কথা বলেন। সেই সাথে এই খবর কাউকে না বলার জন্যেও বারণ করে দেন এবং সর্তক করে দিয়ে বলে দেন, যদি এ খবর কাউকে বলেন, তা হলে তোমার (সামছুর) মারাত্মক ক্ষতি হবে।
সব কথা শুনে সামছু মিয়া দরবেশদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে সামছু গভীর চিন্তায় পড়েন। সারাক্ষণ ঐ স্মৃতি তার মনে বার বার উদিত হয়। কোনো কথা-বার্তা নেই গভীর ভাবনায় তিনি একা একা পথ চলে। যে সামছুর প্রতিদিনের হাক-ডাক, চিৎকারে মানুষের ভয় ও আতংক থাকত, তিনি সামছুর হঠাৎ এ পরিবর্তন তার বাড়ির লোকজনসহ গ্রামের সবার চোখে ধরা পড়ে। গ্রামের লোকজন, তার বন্ধু-বান্ধব ও তার পরিবারের লোকজন চিন্তায় পড়ে যান। তারা সামছুর হঠাৎ এ পরিবর্তনের কারণ জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। সবাই সামছুকে আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ খুলে বলার জন্য চাপ দেয়। কিন্ত সামছু এড়িয়ে যায় এবং কারো কাছে কিছু বলে না। দরবেশের নির্দেশ মত ঘটনাটি গোপন রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে সামছু নিজে বাঁচার স্বার্থে। এদিকে সামছুর বৃদ্ধ মাতা ছেলের অকস্মাৎ পরিবর্তনে চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রতিদিন জানতে চান কি হয়েছে ছেলের। এর পরে মুখ খোলেনি সামছু। কিন্তু মায়ের আবদার ক’দিন না বলে পারা যায়। শেষ পর্যন্ত মায়ের আবদার ও ভাগ্যের দুর্বিপাকে ঘটনাচক্রে একদিন তার মা ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ঘটনা সব খুলে বলেন। দরবেশের সেই সর্তকবাণী শেষ পর্যন্ত কার্যকর হলো।
ঘটনাটি তার আত্মীয়স্বজনদের বলার ৩ দিনের মাথায় সামছুর মৃত্যু ঘটে। সামছু অবশ্য ঘটনা খুলে বলার আগে এ রকম ইঙ্গিত করেছিল তার স্বজনদের। শেষে পাথরের কাছেই সামছুকে দাফন করা হয়েছিল।
পূর্বদেবপাড়া গ্রামের বয়ঃবৃদ্ধ গুজরাল মিয়া, রনজিৎ পাল, আবদুল খালেক, মইনুল ইসলাম বাচ্চুসহ অসংখ্য লোকের কাছে এই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর কাহিনী শোনার পর সরজমিনে ছুটে যাই সদরঘাটের কুড়িটিলা পাহাড়ে। অনেক কষ্টে পাহাড়ের উঁচুতে পাথরের কাছে গিয়ে ছবি তোলার সময় ওই এলাকার দিলাওর মিয়া বলেন, ‘প্রায় ১শ বছর পূর্বে এ পাথরের আয়তন ছিল দৈঘ্য ৬ ফুট ও প্রস্থ ৪ ফুট। বর্তমানে পাথরটির আয়তন দৈঘ্য ১৫ ও প্রস্থে ১০ ফুট রয়েছে। পাথরের পাশেই রয়েছে ছোট ছোট দু’টি গাছ। এ গাছেরও এক কাহিনী রয়েছে।
প্রায় ১৪ বছর আগে এ এলাকার নুর মিয়ার ছেলে লেবু মিয়া পাথর ঘেষে অবস্থিত উক্ত গাছ কাটতে যায়। গাছের একটি ডালে ছেদ দেওয়া মাত্র লেবু মিয়া ঢলে পড়ে এবং কিছুক্ষণ পর মারা যান। আজো সে ডালটি কাটা অবস্থায় গাছের সাথে ঝুলে আছে। ছবি তুলতে যেয়ে পাথরের মাঝখানে কুড়ালের দু’টি ছেদের চিহৃ দেখা গেছে।
এ সম্পর্কে দিলাওর মিয়া বলেন, এখানে প্রায় দু’যুগ আগে এক ব্যক্তি টাকার লোভে এ পাথরটিকে টুকরো করে বিক্রি করার লক্ষ্যে ছেদ দিয়েছিল। তখন পাথর থেকে প্রথমে রক্ত তার পর দুধ বের হতে শুরু করে। ঐ ব্যক্তি সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে মারা যায়। এদের দু’জনকেই পাথরের কাছে দাফন করা হয়েছে। পাহাড়ের সর্বোচ্চ স্থানে একটি বিরাট আকৃতির গাছ রয়েছে। পাশে কিছু জায়গা পাকা করা আছে। এখানে নাকি একজন দরবেশ আসনে বসে ধ্যন করতেন। তাই জয়গাটুকু পাকা করা হয়েছে। পাথরের ওপরে মোম বাতি জ্বালানো হয়ে থাকে। প্রতি বছর এখানে পাথরের মানসা হিসেবে ওরস হয়ে থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবারের সিন্নি করা হয় বলেও জানাগেছে।
এখানে পাথরের রক্ষনাবেক্ষণের জন্যে কোনো খাদিম নেই। পার্শ্ববর্তী রোহেল মিয়া নামের কম বয়সী এক যুবককে বসে থাকতে দেখা গেছে। আগন্তকদের কাছ থেকে সিন্নি ও মোমবাতির জন্য ১০/২০ টাকা রাখা হয়।
এ ব্যাপারে তিনি জানান, যারা স্বেচ্ছায় দেন তাদের কাছ থেকে রাখা হয় এবং তা দিয়ে সপ্তাহে সিন্নি করা হয়ে থাকে। এক বার জনৈক ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় পাহাড়ের নিচে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেছিল কিন্তু অত্যন্ত গরমের কারণে সে এলাকা ত্যাগ করে। আজো অনেকে মানত নিয়ে পাথরের কাছে এসে তা পূর্ণ করেন। কুড়িটিলার রহস্যময় এ পাথরটিকে এক নজর দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ এখানে আসছেন। সামছু মিয়ার স্মৃতিতে অম্লান এ রহস্যময় পাহাড় ও পাথর যেন আজো এ দেশের পথভ্রষ্ট মানুষদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যেন উৎসুক মানুষের মনের খোরাক যোগায় এ কালো পাথরটি।