ঘরের শত্রু বিভিষন : শফিক চৌধুরীর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ?

Shofik Chowdhuryসুরমা টাইমস ডেস্কঃ বিশ্বনাথে আওয়ামী লীগের দু-গ্রুপের বিরোধ এখন তুঙ্গে। যেন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই!
গত নবম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগ দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ নির্বাচনে সিলেট-২ আসনের প্রার্থীতা নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এ আসন থেকে সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান দু’জনই ছিলেন মহাজোটের প্রার্থী। তখন বিশ্বনাথ আওয়ামী লীগের একাংশ শফিকুর রহমান চৌধুরীর ও আরেকটি অংশ মুহিবুর রহমানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। এ নিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে উপজেলা আওয়ামী পরিবার।
ওই নির্বাচনে মুহিবুর রহমান মনোনয়ন পাননি। তবে মুহিব তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর নবম সংসদ নির্বাচনে শফিকুর রহমান চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি শফিকুর রহমান চৌধুরীও। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী ইয়াহহিয়া চৌধুরীর সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ পদত্যাগ করে মুহিবুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে পরাজিত হন। নির্বাচনের পরপরই মুহিবুর রহমান চলে যান যুক্তরাজ্যে। এরপর শফিক-মুহিবের বিরোধ কিছুটা শীতল হলেও নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি হয় আওয়ামী লীগে।
দশম সংসদ নির্বাচনের পর চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়। এ নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ভরাডুবির বিভিন্ন অভিযোগ এনে উপজেলা আওয়ামী লীগের ৩৭ নেতাকর্মী জেলা আওয়ামী লীগের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু আজো তাদের পদত্যাগ গৃহিত হয়নি বলে দলীয় সূত্রে জানাযায়।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ উপজেলা দু-ভাগে বিভক্ত। এক বলয়ের নেতএত্ব রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার। অপরটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান কমিটির সদস্য ছয়ফুল।
দু’টি গ্রুপই উপজেলায় পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার গ্রুপ ইফতার মাহফিল করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী। এ ইফতার মাহফিলে যোগ দেননি ছয়ফুল বলয়ের নেতারা।
গত ২২ জুলাই আওয়ামীলীগ নেতা ছয়ফুল হক বলয় পদত্যাকারী নেতাদের নিয়ে স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে ‘বিশ্বনাথ আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে।
সভায় লিখিত প্রবন্ধে ‘সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরীকে সিলেটের রাজনীতি ধংসের জন্য দায়ি করা হয়।। লিখিত প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়-‘সিলেট সিটি নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হওয়ার জন্য শফিকুর রহমান চৌধুরী রাজনীতির অধ্যক্ষতাই দায়ি।’
সভায় উপস্থিত কর্মী সমর্থকরা আগামী দিনে বিশ্বনাথ আওয়ামী লীগকে স্বচ্ছ, সুন্দর এবং নীতি আদর্শের সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলা এবং দুর্নীতিবাজদের দল থেকে বিদায় করা অঙ্গীকার করেন।
এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের হস্থক্ষেপ কামনা করেন।
এর পরদিন ২৩ জুলাই রাত সাড়ে ১১টায় ছয়ফুল বলয় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক (পদত্যাগকারী) এইচএম ফিরোজ আলীর উপজেলা সদরের বাসায় দৃর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এঘটনার জন্য সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক বাবুল আখতারকে দায়ী করে ছয়ফুল গ্রুপের নেতারা বলেন, ‘উপজেলা আ’লীগ থেকে পদত্যাগকারী নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করেই ফিরোজের বাসায় এ হামলা চালানো হয়েছে।’
তবে এ হামলার ঘটনা সাথে শফিক চৌধুরী ও বাবুল আখতার জড়িত নয় বলে বাবুল বলয় গ্রপের নেতারা দাবি করেন।
ইফতার মাহফিল করে ছয়ফুল গ্রুপ শফিক চৌধুরীর বিরুদ্ধে কটুক্তিমূলক বক্তব্যে অভিযোগ এনে ২৩ জুলাই বিকেলে উপজেলা সদরের বাবুল আখতার গ্র“প বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করে।
একই দিনে ছয়ফুল বলয় আ’লীগ নেতা ফিরোজ আলীর বাসায় হামলার ঘটনায় ছয়ফুল গ্রুপ প্রতিবাদ সভা করে। উভয় সভায় একে অপরে বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়।
২৬ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় ছয়ফুল গ্রুপের উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বশির আহমদের ওপর হামলায় চালায় দৃর্বৃত্তরা।
তিনি তারাবীর নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে স্থানীয় বাসিয়া ব্রীজের উপর এ হামলার শিকার হন। বর্তমানে তিনি সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বশির আহমদের উপর হামলার জন্য শফিকুর রহমান চৌধুরী ও বাবুল আখতারকে দায়ী করে ছয়ফুল হক গ্রুপের নেতারা।
তবে বাবুল বলয় নেতা এ হামলার কথা অস্বীকার করেন।
বর্তমানে বাবুল-ছয়ফুল দুটি গ্রুপ একে অপরকে ঘায়েল করতে মরিয়া রয়েছেন। দৃশ্যত এমন দাঁড়িয়েছে যে, এক পক্ষ সরকার দল, অন্য পক্ষ বিরোধী দল। বিশ্বনাথে এখন আওয়ামী লীগের জন্য আওয়ামী লীগই বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোন সময় উভয় গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষীয় সংর্ঘষের আশংকা করছেন উপজেলাবাসী।
এ ব্যাপারে ছয়ফুল গ্রুপের উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক (পদত্যাগকারী) ফিরোজ আলী বলেন, ‘শফিকুর রহমান চৌধুরী দলের গঠনতন্ত্র মেনে চলছে না। তিনি শেখ হাসিনার নির্দেশ অমান্য করে দলে রাজাকার, ডেন্ডারবাজ, দালাল প্রকৃত লোক যোগদান করান। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার কাছে মূল্যায়ণ পাচ্ছেন না।’
তিনি বলেন, ‘শফিক চৌধুরী সংসদ সদস্য থাকাকালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতারের মাধ্যমে ডেন্ডারবাজি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’
উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্বনাথ ইউপির সাবেক দুই বারের চেয়ারম্যান ছয়ফুল হক বলেন, ‘শফিক চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ তিনি রাজনীতি জানেনা।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতি যে জানেনা তাকে দিয়ে জেলা আওয়ামীলীগ পরিচালনা করার সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনেও বাবুল আখতারের কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে বলে তিনি দাবী করেন। শফিকুর রহমান চৌধুরী ও বাবুল আখতার নেতৃত্বে উপজেলা আ’লীগ নেতাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে তারা মুখোশধারী লোকজন দিয়ে যেভাবে হামলা চালাচ্ছে তা বিশ্বনাথবাসির জন্য কলংক।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ভিত্তিহীন ও সাজানো দাবি করে বলেন, ‘১৯৯২ সালে নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী মুক্তি আন্দোলনে সাবেক নেতা হিসেবে যিনি (ফিরোজ আলী) অগ্রনী ভূমিকা রাখেন। তিনি পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত। সরকারী চাকরি গোপন রেখে এইচএম ফিরোজ আলী নামের রাজনীতি করেন। ওই ব্যক্তি তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট শাহ ফরিদ আহমদের বিরোধীতা করায় দল থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুরোধে ফিরোজ আলীকে দলে আবারো অন্তভূক্তি করা হয়। তার কথার কোন মূল্য নেই।’
তিনি বলেন, ‘সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে ছয়ফুল হক ও ফিরোজ আলী আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থীর নির্বাচনের পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তারা ওই নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত রনির প্রেসে আ’লীগ সমর্থিত প্রার্থী পোষ্টার-লিফলেট ছাপা করেন। আর এসব লিফলেট ও পোষ্টার ছিল খুব নিম্নমানের।’
তাদের কারণেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন বাবুল আখতার।
এ ব্যাপারে জানতে সাবেক সাংসদ ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।