তালাক : পুরুষের চেয়ে এগিয়ে নারীরা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ঢাকার আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা খাদিজা আক্তার। স্বামী গোপনে আরেকটি বিয়ে করেছেন জানতে পেরে সিদ্ধান্ত নেন বিচ্ছেদের। গত ১ এপ্রিল স্বামীকে পাঠিয়ে দেন তালাকের নোটিশ।
ঢাকার আদাবরের হালিমা আক্তার আর রাসেল আহমেদের বিয়ে হয়েছিল ২০০৬ সালের ৯ নভেম্বর। বনিবনা না হওয়ায় স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেন ১৮ মার্চ।
বছর দশেক আগেও তালাকের সিংহভাগ সিদ্ধান্ত আসত স্বামীর পক্ষ থেকে। কিন্তু সে যুগ পাল্টেছে। সম্প্রতি মেয়েদের দিক থেকেই তালাকের নোটিশ আসছে বেশি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) জরিপ অনুযায়ী ২০১২ সালে তালাকের ৯৪.৫৫ শতাংশই দিয়েছেন নারীরা এবং ২০১৩ সালে তালাকের ৯৯.৩৫ শতাংশ দিয়েছেন স্ত্রীরা।
২০১২ সালে ৩ হাজার ১৩৯ জনের বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্যে পুরুষের দিক থেকে বিচ্ছেদের উদ্যোগ এসেছে ১৭১টি। আর স্ত্রীদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ এসেছে ২ হাজার ৯৬৮টি। ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৩২টি বিচ্ছেদের মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয় ২৪টি।
২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৯৩৩টি। এর মধ্যে পুরুষরা উদ্যোগ নিয়েছেন ২৬৯টি আর নারীরা ৬৬৪টি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনা করে চাকরির প্রবণতা বাড়ছে। এতে আর্থিকভাবে পরনির্ভরশীলতা কমছে নারীদের। তাই আর পরমুখাপেক্ষী না হয়ে মেয়েদের মধ্যে নিজের জীবন নিজেই চালানোর মতো আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। তাছাড়া বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বিবাহিত ৮৭ শতাংশ নারীই শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এই অবস্থায় যারা অন্যায় মেনে নিতে চান না, তারা বিচ্ছেদকেই বেছে নিচ্ছেন। তবে এখনও সার্বিকভাবে বিচ্ছেদের হার কম, তবে এই প্রবণতা বাড়ছে। পরিবারের স্থায়িত্বের জন্য ছেলেদেরকে কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
কেন পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি তালাক দিচ্ছেনÑ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মেয়েরা আগে থেকে সচেতন হয়েছে। আগে অন্যায়-অত্যাচার নারীরা সহ্য করত। কারণ আর্থিকভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতা ছিল বেশি। এখন নারীরা চাকরি-ব্যবসায় জড়াচ্ছে বেশি। অধিকার সচেতনতাও বাড়ছে। নিজের ভরণ-পোষণ নিজেই করতে পারছে। সারাজীবন অস্বস্তিতে না ভুগে আগে থেকেই নিজেই নিজের ব্যবস্থা নিয়ে নিচ্ছে।’
তবে বিচ্ছেদের এই প্রবণতা সমর্থন করেন না রাশেদা ইরশাদ নাসির। তিনি বলেন, পরিবার ভাঙা কোনোভাবে ভালো নয়। তিনি বলেন, এটা একদিকে যেমন ভালো, অন্যদিকে খারাপও। কারণ যাদের সন্তান আছে, সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। হয়ত এক সময় এই সন্তানের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে বাবা-মা।
এ থেকে পরিত্রাণ একমাত্র পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমেই সম্ভব বলে মনে করেন রামেদা ইরশাদ নাসির। হুট করে বিবাহ বিচ্ছেদে না গিয়ে পারিবারিকভাবেই বিরোধের সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম এনামুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, এখন পারিবারিক বিরোধের ক্ষেত্রে মানুষের অপেক্ষা আর সমঝোতার প্রবণতা কমে আসছে। এ কারণে তালাকের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি মনে করেন যেসব ঘটনায় বিচ্ছেদ হয়েছে সেগুলো সমাধা করা যেত সহজে।
ডিসিসির আরেক কর্মকর্তা মো. আবু সালে ইসলাম বলেন, ‘মানুষ না বুঝে কাজী অফিসে যায় তালাকের জন্য। কাজী কিছু টাকা নেন। কিন্তু এটা নিয়মের বাইরে। এভাবে তালাক হয় না।’ তিনি বলেন, ‘মেয়ের ঠিকানায় সালিশি চেয়ারম্যান থাকবে। তালাকের চিঠি তার মাধ্যম হয়ে যেতে হয়। যেদিন চেয়ারম্যান চিঠি পাঠাবে সেদিন থেকে ৯০ দিন পরে তালাক কার্যকর হবে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান উভয় পক্ষকে আপসে মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন। এই সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যান ছেলে ও মেয়েকে তিনটি চিঠি দেবে তিনবার। ছেলেকে তিনটি, মেয়েকে তিনটি। যদি এই সময়ের মধ্যে তারা আপসে না আসে তবে ৯০ দিন (তিন মাস) পরে তালাক হয়ে যাবে।
তবে ৯০ দিনের আগে তালাক প্রত্যাহার করা যায়। তাই নোটিশ দেওয়ার পরও সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডিসিসির কর্মকর্তারা। তারা বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হুট করে বা রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পারে অনেকে। কিন্তু আইন না জানায় মীমাংসার পথে যায় না। এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানদের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কর্মকর্তারা