নগরীর ফুটপাত : নাম ভাঙানো হয় নেতার, পেটভরে পুলিশের

2নুরুল হক শিপু :: ওদেরকে কিছুতেই সরানো যায় না। তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়, মন্ত্রী-এমপিরা নির্দেশ দেন, ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উচ্ছেদের আশ্বাস দেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের উচ্ছেদ করা হয়; কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের জন্য। তারপর যথা পূর্বং তথা পরং। তারা আবার যথাস্থানে এসে বসেন। ওরা হচ্ছেন, নগরীর হকার তথা ভাসমান ব্যবসায়ীরা। নগরীর কেন্দ্রস্থলের সবকটি ফুটপাত দখল করে কয়েক দশক ধরে দখল করে আছেন। স্থায়ীভাবে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয় না। উচ্ছেদ-নাটক হয় মাত্র।
ফুটপাত থেকে হকারদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ না করার মূলে রয়েছে অনেকের আর্থিক স্বার্থ। আছে প্রতিমাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা বখরার ভাগবাঁটোয়ারা। এ কারণেই হকাররা ফুটপাত দখল করে নির্বিঘেœ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নগরীতে বর্তমানে ৯ শতাধিক হকার ফুটপাত দখল করে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছেন। ওই হকার ও খুদে দোকানিদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হয়। যার গড় পরিমাণ মাসে দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকার উপরে। চাঁদার বড় একটি অংশ পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। তবে হকারদের উচ্ছেদে বর্তমানে কোনোই পদক্ষেপ নিচ্ছে না সিলেট সিটি কর্পোরেশন কিংবা সিলেট মহানগর পুলিশ। যার কারণে বখরাবাজরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। তিনজন হকার নেতার প্রশ্রয়ে ৩০ জনের একটি গ্রুপ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকার হকার ও খুদে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বখরা আদায় করেন। তারা বখরাবাজির সময় সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের এবং শ্রমিক লীগের একজন শীর্ষ নেতার নাম ভাঙাচ্ছেন বলে একাধিক হকার জানিয়েছেন।
সিলেট মহানগরীর তালতলাস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামন থেকে চৌহাট্টা পয়েন্ট, কিনব্রিজের উত্তর পাশের মোড় থেকে বন্দরবাজারের পোস্ট অফিস হয়ে সিলেট ওসমানী শিশুপার্ক, মধুবন মার্কেট থেকে জেল রোড এবং চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে আম্বরখানা এলাকায় প্রতিদিন ৯’শ হকার ও খুদে দোকানিরা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। ওই ৯’শ হকারের মধ্যে রয়েছেন, কাপড়, জুতা, প্রসাধনী, শাকসবজি, পেঁয়াজ-মরিচ ও বিভিন্ন কাঁচামাল, ফলমূল, সিডি-ভিসিডি, বইপত্র, পান সিগারেটসহ হরেক রকমের ব্যবসায়ী। এর মধ্যে পান সিগারেটের ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ৩০ টাকা, কাঁচামাল ও সবজির দোকানিরা ৩০ থেকে ৫০ টাকা, কাপড় ও জুতার দোকানিরা ৩০ থেকে ৫০ টাকা, ভ্যানের মাধ্যমে কাঁচামাল বিক্রেতারা ৩০ থেকে ৫০টাকা, ফল ব্যবসায়ীরা ৩০ থেকে ৫০ টাকা এবং অন্যান্য খুদে ব্যবসায়ীরা সর্বনি¤œ ২০টাকা করে বখরা দিয়ে যাচ্ছেন।
বখরার ওই টাকার একটি অংশ প্রতিদিন আদায় করেন হকার্স লীগের সহ-সভাপতি রাকিব আলী ও তার সহযোগীরা। তারা সংখ্যায় প্রায় ৩০ জন। তাদের মধ্যে আছেন আতিয়ার হোসেন, খোকন মিয়া, রফিক, লিটন, লাহিন প্রমুখ। তারা টাকা তোলে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে জমা দেন। পুলিশ ফাঁড়িতে টাকা জমা নেওয়ার  একজন দায়িত্বশীল আছেন। তার অঘোষিত পদবি ‘ক্যাশিয়ার’।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাংবাদিক পরিচয়দানকারী কতিপয় ৮ থেকে ১০ জন হকার্স লীগের ওই নেতা ও ফাঁড়ি পুলিশের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা নেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাজ হচ্ছে ফুটপাত তৈরি করে দেওয়া। আমরা তা করছি। আর হকার উচ্ছেদ করতে হলে প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ। পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনকে বারবার বলেছি, হকার উচ্ছেদের ব্যাপারে। কিন্তু কোনো উদ্যোগ তারা নিচ্ছেন না। তারা উদ্যোগ নিলে সিটি কর্পোরেশন তাদের সার্বিক সহযোগিতা করবে।
মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. ফয়সল মাহমুদ সবুজ সিলেটকে বলেন, মূলত রাস্তার মালিক পুলিশ নয়। হকাররা রাস্তায় পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করছে। নগরীর সৌন্দর্য রক্ষার জন্য যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাস্তার মালিক তাদেরকে উদ্যোগী হয়ে হকারদেরকে রাস্তা থেকে তোলে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পুলিশ তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করবে। একই সাথে যারা রাস্তার পাশের হকারদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করেন তাদেরকেও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা সবজি কিনতে হলে সবজির বাজারে, কাপড় কিনলে নির্দিষ্ট মার্কেটে গেলেই পারেন। এতে হকাররা এমনিতেই ফুটপাতে বসবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি ফুটপাতের হকার ও খুদে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেউ চাঁদা তোলেন আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব। বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ যদি হকারদের কাছ থেকে বখরা নিয়ে থাকে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ও তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
অবশ্য নিজের বিষয়ে এমন অভিযোগ মিথ্যা বলে জানিয়েছেন হকার্স লীগের সহসভাপতি মো. রকিব আলী। তিনি বলেন, মহানগর হকার্স কল্যাণ সমিতির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আওয়ামী লীগের কোনো সিনিয়র নেতার নাম ভাঙিয়ে তিনি কোনো বখরা আদায় করছেন না। তিনি বলেন, তাদের সমিতি থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তি আনা হয়। পুলিশ ফাঁড়িতে তিনি নিজে বখরার একটা অংশ ক্যাশিয়ারকে দেন কি না জানতে চাইলে বলেন, আমি কেন বখরা তোলে পুলিশকে নিয়ে দেব। পুলিশ যদি বখরা তুলে আপনারা পুলিশের সাথে কথা বলুন। তাঁর সাথে আতিয়ার হোসেন, খুকন মিয়া, রফিকসহ কয়েকজন হকারদের কাছ থেকে বখরা তুলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের কথা বলছেন তারা সকলেই মহানগর হকার্স কল্যাণ সমিতির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নজরুল ইসলাম বলেন, ফাঁড়িতে কোনো ক্যাশিয়ার পদ নেই। আগে জাকির হোসেন নামে একজন ছিলেন তাকে একমাস আগে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে কোনো ক্যাশিয়ার নেই। তিনি বলেন, আমরা হকারদের উচ্ছেদ করতে অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু তারা আবার বসে যায়। তিনি বলেন, ফাঁড়ি পুলিশ ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে কোনো বখরা নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা।