আকাশেই আমার ‘বাবা’!!!

আয়শা সিদ্দিকা আশা

Haris Mohammedআজকের এই দিনে তুমি ছেড়ে গিয়েছিলে আমায়। আজ ৩ এপ্রিল। বেদনায় ক্লান্ত এই ক্ষনটি কেন বারবার ফিরে আসে জানিনা। কোনো এক বিকেলে আছরের আযানের ধ্বনির মধ্যেই সবার অজান্তে না ফেরার দেশে তুমি চলে গিয়েছিলে। আজোও তোমার অপেক্ষায় দিন গুনি। গোনতে গোনতে আজ প্রায় ৪ বছর। ভাবিনি কখনো তোমায় নিয়ে লিখেতে হবে কাব্য। তুমি তো আমার কাব্য নও ! তুমি আমার আবেগ, তুমি আমার অনুভুতি, তুমি আমার সত্তা, যাকে পুজি করে আমি তোমাকে লিখি। তোমাকে আকিঁ। অদৃশ্য তোমাকে অনুভব করি। তোমার সাথে কথা বলি, ঘুরি, খেলি, হাসি। সত্যি কল্পনা বড়ই আজব মনে হয়। অতিতের প্রিয় মুহুর্তগুলো কে ক্ষনিকেই চোখের সামনে জীবন্ত রুপে ফুটিয়ে তুলে। বাবা অবচেতন মনে সত্যি আমি তোমাকে দেখতে পাই। যদিও বাস্তবতা আমাকে এক সময় এই মোহ থেকে যান্ত্রিক জীবনে ফিরিয়ে নেয়। জীবনের চরম দুঃসময়েও আমি তোমার ছোয়া অনুভব করি। জনিনা কোথায় আছো তুমি, কেমনইবা আছ। আমি জানি, এই যান্ত্রিক জীবনের কোনো প্রযুক্তিই তোমার কাছে পৌছাবে না। তবে আমার বিশ্বাস তুমি যেখানেই আছো তোমার বৃত্তে তুমি ভালো আছো। 

বাবা, তুমি নাকি আকাশে থাকো ? তাইতো আকাশের উড়ন্ত ঘুড়িটাকে মাঝে মাঝে তোমার কাছে পাঠাই। কতো ঘুড়ি যেতে যেতে হারিয়ে যায়, কতোটাই আবার ফিরে আসে। দুঃখ শুধু এটাই ঘুড়ি কথা বলতে পারেনা। যখন মুশল ধারায় বৃষ্টি নামে আমার বাসার ছাদে আমি সেই বৃষ্টিতে ভিজি। ভাবি আজ মনে হয় তোমার মনটা ভিষন খারাপ। তাই তুমি কাদঁছো। আর সেই কান্না বৃষ্টি আমায় ভিজাচ্ছে। আকাশের বুকে যখন রংধনুটা ওঠে আমি ভাবি আজ তোমার মনে খুব আনন্দ। সেদিন সারাটা ক্ষনই আমি আনন্দে ভাসি। তুমি নেই আমি কক্ষনো ভাবি না। ভাবি তুমি আকাশেই আছো। আমার আকাশের মতো বিশাল বাবাটাকে আকাশ কিভাবে তার নীলে লুকিয়ে রেখেছে তার কোনো হিসাবই মিলাতে পারিনা। কখনো যদি আকাশের কাছে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো বা বাবার দেখা পেতাম। বাবার কাছে কতো অপূর্ন আবদার রয়ে গেছে আমার। বাবা হয়তো জানো, আজকাল আমি ভিষন হিংসুটে হয়ে গেছি। অন্যদের বাবাকে দেখলে ভিষন হিংসা লাগে আমার। জানো ভিষন বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে আমার। তোমাকে নিয়ে আগের মতো ঘুরতে ইচ্ছে করে আমার। দু’হাতে মুখ গোজে নয়, চিৎকার দিয়ে বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে আমার। আমি অন্যদের মতো হতে চাই বাবা। আমার আর এই যান্ত্রিক জীবন ভালো লাগেনা। তোমার ছায়ায় যতোটা দিন ছিলাম ভালোই তো ছিলাম। ছোট্ট পুচকে একটা ছানার মতো জীবনটা এগোচ্ছিল। বাবা আমার মতো এই পুচকে ছানার ঘাড়ে এতো বড় সংসারের দায়িত্ব কিভাবে দিয়ে গেলে? আমি আজ কাল বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি বাবা।
জীবনের ৪ টা বছর তোমাকে না দেখে কাটিয়ে দিয়েছি আমি। সত্যি ভাবতে বড় অবাক লাগে। জানিনা কিভাবে সময় এতো দ্রুত ক্ষয়ে যায়। সব কিছু যদি ক্ষনিকের জন্য উল্টো হয়ে যেতো, জানিনা হয়তো খুশিতে আতœহারা হয়ে যেতাম। কি ফিরে পেতাম জানিনা, তবে তোমাতে আবারো ফিরো পেতাম ঠিকই। ফিরে পেতাম সেই সোনা ঝরা আনন্দের দিন গুলো। বুকের পাজরে আটকে রাখতাম তোমায়। যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। জানি না জীবনের খাতায় আর কিছু হারাবার আছে কি না। তবে তোমাকে হারানোর পরে মনে হয়ে ছিল দুনিয়াটা বড়ই নিষ্টুর একটা জায়গা। মানুষ যা চায় সে তা পায় না। আর যা পায় তা ভুল করে পায়। আজব এই দুনিয়া। তার থেকেও আজব এই দুনিয়ার মানুষগুলো। বিচিত্র এই শহরে বিচিত্র রকমের মানুষ। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যার মুখোশের মানূষ গুলোকে চেনা বড় কঠিন। এই পৃথিবীর সব থেকে ভালো মানুষটাই আমার কাছে ছিল। যাকে বিধিতা আমাকে বাবা বলে ডাকার সুযোগ দিয়েছিলেন। জানিনা এই পুচকে মানুষটির প্রতি বিধিতা কেনো এতো খুশি ছিলেন। আমি আমার বিধিতার প্রতি কৃতজ্ঞ। জীবনে এমন দুই মহা মুল্যবান বস্তু আমি পেয়েছি যা সত্যি আমার কাছে অমুল্য। আমার বাবা ও মা। এই পৃথিবীতে শুধু সন্তান জন্ম দিয়েই মা, বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। বিনা স্বার্থে যুগ যুগ ধরে সন্তানকে লালন-পালন, আদর, ¯েœহ-মমতা, শাসন-নিয়ম সব দিয়ে এই সমাজে ঠাই করে দেন। পাখি যেমন তার আপন আলয় ঠোটে ঠোটে খড়-কুটো জমিয়ে বানায়, ঠিত তেমনি করে মা, বাবা ও জীবনে অনেক কষ্ট করে সৎ উপায়ে তাদের সন্তানকে মানুষ করেন। মানুষের জন্ম যতো খানি সহজ, জীবনের বেড়ে ওঠা ততোধিক দীর্ঘ পাড়ি বৈকি।
আমার জীবনের দৈর্ঘ্য তেমন বড় নয়, ছোট্ট এই জীবন থেকেই বুঝেছি, মানুষের এই জীবনটা সমুদ্রের ঢেউ গুলোর মতো, দুর থেকে ভাসতে ভাসতে এক সময় তীরে এসে আছড়ে পরে। আর সেই ঢেউ এর শুন্যতা আরেকটি ঢেউ এসে পুরন করে দেয়। কিন্তু কিছু কিছু ঢেউ স্মৃতি রেখে যায়। ঠিক মানুষের জীবনেও এমন কিছু প্রিয় জন থাকে, যার শুন্যতা কখোনো কাউকে দিয়েই পুরণ করা যায়না। তাদের স্মৃতি নিয়েই মানুষ বেচেঁ থাকে। আমার বাবাও তেমন একজন মানুষ যার কথা আজোও কেউ ভুলেনি। বন্ধু, বান্ধব, সহকর্মী, পাড়া প্রতিবেশি আতিœয় স্বজন সহ এই সিলেটের মানুষ আজো তাকে স্বরন করে। আজো মানুষ তাকে ভালোবাসে। তার কর্মে তিনি বেচে থাকবেন আজিবন। এই সাংবাদিক সমাজের অনেকেই আছেন যারা আজো বাবাকে নিয়ে ভাবেন, তার মতোই হতে চান। আমার গর্ব হয় আমি যখন এসব দেখি, শুনি। আমি নাকি বাবার মতো দেখতো, কিন্তু কখনো কি বাবার মতো হতে পারবো? জানিনা। তবে এটা জানি আমার বাবার মতো আর কেউ নেই। আর হতেও পারবেনা।
প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন একটা সময় আসে যখন মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তখন কারো পরামর্শ খুব জরুরী হয়ে পড়ে । সে সময়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো আদর্শ একজন মানুষ হল বাবা। স্বভাবগত গাম্ভীর্যের জন্য বাবার সাথে সবার ঘনিষ্ঠতা একটু কম থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমে ছিলাম আমি। বাবা নামক মানুষটির প্রতি আমাদের ভালোবাসার কোন ঘাটতি থাকে না। শুধু একটু সাহস করে আমাদের প্রথম উদ্যোগটা নিতে হবে তাঁর সান্নিধ্যে যাবার। বাবার মতো বন্ধু পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। সে মানুষগুলো ভাগ্যবান যারা নিজেদের বাবার বন্ধু হতে পারে।
জীবনের কিছু কিছু স্মৃতি মনে হলে এখোনো চোখ বেয়ে পানি পড়ে। মনে পড়ে এখোন রাত জেগে আমার স্কুলের হেডমাষ্টারের কাছে বাবার চিঠি দেখার দৃশ্যগুলো। আমার বাবা ছিলেন হত দরিদ্র মানুষ। আমাদের স্কুলের বেতন দেবার সামর্থ্য ভদ্রলোকের ছিল না। এর বদলে আমার বাবা রাত জেগে চিঠি লিখতেন। স্কুলের হেড স্যার বরাবর। চিঠির ভাষা হতো অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। সেই জোরালো চিঠির বদৌলতে স্কুলে আমি প্রতি বছর বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ পেতাম। জীবনের সুখের সময়গুলো খুব অল্প ছিল আমাদের জীবনে। তার পর ও আমাদের জীবনটা ছির সুখের। বাবা হচ্ছে এমন একজন যিনি তোমার কান্নার সময় তোমাকে ধরে রাখেন, তুমি যখন নিয়ম ভঙ্গ কর তখন শাসন করেন তোমার সাফল্ল্যে উল্লাসিত হন আর তোমার ব্যার্থতাতেও তোমার প্রতি বিশ্বাস রাখেন!! বাবা হচ্ছে ভয় ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত এক অনন্য সত্তা!! যার সবটুকু গুনই ছিল আমার বাবার মাঝে।
প্রতি শতাব্দি অন্তর অন্তর এক জন মানষীর আবির্ভাব ঘটে। আমার চোখে আমার বাবা একজন মহামানষী। যিনি সারা জীবন কল্যান করেছেন মানুষের। লাখো মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। যিনি জীবনে কষ্ট করেছেন কিন্তু কখনো তার নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। স্বগৌরবে পাড়ি দিয়েছেন জীবনের ৫২ টি বছর। সুখী মানুষের কাছে ৫২ টি বছর হয়তো কিছুই না। কিন্তু আমার বাবা জীবনে ৫২ টি বছরের প্রতিটি মুহুর্ত সংগ্রামের সাথে পাড়ি দিয়েছেন। গড়ে গেছেন এক বর্নাট্যময় জীবনের ইতিহাস। আমার লিখনীর মাধ্যমে তার জীবনী বা তাকে সম্পূর্ন ভাবে ফুটিয়ে তুলার স্পর্ধা আমার নেই। কোনো কালে হবে কিনা জানিনা। বাবার বিবেক আর তার দেখানো পথে হাটছি অবিরাম। জানিনা এই পথের শেষ আছে কিনা। যদি বা শেষ না হয় এই পথের, ক্ষতি কি। জীবন তো চলবেই জীবনের মতো। ভয় কি, বাবার আর্শীবাদ আমার সঙ্গেই আছে। বাবা, তোমায় বুকে ধারন করেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবো। তুমি যেখানেই থাকো ভিষন ভালো থেকো। তোমার পুচকে তোমার অপেক্ষায়।