সিলেটে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতে দেড় শতাধিক বহুতল ভবন
ফায়ার সেফটির সকল নিয়ম মানা হয়নি একটিতেও
নুরুল হক শিপু :: সিলেট মহানগরীতে ফায়ার সার্ভিসের আইন না মেনে একের পর এক বহুতল বাণিজ্যিক, আবাসিক ও বাণিজ্যিক-আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আইন মতে, ছয় তলার অধিক নির্মিত ভবন বহুতল হিসেবে চিহ্নিত। মহানগরীতে এমন ভবনের সংখ্যা বর্তমানে দুই শতাধিক। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) শতভাগ আইন মেনে একটি ভবনও নির্মাণ করা হয়নি। অবশ্য শতকরা ২০টি ভবনে অগ্নিনির্বাপণ (ফায়ার সেফটি) ব্যবস্থা থাকলেও ভবনগুলোতে বিএনবিসির শতভাগ আইন মানা হয়নি। যদিও কয়েকটি ভবনকে সিলেটের ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকার তালিকায় রেখেছে। এ রকম ভবন সর্বাধিক পঞ্চাশটি হতে পারে।
সিলেট ফায়ার সার্ভিস অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের শতভাগ আইন মেনে সিলেটে একটি ভবনও নির্মাণ করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি নিয়মের মধ্যে কোনো কোনো ভবনে ১৩টি, কোনোটিতে ২০টি, কোনোটিতে ৬টি আবার কোনো ভবনে একটি নিয়মও মানা হয়নি। অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না রেখেই মহানগরীতে গড়ে ওঠা একের পর এক বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়; গড়ে ওঠা এসব বহুতল ভবনের অনেকটিতে নেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চূড়ান্ত ছাড়পত্র। একটি বহুতল ভবনে পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হলে প্রয়োজন হচ্ছে, বাতাসের চাপযুক্ত (পজেটিভ প্রেসারাইজড ফ্যান) জরুরি নির্গমন পথ, ফায়ার ডোর, ফায়ার ডিটেকশন ও এলার্মিং সিস্টেম, পাবলিক এডসে (পিএ) সিস্টেম, রাইজার, স্প্রিংকলার, পাম্পসহ পানির ট্যাংকি। এর মধ্যে স্প্রিংকলার হচ্ছে, পাইপ লাইনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আগুনের তাপে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেটে চারদিকে পানি ছড়িয়ে পড়া।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের কাছে নগরীর প্রস্তাবিত, নবনির্মিত ও নির্মিত দুই শতাধিক বহুতল ভবনের তালিকা রয়েছে। এ তালিকার মধ্যে প্রায় ১শটি ভবনের মালিক ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রাথমিক অনুমোদন নিয়েছেন। এই অনুমোদনে ভবন মালিকদের সেফটি প্যান বাস্তবায়নে দেয়া হয় ২৯টি শর্ত। শর্তগুলো পূরণ করে ফায়ার সার্ভিসকে অবগত করলে ভবন পরিদর্শন করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ভবন মালিকেরা চুড়ান্ত ছাড়পত্র নেননি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ বলছেন, যেসব বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, সেগুলো এবং নতুন নির্মাণাধীন বহুতল ভবন নিয়মিত তারা পরিদর্শন করছেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত বহুতল ভবনগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বহুতল ভবন নির্মাণের সময় মালিকদেরকে ছাড়পত্র দেয়ার পাশাপাশি সাথে ফায়ার সেফটি ফ্লোরপ্ল্যান প্রদান করেন। তারা সে অনুযায়ী নীতি বাস্তবায়নের বিষয়টিও বলে দেন। এরপরও ভবন মালিকরা তা বাস্তবায়ন করেন না। এমনকি ভবনে আগুন লাগলে বাইরে যাওয়ার সিঁড়িটিও তারা নির্মাণ করেন না। যার কারণে বহুতল ভবনে বড় ধরনের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে ভবনের সাথে বাসিন্দারাও জীবন ঝুঁকিতে রয়েছেন।
সূত্র মতে, নগরীর শাহজালালা উপশহরের রোজ ভিউ হোটেল, গার্ডেন টাওয়ার, দরগা গেইটস্থ নূরজাহান হাসপাতাল, হোটেল স্টার প্যাসিফিক, মিরের ময়দানের লারোজ হোটেল, তালতলা তেলিহাওরস্থ পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জিন্দাবাজারস্থ আল-হামরা শপিং সিটি, কাকলী শপিং সেন্টার, মির্জাজাঙ্গালের হোটেল নির্ভানা ইন, সোবহানিঘাটের রহিম টাওয়ার ও হিলসাইডসহ কয়েকটি ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে।
কিন্তু মজুমদারি এলাকার বিএম টাওয়ার, দরগা গেইট এলাকার শাহজালাল কমপ্লেক্স, হলি কমপ্লেক্স, জিন্দাবাজারের ব্লু-ওয়াটার, ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড শপিং সিটি, গ্যালারিয়া শপিং কমপ্লেক্স, মিলেনিয়াম মার্কেট, হোটেল গোল্ডেন সিটি, এলিগ্যান্ট সিটি, আল-মারজান শপিং কমপ্লেক্স, জামতলা পয়েন্টে তামিম টাওয়ার, জল্লারপারের রূপায়ণ রাতুল প্লাজা, জেল রোডস্থ আনন্দ টাওয়ার, মিরবক্সটুলাস্থ উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পূর্ব জিন্দাবাজারস্থ সিলকো টাওয়ার, করিম টাওয়ার, সিম্ফোনি হাউস, হওয়াপাড়া এলাকায় আর্ক রিয়েল স্টেট, মাহমুদ টাওয়ার, কমরিয়া ভবন, কাজি ইলিয়াস এলাকায় মর্নিং গ্যালারি, ভূঁইয়া টাওয়ার, তাঁতিপাড়ায় খালেদ মঞ্জিল, আম্বরখানা এলাকাস্থ শিরিন টাওয়ার, পার্লি গেইট, সুরাইয়া টাওয়ার, পান্থ-১, পান্থ-২, সোবহানিঘাটের আলফা টাওয়ার, শাহজালাল উপশহরে মাল্টিপ্ল্যান এবং কাষ্টঘর এলাকায় বন্ধু নিবাস ভবনসহ প্রায় ১৮০টি ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। এর ফলে অগ্নিকা-ের জন্য এসব ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম সবুজ সিলেটকে বলেন, ‘সিলেটে দুইশ’র অধিক বহুতল ভবন রয়েছে। বেশিরভাগ ভবনে ফায়ার সেফটি নেই। ফায়ার সেফটি না থাকায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে ভবন ও বাসিন্দাদের রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। সিলেটে বেশিরভাগ সময় ইলেক্ট্রটিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এর মূল কারণ বিদ্যুৎকর্মীরা ভালোমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। তাদেরকে উচ্চমানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে সিলেট সার্কিট হাউসে আগুন লেগে দুটি কক্ষ পুড়ে গেল। সার্কিট হাউস পুড়বে কেন? ভালোমানের কাজ হলে আগুন লাগার কথা নয়।’
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ‘বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সিসিকের পক্ষ থেকে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়।’
সিলেট ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. জাবেদ আহমদ তারেক বলেন, ‘ আমরাতো আছি সবার জন্যই। এরপরও যেসব ভবন ছয় তলার উপরে রয়েছে সেগুলোর আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ভবন মালিকদের ফায়ার সেফটি দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। আর আমাদের কাছে যেসব সরঞ্জাম রয়েছে তা দিয়ে আমরা তিনতলা পর্যন্ত আগুন নেভাতে পারি। এরপরও আমরা কৌশলে বহুতল ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা যখন ছাত্রপত্র দিই, তখন ফায়ার সেফটির সকল শর্ত তাদেরকে জানিয়ে লিখিত কপিও দেয়া হয়। কেউ ছাড়পত্রের শর্ত পালন করেন আবার অনেকেই করেন না। সিলেট মহানগরীতে দুই শতাধিক ভবনের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ ভবনের ফায়ার সেফটি নেই। এসব ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা ছাড়পত্রের শর্ত পালন করেন না, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারি। সিলেটে তা করা হচ্ছে না কেন-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জনবল সংকট। জনবল সংকটের কারণে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারি না।’