ফিলিস্তিনী হত্যার দায়ে ইহুদীদের কোন শাস্তি নেই
তোফায়েল আহমদ
“গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনী যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করা হবে। কোনো আন্তর্জাতিক চাপই আমাদেরকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।” -বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তপানে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা ইসরাইলী ইহুদিদের। কিন্তু না, তারা এখনো সুস্থ আছে; বিগত ৬৬ বছরে যে পরিমাণ রক্ত তারা পান করেছে তা অল্পই মনে হচ্ছে। অন্তত তাদের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যে দম্ভোক্তি দেখিয়েছেন তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে তারা এখনো তৃষ্ণার্ত। অবশ্য এরকম দম্ভোক্তি নতুন কিছু নয়, ইউরোপ-আমেরিকার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের হুমকি-ধামকি দেয়া কোন ব্যাপার না। তারা নিশ্চিত থাকে তাদের গডফাদার তথা পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ব্যাকআপ দেবে।
কথিত তিন কিশোর নিখোঁজ ও নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে ইস্যু করে ইসরাইলের ইহুদীরা গত ৮ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত এক সপ্তাহের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ নিরপরাধ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে, যাদের বেশির ভাগই শিশু ও মহিলা। হামলায় আরো এক হাজার দুইশ’র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যায় ইসরাইলের বিমান হামলায় গাজার একই পরিবারের ১৭ জন নিহত হয়েছেন। এই সাপ্তাহে গাজা থেকে হামাসের রকেট হামলায় পাঁচ ইসরাইলী আহত হলেও এ পর্যন্ত দেশটির কোনো নাগরিক নিহত হয়নি। ইসরাইলের দাবি, তারা জঙ্গি ও জঙ্গিদের স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। জঙ্গি গোষ্ঠীর জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাড়ি লক্ষ্য করেও হামলা চলছে। হামলায় নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই “সন্ত্রাসী” বলে দাবি করেছে ইসরাইল। তবে গাজায় নিহতদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ বেসামরিক নাগরিক বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। শনিবার মাগরিবের নামাজের সময় একটি মসজিদে ইসরাইলী হামলায় অন্তত ১৮ জন মুসল্লি নিহত হয়েছে । এর আগে ২০০৯ সালের ইসরাইলী স্থল অভিযানে প্রায় ১৪০০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছিল। ২০১২ তে তারা গাজায় হামলা করেছিলো।
নির্দোষ মজলুমদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া ইসরাইলের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট। যুদ্ধাবস্থা ছাড়াও তাদের হাজার হাজার সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নজীর রয়েছে। এবং বড় কথা হল এগুলোর কোন বিচার নেই। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলের অফার সামরিক কারাগারের পার্শ্ববর্তী সড়কের খুব কাছে ৪৭ বছর বয়সী ফিলিস্তিনী ফখর জায়েদের বাড়ি। ফিলিস্তিনীরা প্রায়ই ওখানে জড়ো হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। গত ১৫ মে জায়েদের বাসার সামনে ফিলিস্তিনী তরুণ ও ইসরাইলী ফৌজীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ইসরাইলীরা গুলী ছুঁড়ে দুই ফিলিস্তিনী কিশোরকে কীভাবে হত্যা করে তার প্রত্যক্ষদর্শী হলেন জায়েদ। গুলী চালানোর পৈশাচিক ঘটনাটি বাসার সিকিউরিটি ক্যামেরাতে ধরা পড়ে, বাসার দেয়ালেও গুলির চিহ্ন রয়েছে। ফুটেজে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় ১৭ বছর বয়সী নাদিম নাওয়ারাহ ও ১৬ বছরের আবু দাহের ইসরাইলী গুলীতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মৃত্যু হয়। ফুটেজটি সারা বিশ্বে এমন আলোড়ন তোলে যে, ওবামা প্রশাসনও ঘটনার দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য ইসরাইলী কর্মকর্তাদের কাছে দাবি জানায়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ঘটনাটিকে ইচ্ছাকৃত ও বিচারবহির্ভূত যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করে।
কিন্তু ঘটনাকে ঘিরে দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা চলতে থাকা সত্ত্বেও ঘটনার আন্তরিক তদন্তের কোনো ব্যবস্থা ইসরাইল করেনি। উপরন্তু ঘঠনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত ও নিহত দুই কিশোরের পরিবারকে ঘটনার জন্য দোষী বানানোর চেষ্টা চালায় এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভয়ভীতি দেখায়।
এ ব্যাপারে ইসরাইলী কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে তারা কোনো প্রাণঘাতী হামলা ১৫ মে তারা চালায়নি। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে, প্রত্যক্ষদর্শী ও উপস্থিত প্রমাণাদিতে তাদের কথা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। ঘটনার তদন্তকারী একটি মানবাধিকার সংস্থা জানায় ফিলিস্তিনী দুই কিশোর ইসরাইলী ফৌজীদের জন্য উপকারিমূলক কোনো তৎপরতাতে যুক্ত ছিল না। তাদের ঠাণ্ডা মাথায় গুলী চালিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার আরো বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ইসরাইলী সৈন্যদের পরবর্তী কার্যকলাপে। ঘটনার এক মাস পর ১৭ জুন যুদ্ধসাজে সজ্জিত ২০ জন ইসরাইলী সৈনিকের একটি দল জিপে চড়ে এসে হাজির হয় জায়েদের বাসার সামনে। তারা জায়েদের আইডিকার্ড চেয়ে নেয় এবং জোর করে তাকে জিপে তুলে অফার মিলিটারি কারাগারে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে তারা হত্যার হুমকি দিতে থাকে, তার পরিবারের লোকজনকেও হত্যার ভয় দেখানো হয় যাতে সে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফিলিস্তিনী হত্যাকাণ্ডের ছবিটি তাদের হাতে তুলে দেয়। তাদের হাতে এক ঘণ্টা আটক থাকে জায়েদ। এর পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ইসরাইলের পক্ষে বলা বলা হয়েছিলো ইসরাইলী সহিংসতায় ফিলিস্তিনী শিশুদের হতাহত হওয়ার ঘটনার তারা তদন্ত শুরু করেছে। কিন্তু যেইসেই, ইসরাইলী তদন্তে ফিলিস্তিনীদের স্বস্তিবোধ করার মতো কিছু নেই। ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের অপতৎপরতায় দায়ী ইসরাইলী সৈনিকদের কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। ফিলিস্তিনীদের মেরে ফেলা, আহত করা, বাড়িঘর ধ্বংস করার দায়ে এখন পর্যন্ত কোনো ইসরাইলীকে এ পর্যন্ত শাস্তি পেতে দেখা যায়নি। এটাই নিয়তি যে, যতোদিন ফিলিস্তিনীদের ভূমিতে ইসরাইলী জবরদখল বহাল থাকবে ততদিন ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলীদের নৃশংস ও বর্বর অত্যাচারও চলতে থাকবে। ঐ ঘটনার পরে ইসরাইলী সৈনিকদের বেপরোয়া গুলী ছোঁড়া ও অন্যান্য ধরনের নিপীড়নমূলক তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। আর এখনতো রীতিমত যুদ্ধ চলছে।
সর্বশেষ, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী সন্ত্রাসীরা ক্যানসার সৃষ্টিকারী বোমা ফেলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাজায় কর্মরত নরওয়ের একজন ডাক্তার এই অভিযোগ তোলে ইসরাইলের এ জঘন্য অপরাধের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ডাক্তার এরিক ফস ইরানের প্রেস টিভিকে জানিয়েছেন, ইসরাইলি হামলায় হতাহত যেসব রোগী হাসপাতালে গিয়েছে তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক লোকজন এবং তাদের বাড়ি-ঘরের ওপর বোমা হামলা করেছে ইসরাইল। আর এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগই শিশু। ইসরাইলি সেনারা গাজার ওপর ডেন্স ইন্টার-মেটাল এক্সপ্লেসিভ বা ডিআইএমই ব্যবহার করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর বিস্ফোরণ ছোট হলেও বিস্ফোরণ এলাকায় ধ্বংস ক্ষমতা অনেক বেশি কার্যকরী। ডিআইএমই টুকরো থেকে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা জীবের ওপর শক্তিশালী বায়োলজিক্যাল প্রভাব পড়ে। তাতে হতে পারে ক্যান্সার। অসলো বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ফস বলেন, অবরুদ্ধ গাজায় বেশ কিছু ফিলিস্তিনি নাগরিক নতুন ধরনের অস্ত্রে আহত হয়েছেন যা যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তাররা শনাক্ত করতে পারেননি। এর আগে গাজায় ইসরাইল ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ ও ফসফরাস বোমা ব্যবহার করেছিলো।
হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনি হত্যার দায়ে ইসরাইলকে শাস্তি দেয়ার মত কেউও বিশ্বে নেই। আরব বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলোর কেউ এখনো ঘুমোচ্ছে, কেউ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ব্যাস্ত, ইরাক-সিরিয়া বিদ্ধস্থ, মুরসি পরবর্তী মিসর নতুন ফেরাউন ইসরাইলী পুতুল সিসির হাতে বন্দি। এমনিতেই যখন বাঁচা যাচ্ছে না তখন যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে ফিলিস্তিনিদের। অন্যায় ভাবে ফিলিস্তিনী ভূমিতে ইসরাইলী নিয়ন্ত্রণ বহাল রেখে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যারা দাবি জানান, তাদেরকে অর্বাচীন অথবা ভণ্ড ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না বলে মনে করি।