জাতীয় সামাজিক জীবনে মাহে রামযান ও রোজার গুরুত্ব
~ ওলীউর রহমান ~
মানুষের আত্মিক ও মানসিক পরিশুদ্ধতার জন্য মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে রমযানুল মুবারক দান করেছেন। আত্মিক পরিশুদ্ধতা মানব জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেসব অপকর্ম আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, দেশও জাতিকে নানা সংঘাতও সংকটের দিকে টেলে দেয় এসব অপকর্ম থেকে নিজেকে মুক্ত করে সৃষ্টিকর্তার আদেশ-নিষেধ তথা আল্লাহর হুকুম আহকামের প্রতি নিজেকে অভ্যস্থ করার জন্যই মাহে রামযান। হিংসা-বিদ্ধেষ, পরশ্রীকাতরতা সর্বোপরি পাপচিন্তা এগুলো হলো মানসিক ব্যাধি। এসব ব্যাধি মানব জীবনও মানব সমাজকে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। ব্যক্তি জীবনে পরিশুদ্ধতা আসলে সমাজ পরিশুদ্ধও শান্তি পূর্ণ হতে পারে। আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবার, সমাজও রাষ্ট্রীয় জীবনে, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালতে এমনকি গোটা সমাজ দেহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে বসে আছে নানা অনৈতিকতা, অন্যায় অবিচার। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা বিদ্ধেষ পরশ্রীকাতরতার প্রভাব খুবই শক্তিশালী। এখানে মমত্ববোধ, ভালবাসা প্রায় দু®প্রাপ্য। মিথ্যা, পরনিন্দা ছাড়া যেন আমাদের সমাজ চলছে না। চাপাবাজি, ধোকাবাজি আমাদের সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এখানে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। ন্যায় ইনসাফ ও সততা ক্রমে বিদায় নিচ্ছে আমাদের জাতীয় সামাজিক অঙ্গন থেকে। অহরহ সংঘটিত হচ্ছে জুলুম অত্যাচার-অবিচার। অর্থনৈতিক অঙ্গনে আমানতদারী নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কারণে জাতীয় অর্থনীতি মারাতœক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে আমানতের খেয়ানত হচ্ছে। ঘুষ দুর্নীতি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এসব অপকর্মের কারণে মানুষের মধ্যে শান্তি নেই স্বস্তি নেই। আমরা যেন বেরিয়ে আসতে পারছিনা নীতিহীনতার এই দুর্ভেদ্য শৃংখল থেকে। এই রামযানরে মাস ব্যাপী সিয়াম সাধনার দাবি হচ্ছে সকল অন্যায়ও আল্লাহর অবাধ্য কাজ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলা। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদার গণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হয়ে যাও।’
অশ্লীলতাও একটি মারাতœক ব্যাধি। অশ্লীলতার সয়লাবে আমাদের যুবসমাজ মেধাশূণ্য হয়ে যাচ্ছে। বেহায়াপনাও নগ্নতাকে আধুনিকতা মনে করা হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এই নগ্নতাও বেহায়াপনার অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে যুব সমাজ। ইসলামী পোসাক এবং পর্দার বিধানকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। টুপি, দাড়ি, পাঞ্জাবী, বুরকা ইত্যাদি ইসলামী পোসাককে কলুষিত করার জন্য নানা অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। পর্দার বিধানের প্রতি নারী সমাজকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মাহে রামযান এসেছে মুক্তির বার্তা নিয়ে, পরিশুদ্ধ জীবন গঠন, শান্তি পূর্ণও পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত সমাজ বির্নিমানের সওগাত নিয়ে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যখন রামযান মাসের প্রথম রাত্রি আসে তখন শয়তান এবং অবাধ্য জিন সমূহকে কয়েদ করে রাখা হয়, দোযখের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং একটি দরজাও আর খোলা থাকেনা এবং বেহেশতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয় এবং এসবের একটাও বন্ধ থাকেনা। আর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতে থাকেন- হে পুণ্য অন্বেষনকারী! সামনে অগ্রসর হও, হে পাপান্বেষী! সংযত হও। আর আল্লাহ তায়ালা বহু লোককে নাজাত দান করেন।’
রমযান মাস মানুষের প্রতি ভালবাসাও সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। প্রতিদিনই আমরা মারামারি হানাহানি সংঘাত সংঘর্স প্রত্যক্ষ করছি আমাদের সমাজে। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের লাশ পাওয়া যায় রাস্তা ঘাটে। তুচ্ছ স্বার্থের কারণে মানুষ মানুষকে মারছে র্নিদয় ভাবে। আজ মানব সামাজ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের দ্বারাই। এর কারণ হলো আমাদের মধ্যে ধৈর্য, সহানুভুতি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন ইত্যাদি গুণাবলীর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই বৈশিষ্ট গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। ধৈর্য, মমত্ববোধও মানবতার প্রতি সহানুভুতি অতী উচ্চ মানবীয় গুণাবলী। মানুষকে ভালবাসলে, মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলে যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টিও নৈকট্য লাভকরা য়ায় অনুরূপ মানব সমাজে মানূষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই রামযান মাস আমাদেরকে ধৈর্যও মানুষের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শনের গুণ অর্জনের শিক্ষা দেয়। হাদীসের ভাষায় এ মাসকে বলাহয় ‘শাহরু মুয়াছাত’ অর্থাৎ পারস্পরিক সমবেদনা জ্ঞাপনের মাস। হযরত সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এই মাস ধৈর্যের মাস, আর ধৈর্যের পুরস্কার হচ্ছে একমাত্র বেহেশত এবং এই্ মাস পারস্পরিক সমবেদনা ‘াপনের মাস, এই মাসে আল্লাহ মুমিন বান্দার রিজিক বৃদ্ধি করে দেন। যে ব্যক্তি এই মাসে কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার যাবতীয় (সগীরা) গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং দোযখের আজাব থেকে সে নাজাত পাবে। আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে আমার হাউজে কাউসারের এমন পানি পান করাবেন যে, বেহেশতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে আর পিপাসা অনুভব করবে না।’ মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের কত চমৎকার নমুনা পেশ করেছেন রাসূল (সা.) রামজান মাসের মধ্যে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে দারিদ্রতার অক্টোপাশে বন্দী আমাদের সমাজের বহু মানুষ। অর্থের অভাবে অনেক মানুষ চিকিৎসা করাতে পারেনা, কঠিন রোগে আক্রান্ত অনেক রোগী, দারিদ্রতার অভিশাপে বন্দী অনেক প্রতিবন্দীকে আমরা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখি। অন্য দিকে একশ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত বিলাস বহুল জীবন যাপন করছেন। অর্থাৎ একই সমাজের মানুষ কেউ আছে পাঁচতলায় এবং কেউ আছে গাছ তলায়। সামাজিক বৈষম্যের এ বিভৎস চিত্র মুসলিম সমাজে কখনো কাম্য নয়। ইসলাম হচ্ছে মানবতার ধর্ম। ইসলামে মানব সেবাও মানব প্রেমের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে । রাসূল (সা.) বলেন, ‘সমস্ত মুসলমান জাতি মিলে একটা দেহের মত। একদেহের এক অঙ্গ যদি ব্যথিত হয় সারা অঙ্গ সেই ব্যাথা উপলব্দি করে। এক চোখে ব্যাথা হলে সারা শরীর সে ব্যাথা উপলব্দি করে। মাথায় ব্যাথা হলে সারা দেহ সেই ব্যাথা অনুভব করে।’ অর্থাৎ গোটা মুসলমান জাতি মিলে এমন এক একদেহ যে, কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু আমরা আজ রাসূল (সা.) এর সেই অনুপম আদর্শের উপর কতটুকু আছি? মাসব্যাপী সিয়ামসাধনার দাবী হল দুখী মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা, নিস্ব নিরন্ন অসহায় বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্যে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। একারণেই অসহায় মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু রাসূলে মাকবুল (সা.) রামযান মাস কে পারস্পরিক সমবেদনা জ্ঞাপনের মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে স্বীয় দাস-দাসী, চাকর বাকরের বোঝা হালকা করেদেবে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেন এবং তাকে দোযখ থেকে মুক্তি প্রদান করেন।’ পবিত্র রমযানের এই শিক্ষা এবং দাবী সমূহ যদি আমাদের সমাজে যথাযথ ভাবে প্রচলিত থাকত তাহলে ব্যক্তিও সমাজ অনেক উপকৃত হত, রাস্তার পাশে ফুটপাতে মুখ গুজে কাঁদতে হতনা অসহায় মানুষ গুলিকে।
রমযান মাসের রোজা মানুষের একনিষ্টতার উপর র্নিভরশীল। আল্লাহর হুকুমের প্রতি মানুষ একনিষ্ট না হলে রোজা পালন করতে পারবেনা। মানুষ সিয়াম সাধনা করে কেবল আল্লাহর জন্য। হাদীসে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন যে, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষ কেবল আমার উদ্দেশ্যেই রোজা রেখে তার প্রবৃত্তি দমন করেছে এবং পানাহার ত্যাগ করেছে। সুতরাং এর পুরস্কার আমি নিজেই (যত ইচ্ছা) দান করব।’ সহনশীলতা ও রোজাদারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট। রাসূল (সা.) বলেন, ‘রোজাদারের জন্য উচিৎ গালি-গালাজ হতে বিরত থাকা এবং চিৎকার করে কথা না বলা। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে আসে তখন সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার ব্যক্তি।’ এই একনিষ্টতা এবং সহনশীলতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের জন্য এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজন। এই মহৎ গুণ গুলো যদি আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমানে থাকত তাহলে জাতীয় সমাজিক ভাবে আমরা অনেক ঝগড়া বিবাদও ফিৎনা ফাসাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারতাম।
পরিশেষে বলব, মাহে রামযানের মর্যাদা এবং ফজিলত মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কারণে। রমযান মাস পবিত্র কোরান নাজিলের মাস। রমযানুল মোবারকের আহবান হলো ‘আল কোরআনের সমাজ গড়।’ আমরা যদি আল কোরআনের রঙ্গে আমাদের ব্যক্তি জীবন, সমাজও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সাজাতে পারি তাহলে আমরা হব শ্রেষ্ট মানুষ, শ্রেষ্ট জাতি। ইতিহাস আমাদেরকে শ্রেষ্টত্বের মর্যাদা দেবে, সম্মানের আসনে আমাদেরকে বসাবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
ওলীউর রহমান
লেখক, প্রাবন্ধিক, সিলেট।
মোবাইলঃ ০১৭১৪-৬০৮৭২৬