মাকে মনে পড়ে মায়ের ভালোবাসার কারণেই : পি.আর.প্ল্যাসিড
মাকে নিয়ে আমি এ পর্যন্ত কোথাও কারো সাথে ভালো-মন্দ কোন প্রকার মন্তব্য করিনি। প্রত্যেক সন্তানের কাছেই তাদের মায়েরা হয় ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অদ্বিতীয় এক মহিয়শী মহিলা। এটা আমরা পুস্তকী ভাষায় বলে থাকি, মা তার গর্ভে আমাদের দশ মাস দশদিন ধারণ করেছিলেন, এই জন্যই। কিন্তু জন্মতো দেন কত দিকে কত মা কত সন্তানকেই। এমনতো দেখা যা যায়, মা তার সন্তানকে কোন কারণে হত্যা করছে গলা টিপে। কোন সন্তানও আবার হত্যা করছে কোন কারণে তার মাকে। এমন ঘটনার সংবাদ পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যে দেখা যায়। এসব কোন সুস্থ্য ঘটনা না। এসবকে বলা যায় অস্বাভাবিক বা দুর্ঘটনা।
ঘটনা হলো সেটাই, মা তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের রক্ত দেন, চক্ষু দেন কিম্বা কিডনী দেন। এমন মায়েদের তুলনা হয় না। আমার মার সাথে এখনো আমার এমন কোন কিছুর লেনদেন ঘটেনি। তার পরেও মা আমাকে যা বলেছিলেন আমার উঠতি বয়সে, যে বয়সে ছেলেরা খুব বেশী খারাপ হয়ে যায়, সেই কথাই আমার মনে আছে এখন পর্যন্ত। যেই কথার মর্ম দেওয়ার জন্য খারাপ হবার মতন কিছু করিনি। এই জন্যই মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসা যত না, তার চেয়ে শ্রদ্ধার ভাগটি একটু বেশীই বলা যায়।
দেশে ছাত্রাবস্থায় একদিন ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি গেলাম। বাড়ি যাওয়া মানেই বাড়ি থেকে অনেক দূরে বন্ধদের কাছে তাদের মেলে চলে যাওয়া, যেখানে গেলে আড্ডা জমতো। সেদিন বাড়িতে গিয়ে কাপড় বদলিয়েই মাকে বলেছিলাম, আমি ঘুরে আসি। মা আমার পথ আটকে দিলেন পিছন থেকে ডেকে। মার কোন কথা শোনার আগেই পছন্দ-অপছন্দর হবে কি না কিছুই ভাবি নি। পিছন থেকে মায়ের ডাক শুনে তাকালাম মায়ের দিকে। মা বললেন, বাইরে যাবি যা। কিন্তু তোর সাথে কিছু কথা বলা দরকার। মাকে বললাম কি বলতে চাও বলো।
মা বললেন তোর নামে কিছু বাজে কথা শুনছি, আসলে এসব কথার কতটা সত্য তোর মুখেই জানতে চাই। তোর বাবাও আমাকে বলছে তোর কাছে জানতে।
বাবা এলাকার মাতব্বর। সুনাম ছিল বেশ। নির্বাচনের আগে পরে মন্ত্রীরা বাড়ি এসে ভোট চাইতেন তার কাছে, আবার ধন্যবাদও জানাতেন নির্বাচনে জয়ী হয়ে। সব মিলে বাবা কোথাও গিয়ে আমার জন্য মাথা হেট করতে চান না। আমি এমন কোন অপরাধ যদি করেই থাকি, তবে আগে থেকে জানা থাকলে মানুষের সাথে কথা বলতে পারবেন তেমন শক্ত ভাবেই। এই জন্যই না কি বাবা মাকে জানতে বলেছিলেন। সেদিন মাকে খুব সহজ সরল উত্তর দিয়েছিলাম, তোমার বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি মা। সেই দুধের দাম দিতে পারবো না তবে দুধের অসম্মান করবো না সজ্ঞানে। এটুকু বিশ্বাস রেখো। আর জন্ম যদি ঠিক হয় তবে বাবাকে বলে দিও আমার যে কোন কাজে বিনা দ্বিধায় চ্যালেঞ্জ করতে। কিছু যদি করেই ফেলি মনের অজান্তে, তাহলে মাথা হেট হবার আগেই তোমাদের কাছে স্বীকার করবো। এ নিয়ে বাবাকে টেনশন করতে না করে দিও।
এরপর থেকে মা আমার কোন কাজ নিয়ে কথা তুলেন নি। এখনো না। তবে মানুষ হিসাবে কিছু কিছু ভুল হবে না যে এই কথা বলছি না। মানুষের সাথে চলতে গেলে এবং মানুষদের নিয়ে কাজ করলে ভুল কিছু হতেই পারে। তবে সেসব ভুল বাবা-মার মুখে কালি লেপনের পর্যায় পরে না। এখনো আমি যা করি না কেন, মা আমার সব কাজের কথা জেনে বা না জেনে পাশে থেকে শক্তি যোগানোর জন্য খুব শক্ত ভূমিকায় অবস্থান করছেন। আমার সম্পর্কে মায়র কােেছ কেউ কিছু বললে, মা তার প্রতিবাদ করেন খুব শক্ত ভাবে। এসব চিন্তা করেই কখনো অন্যায়ের দিকে আমার পা চলে নি। আর চলবেও না।
মায়ের বয়স এখন প্রায় নব্বই এর কাছাকাছি। মৃত্যু যেন এখন তার ঘুম ভাংলেই। তারপরেও মাকে দেখি আমার পক্ষ নিয়ে পরিবারে অন্যদের সাথে কথা বলতে। একদিন মা তার আপন এক আত্মীয়কে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে মানুষ কি সব কথা বলে তার সত্যতা জানতে চেয়েছিলেন। আমি মাকে সেদিনও সব কথা বলেছিলাম খুলে। বিষয়টি কে কিভাবে নিবেন, জানি না। তবে আলোচনায় তুলে আনার কারণ, মা আমাকে একটি কথাই বলেছিলেন, দুনিয়ার সব মানুষের কাছে কোন কিছু গোপন করলেও আমার কাছে কোন কিছু গোপন করিস না, আমার সাথে মিথ্যা কথাও। সেই থেকে মায়ের কাছে অনেক কথা হয়তো বলা হতো না কিন্তু গোপন করার চেষ্টা বা মিথ্যা না বলার চেষ্টা করেছি। এই জন্যই মা আমাকে মনে করি বেশ ভালোবাসেন।
আমরা নয় ভাইবোন। নয় ভাইবোনের মধ্যে আমি অষ্টম স্থানের অধিকারী (হা হা হা)। মা সব ছেলে মেয়েকেই সমান ভাবে ভালোবাসার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চেষ্টা করলেও তা কখনোই হবার নয়। আমি বরাবর মায়ের কাছ থেকে দূরে ছিলাম তাই ভালোবাসার পরিমানটাও মনে করি আমার প্রতি অন্যদের তুলনায় কিছুটা হলেও কম। তবে আমি মায়ের কাছ থেকে যে টুকু ভালোবাসা পাই, সেটুকুকেই আমি খুব বড় করে দেখি। মনে করি বাকী আট জনের থেকে বেশী ভালোবাসা দেন মা আমাকে।
দেশে গিয়ে আমি যখন বাড়ি যাই, এই বয়সেও বাড়ি গেলে মা আমার জন্য কি করবেন, কি খাওয়াবেন এই ভাবনায় অস্থির থাকেন সর্বক্ষণ। পুরো এলাকায় মায়ের বয়সী কোন লোক আর এখন নেই। তারপরেও কতটা যে শক্ত অবাক হয়ে যাই মায়ের নড়াচড়া করতে দেখে। মা জানেন, আমার প্রিয় খাবার নাড়িকেলের নাড়– আর পাটি শাপটা পিঠা। এই নাড়ু আর পিঠা খাওয়ানোর জন্য মা খুবই অস্থির থাকেন আমি গেলে । আর রান্নাতো করেন দেখি কত কষ্টে। তবুও ছেলেকে নিজে রান্না করে খাওয়াতে পারলেই যেন মা খুশী।
জাপান থেকে দেশে যাবার সময় প্রায়ই বলি, এবার দেশে গিয়ে গ্রামে মা-বাবার সাথে সপ্তাহে তিন রাত থাকবো। কিন্তু দেশে গেলে কাজের চাপে আর বাড়িতেই যাওয়া হয় না। অবশ্য বাড়ি না যাওয়ার পিছনে অন্য কারণ হচ্ছে জাপানের সাথে যোগাযোগ করার জন্য নেটওয়ার্ক সুবিধা পাই না। এই জন্যই মা বাবার সাথে আর গ্রামে গিয়ে খুব একটা থাকা হয় না। এমনকি দেখা না করেই চলে আসতে হয় জাপান।
মা দিবস এলে পৃথিবীর লক্ষ কোটি মায়ের সন্তানেরা তাদের প্রিয় মায়ের জন্য ফুলেল শুভেচ্ছা বিলিয়ে দেন। ভালোবাসা প্রদর্শণের জন্য অনেক কিছুই করেন। স্বামর্থ অনুযায়ী অনেকে অনেক কিছু করেন জানি কিন্তু আমার বেলায় ততটা কিছু করা হয় না। মাকে আমি একটা কথাই বলার চেষ্টা করি, ”আমার জন্য তোমাদের দু’জনের আশীর্বাদ থাকলে আর কিছুরই আমার দরকার হয় না, দরকার হবেও না।
বিদেশে মাঝে মধ্যে যখন খুব কষ্টে থাকি, তখন মার কথাই মনে পড়ে বেশী। (আমার ”দিনগুলি মোর” বইতে সুন্দর করে বিষয়টির উপস্থাপন করা হয়েছে)। বিদেশে এসেছি ২৪ বছর প্রায় পেরিয়ে গেলো। এত লন্বা সময় আমি বিদেশে থাকবো সেটা আসার আগেও কখনো ভাবি নি। ভেবে ছিলাম দেশে ফিরে গিয়ে দেশের সেই রেখে আসা আমার অসম্পূর্ণ এক গরিবী ভালোবাসাকে পূর্ণ রূপ দেবো সামাজিকতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। অপ্রিয় সত্য কথা হল্ওে, বিষয়টি আর পূরণ করা হয়নি পরিবারের অন্য কেউ সমর্থণ করেনি বলে। বাধ্য হয়ে মনের দুঃখে সবার থেকে দূরে পড়ে আছি নিজেকে ব্যস্ত রেখে। যেই ব্যস্ততা আমকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা আর দিয়েছে কিছুটা হলেও পরিচিতি।
কিন্তু শত হলেও আমরা বাংগালী যে। বাংগালীর পুরো বাংগালীত্বর প্রমাণ মিলে বাবা মা ভাই বোন সবাইকে নিয়ে থাকতে পারলে। এই একটি জায়গাতেই মনে হয় বাবা মা ব্যর্থ আমাকে তাদের কাছাকাছি রাখতে না পেরে। তারা ব্যর্থ না হলে হয়তো আজকের অবস্থানের উল্টো হতো আমার অবস্থান। চব্বিশ বছরে মনে হয় আমার ভিতরের যে আরেকটা প্ল্যাসিড আছে সেই প্ল্যাসিডের চিন্তা চেতনা অনেকটাই বাস্তবতার কারণে জাপানীজদের মতনই কঠিন হয়ে গেছে। যে কারণে বাবা-মার জন্য এখন আর আগের মতন মন কাঁদে না, তবে এটা সত্যি যে মায়ের জন্য মন খুব টানে।
মাকে আমি ভালোবাসি এই কথা সত্য। তার চেয়ে মার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা যে আছে এটা অনেক বেশী সত্য।
আজকাল আমি দেশে খুব ঘনঘন যাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ নিয়ে। যে জন্য দেশের প্রতি মন চলে যায় প্রতিদিন প্রতি মূহুর্ত। বিদেশে বসে মার কথাও আমার মনে পড়ে আজকাল খুব বেশী। এই মনে করার কারণ আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসা। একটি কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মায়ের ভালোবাসা আর উদারতার কারণেই আমার এই আজকের অবস্থানে আসা।
আমাদের দেশে আজকাল বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে বিভিন্ন মায়েদের ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয় স্বর্ণ গর্ভা মা বলে। এটা যে কোন মায়ের জন্য বিশাল এক পাওয়া। যে কোন মা এই পুরুষ্কারের প্রত্যাশা করেন এতে ভুল নেই। পুরুষ্কারটি কোন টাকা বা সার্টিফিকেট দিয়ে তুলনা করা সম্ভব না। একমাত্র মায়ের চাওয়া তার সন্তান হোক সৎ ও প্রতিষ্ঠিত। সবাই তার সন্তানকে ভালো বলুক। আর সন্তুন তার প্রত্যাশা পূরণ করলেই পাওয়া হয় মায়েদের পুরুষ্কার।
আমি আমার সেই প্রত্যাশিত সন্তান হতেই চেষ্টা করেছি, হতে পারি নি। তবে হাল ছারি নি। এখনো চেষ্টা করেই চলেছি।
তবে এখন প্রতিটি মায়ের এই একই প্রত্যাশা থাকা উচিৎ। তাদের প্রত্যাশা হওয়া উচিৎ সন্তান হোক তাদের সৎ ও প্রতিষ্ঠিত। এই জন্য অবশ্যই মায়েদের ভূমিকাই হতে হবে সবচেয়ে বেশী। মা যদি প্রতিটি সন্তানকে যথাযথ ভাবে সুশিক্ষায় বড় করে তোলেন এবং মায়েরা যদি হয়ে উঠেন সন্তানদের প্রতি যত্নশীল তবে এক সময় এই পৃথিবী হয়ে উঠবে সুন্দর ও শান্তিার আবাসস্থল।
পি.আর.প্ল্যাসিড: জাপান প্রবাসী লেখক সাংবাদিক।