সিলেটে ২ মাসে ২০ খুন : বেড়েছে ছিনতাই, অপহরন ও ডাকাতি
সুরমা টাইমস রিপোর্টঃ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এখন সিলেটবাসী। দেশব্যাপী হত্যা, গুম, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরন সহ নানা অপরাধের ঘটনা বাড়ছেই। যার কোনো দিকেই পিছিয়ে নেই সিলেট বাসী। একের পর এক শনির গ্রাস থেকে কোনো ভাবেই পরিত্রান পাচ্ছেন না সিলেটবাসী। অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন । অভিযোগের আঙ্গুলী উঠেছে জনগনের নিরাপত্তার বিধানের মহান দায়িত্বে থাকা পুলিশের দিকেও। সব মিলেয়ে ইদানিং প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলজুড়ে বিরাজ করছে অস্থির অবস্থা । খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি, অপহরণের ঘটনা অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে যাওয়াই এর নেপথ্য কারন । শুধু ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি অপহরণের ঘটনা বৃদ্ধিই নয়, সীমান্তে বেড়েছে চোরাচালানীর ঘটনা। বেড়ে যাচ্ছে নিত্য নতুন সব অপরাধ।
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, অপরাধ যে গতিতে বাড়ছে, পুলিশের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের গতি সে হারে বাড়ছেনা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধ কর্ম চলছে বেশ জেরে শোরে । গড়ে উঠছে প্রশিক্ষিত একাধিক অপরাধী গ্রুপ । বিশেষ করে ছিনতাই বেড়ে গেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এই কর্ম শুধু নগরীতেই হচ্ছে বা ঘটছে তা নয়, গ্রামাঞ্চলের পথে ঘাটেও ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে সর্বসান্ত হচ্ছেন লোকজন। এক পরিসখ্যানে দেখা গেছে, গত ২ মাসে নগরীতে ২০ টি হত্যাকান্ড এবং এ অঞ্চলে অর্ধ শতাধিক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
পারিবারিক বিরোধ, আর্থিক লেনদেন এমনকি কথা কাটাকাটি থেকে গত এক সপ্তাহে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় যেসব খুনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে- ৪ মে রবিবার, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডি ইউনিয়নের মিঠুপুর গ্রামে বড় ভাইয়ের হামলায় ছোট ভাই নিহত হয়। নিহত কাজল মিয়া (৪০) মিঠুপুর গ্রামের মৃত জহুর মিয়ার ছেলে।
জানা যায়- গত ১৩ এপ্রিল কাজল মিয়া তার গ্রামের বাড়ির একটি সবজি বাগানে কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে বড় ভাই হারুন মিয়া ও তার ছেলে শোভন মিয়ার নেতৃত্বে ৪-৫ জন হামলা চালায়। এতে কাজল মিয় গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাকে কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় ২০ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর শনিবার রাতে কাজল মিয়া মারা যান।
গত ০৩ মে শনিবার, হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার আন্দিউড়া ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামে প্রিয়াংকা সরকার নামে এক গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এটি হত্যা না আত্মহত্যা এ নিয়ে এলাকায় চলছে নানা জল্পনা কল্পনা।
২৭ এপ্রিল, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার রায়গ্রামের একটি বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে সিরাজগঞ্জের এক কাঠ ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে তুচ্ছ ঘটনার জেরে খুন হন এক টায়ার ব্যবসায়ী। ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজারের সিকন্দরপুর গ্রামে নিজ বাড়ির পুকুর থেকে এক ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
২৯ এপ্রিল সিলেট শহরতলীর তেমুখী বাইপাস সংলগ্ন শাহজালাল সেতু-৩ এর নিচ থেকে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রায় ৪৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি। তার পরণের কাপড় দেখে পুলিশ ধারণা করছে সে পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক।
২৬ এপ্রিল, গোয়াইনঘাটে নিখোঁজ হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে এক ব্যবসায়ীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৫ এপ্রিল, উপজেলার সীমান্তবর্তী পান্তুমাই গ্রামে ঘটে লোমহর্ষক ঘটনা। সেখানে দেবরের দায়ের কোপে নির্মমভাবে খুন হন দ্ইু ভাবী। একই দিন, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার চিলাউড়া-হলদিপুর ইউনিয়নের গাদিয়ালা গ্রামে ভাতিজার ঘুষিতে নিহত হন চাচা।
গত ২০ এপ্রিল একই উপজেলার সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের সনাতনপুর গ্রামে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় এক যুবক নিহত হন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এক নাইট গার্ডকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ০১ এপ্রিল মঙ্গলবার সিলেট নগরীর আখালিয়া থেকে এ নারীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার বিকেলে আখালিয়ার তপবন আবাসিক এলাকার পরিত্যাক্ত ডুবা থেকে পুলিশ এ লাশ উদ্ধার করে। একই দিন, সিলেটে এক পিকআপভ্যান চালককে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত সায়েম আহমদ (২৩) সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম তেলিপাড়ার মৃত শামীম আহমদ বাদলের পুত্র।
গত ০৭ এপ্রিল সোমবার, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় জনি বেগম (১৮) নামে এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সোমবার সকাল ১১টার দিকে উপজেলার কাগাপাশা ইউনিয়নের উমরপুর হাওর এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত জনি বানিয়াচং উপজেলার ইউসুফপুর গ্রামের মৃত আজমান মিয়ার মেয়ে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, নিহত জনি বেগমের সঙ্গে একই গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে আব্দুর রহিমের (২২) প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এর ধারাবাহিকতায়, গত ২০ মার্চ জনি নিখোঁজ হন। নিখোঁজের পরপরই প্রেমিক আব্দুর রহিম ও তার পরিবারের লোকজন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
গত ১৫ এপ্রিল দুলাভাইয়ের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রাণ দেয় হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সায়হাম জুট মিলের নারী শ্রমিক কুলসুমা । ৬ সহযোগীকে নিয়ে দুলাভাই জুয়েল মিয়া শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে তাকে। পুলিশ দুলাভাই জুয়েলসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে।
গত ০১ মে বৃহস্পতিবার সিলেটের ওসমানীনগরের স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক কর্মীর গলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অর্জুন ভৌমিক (২০) নামের ওই কর্মী ওসমানীনগর থানার গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের পুরকায়স্থপাড়া গ্রামের মৃত নিলু ভৌমিকের ছেলে।
এদিকে, খুনের ঘটনার পাশাপাশি নগরীতে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। গত দুমাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে প্রায় অর্ধশত টির মত। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ডাকাতির ঘটনার মধ্যে, ০৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ভোর রাতে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় ফতেহপুর ইউপির বেরকুড়ি গ্রামে রানা মিয়ার বাড়িতে ১৫/১৬ জন মুখোশধারী ডাকাতদল কলাপসিবল গেইট কেটে ও দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে মারধর করে।পরে ডাকাতরা দেশীয় অস্ত্রের মুখে রানামিয়াসহ তার পরিবারের সবাইকে বেঁধে ফেলে। এরপর তাদেরকে এলোপাতাড়ি মারধর করে আলমিরার চাবি নিয়ে ১শ ১০ ভরি স্বর্নালংকার ও নগদ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ ৫টি মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।
একই দিন, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের দশদল গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবদুল গণির বাড়িতে দূর্র্ধষ ডাকাতি সংগঠিত হয়। দিবাগত রাত আড়াইটায় এ ঘটনা ঘটে। ডাকাতদল পরিবারের সকল সদস্যদেরকে অস্ত্রের মূখে জিম্মি করে ঘরে থাকা ৫ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ৭ হাজার টাকা, জনতা ব্যাংকের ৪৮ হাজার ৫শত টাকার একটি চেক, দুটি মোবাইল সেট ও আসবাবপত্র নিয়ে যায়। গত ০৬ এপ্রিল মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় টেংরা ইউপির সালন গ্রামের আকবর খানের বাড়িতে গভীর রাতে ১৫/১৬জন মুখোশধারী ডাকাতদল গ্রীলের তালা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে। এসময় ঘরের লোকজন জেগে উঠলে ডাকাতরা ১রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে ঘরের সবাইকে বেধে ফেলে। এসময় ডাকাতরা ৮ ভরি স্বর্নালংকারসহ নগদ ৩ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
গত ২৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সিলেট নগরীর আখালিয়া থেকে লন্ডন প্রবাসীর পাঠানো ৬ লাখ টাকা তার ভাইকে ছুরিকাঘাত করে ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বেলা ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ছিনতাই শিকার রাজ উদ্দিন আখালিয়া নতুন বাজারের মৃত মোবারক আলীর ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার কাঞ্চনপুরে। এছাড়াও গত ২০ এপ্রিল নগরীতে ৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় দিন-দুপুরে মহিলা ও শিশুদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাইকারীরা স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা লুট করে নেয়।
এদিকে খুন, ছিনতাই ডাকাতির সাথে পিছিয়ে নেই গুম করাও। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মনে এ আতঙ্ক রয়েছে বেশি। কারণ অতীতে ঘটে যাওয়া গুম অপহরণের বিচার না হওয়ার ফলে এসব ঘটনা দিনের পর দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে সিলেট অঞ্চলে গুম, অপহরণ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। ২০১২ সলের ১৭ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার বাসিন্দা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী, তার গাড়ির ড্রাইভার আনসার আলী গুম হন। একই বছর ছাত্রদল নেতা দিনার, জুনায়েদকে গুম করা হয়। এসব গুমের রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি।
গত ২০ এপ্রিল সিলেট নগরীর রিকাবীবাজারস্থ মাদার কেয়ার ক্লিনিকের কাছ থেকে শমসের আলী নামের এক ব্যবসায়ীকে চোখ বেঁধে তুলে নেয় কয়েকজন যুবক। তাই সিলেটবাসী সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তবে এ ব্যাপারে শমসেরের ভাই রেজওয়ান কোতোয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন। পরে ১৩ দিন পর গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। তবে শমসেরকে উদ্ধারের পর পুলিশ দাবি করেছে এটা ছিল সাজানো নাটক। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে শমসের গা ঢাকা দিয়েছিল।
সিলেটের সামগ্রিক আইন-শৃংখলা এরুপ পরিস্থিতিতে সিলেট রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি সাখাওয়াত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। তবে, পুলিশ অপরাধ দমনে সচেষ্ট রয়েছে।
সিলেটের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেন, এপ্রিল মাসের ২৪ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সংঘটিত ঘটনাগুলোর তদন্তের কাজও চলছে। ইতোমধ্যে অনেক অপরাধী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। ডাকাতি ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, গত ক’দিনে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ডাকাত সর্দারসহ বিভিন্ন গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আটক করা হয়ছে। অচিরেই হয়তো পরিস্থিতি নাগালে চলে আসবে। তথ্যসূত্রঃ সিলেট ভিউ