কবরের ওপর ঘর-সংসার!
ডেস্ক রিপোর্টঃ ঘরের মেঝেতে কবর, উঠানে কবর, এমনকি রান্নাঘর কিংবা গোসলখানায়ও কবর। পরিবারের প্রয়াত স্বজনের কবরের ওপরই জীবিত মানুষের ঘর-সংসার। এমন অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার মৎস্যজীবী সরদারপাড়ার বাসিন্দারা। কবর দেওয়ার জন্য এক টুকরো জমি না থাকায় নিরুপায় হয়ে মৃত স্বজনদের মরদেহ ঘরের মধ্যে, বারান্দায়, উঠানে কিংবা রান্নাঘরের পাশেই কবর দিতে হচ্ছে তাদের। আর এ বিস্ময়কর প্রথা চলছে একশ’ বছর ধরে। একদিকে রান্নাঘরে চুলা জ্বলছে আর তার পাশেই একাধিক কবর। কোনো কোনো ঘরের মেঝেতে বাবা-মা কিংবা স্বজনের কবর। তার ওপর বছরের পর বছর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এমনও ঘর আছে ওই পাড়ায়, যে ঘরের মেঝেতে ১২ জনেরও বেশি স্বজনকে সমাহিত করা হয়েছে। মৃত স্বজনের কবরের ওপরই চলছে সরদারপাড়ার ৩০০ পরিবারের ঘরবসতি। সহস্র নারী-পুরুষ ও শিশুর নিত্যদিনের নীরব কষ্টের এমন জীবন-জীবিকার চিত্র কিছুতেই যেন পৌঁছাতে পারছে না প্রশাসন কিংবা সমাজের মানবিক দৃষ্টিতে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়া ইউনিয়নের হলতা নদীর পাড়ে মৎস্যজীবী সরদার সম্প্রদায়ের বসবাস। শতাধিক বছর আগে এ সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো নৌকায় ভাসমান জীবনযাপন করত। নদীতে মাছ ধরা ছিল তাদের প্রধান পেশা। পরে হলতা নদীর পাড়ে বর্তমান আমুয়া বন্দরের পাশে বসবাস শুরু করে তারা খুঁজে পায় স্থায়ী ঠিকানা। তবে প্রায় দুই একর ওই জায়গাও সরকারি। শত বছর ধরে সরদার সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো বসবাস করায় এখন কেউ আর ওই জমির মালিকানা দাবি করছেন না। কাঁঠালিয়া উপজেলা সদরের উন্নয়ন ও সমাজকর্মী মো. ফারুক হোসেন বলেন, সরদারপাড়ার ইতিহাস দীর্ঘ বছরের। শত বছর আগে তারা নদীতে নৌকায় বসবাসরত জেলে সম্প্রদায় ছিলেন। বিষখালী-বলেশ্বর নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মানতা বা সান্ধার গোত্রের অনুসারী হলেও ধীরে ধীরে সরদার সম্প্রদায়ের লোকজন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপন করতে শুরু করেন। কিন্তু অদৃশ্য এক সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় উপজেলার সর্বজনীন কবরস্থানে ঠাঁই হয় না এ সম্প্রদায়ের মৃত নারী-পুরুষ কিংবা শিশুর। সরদারপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা আবদুল হাই সরদার জানান, প্রায় দুই একর জমিতে তারা তিন শতাধিক পরিবার বসবাস করছেন, যা একরকম নিত্যদিনের দুঃসহ জীবনযাপন। এক ঘরের বৃষ্টির পানি আরেক ঘরের চালায় পড়ে। যেখানে নিজেদের থাকার অবস্থাই এমন করুণ, সে কারণে আলাদা কবরস্থানের জায়গা নেই তাদের। তাই বাধ্য হয়েই স্বজনদের কবর দিতে হচ্ছে ঘরে, আঙিনায়, বারান্দায়। আবুল সরদার নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার শাশুড়ি ফাতেমা বিবিকে পাঁচ-ছয় বছর আগে বারান্দায় করব দিছি। আমি মরলে হয়তো শাশুড়ির কবরের ওপরে দাফন অইবে।’ মো. জালাল সরদার বলেন, ‘ঘরের মধ্যে স্বজনদের কবর, তার ওপরে বিছানা করে ঘুমাইতে হয়। ছোট ছোট শিশু মাঝেমধ্যে ভয়ও পায়।’ এ পাড়ার বাসিন্দা আবদুস সালাম সরদার ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম জানান, কবরস্থানের জমি না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা ৮-১০ বছর আগে অনেক কবরের ওপর মাচান ঘর তুলে বসবাস করছেন। তাদের ঘরের নিচে ছয়-সাতটি কবর আছে। পাড়ার অপর বাসিন্দা আ. সালাম জানান, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের দুই-তিন মাস আগে তার মা জহুরা বিবি মারা যান। নিজস্ব বাড়তি জায়গা না থাকায় ঘরের বারান্দায় মায়ের লাশ দাফন করেছেন। ইলিয়াস সরদার বলেন, তিন-চার বছর আগে তার নানি ফতেজান বিবি মারা যান। জমি না থাকায় বসতঘরের মেঝেতে তাকে দাফন করা হয়েছে। ঘর, বারান্দা কিংবা রান্নাঘরে মরদেহ দাফন করা হলেও নানা কারণে ঘরের মধ্যে কবরের চিহ্ন রাখা হয় না। স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আখতার হোসেন নিজাম মীরবহর সরদারপাড়ার বাসিন্দাদের করুণ জীবনযাপনের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তিনি বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও জমি সংকটের কারণে সরদারপাড়ার জন্য একটি কবরস্থান নির্মাণ করতে পারেননি। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক রবীন্দ্র শ্রী বড়ূয়া বলেন, বিষয়টি অমানবিক এবং কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেখানে কবরস্থানের জায়গা নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। সুত্রঃ -সমকাল