শাহ আব্দুল করিমের ৯৯তম জন্মদিন আজ
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ৯৯তম জন্ম দিন আজ। এ উপলক্ষে শাহ আব্দুল করিম পরিষদের উদ্যোগে বিকেলে শাহ আব্দুল করিমের মাজারে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। শাহ আব্দুল করিম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফেষ্টুন বিতরণ করা হবে। বাউল সম্রাটের পুত্র শাহ নূর জালাল জানান, বিকেল তিনটায় আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল হবে। এতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত করিম ভক্তরা অংশগ্রহণ করবেন।
শাহ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধল আশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহীম আলী, মাতার নাম নাইওরজান বিবি। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শাহ আব্দুল করিম মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের শাহ্ আব্দুল করিম। উজানধল, কালনী নদী, রাখাল, দুঃখ, দারিদ্র, বঞ্চনা, বিচ্ছেদ বেদনা, অভাব অনটন, টানাপোড়েন, কাঁদামাটির মানুষের বাউল গান এই নিয়ে আব্দুল করিম।
শোষণ বঞ্চনা আর নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের হৃদয় নিংড়ানো কথা স্থান পেয়েছে তার রচিত গানে। গানের কথা, সুর, তাল, লয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেম বিরহ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সহ মানব জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে তার গানে।
কালজয়ী বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম গ্রামের অন্যদশটা পরিবারের মতো ছিলো না তার পরিবার। সংসারের অভাব অনটন, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থার মধ্যে বেড়ে ওঠেন করিম। পিতা ইব্রাহিম আলী ছিলেন কৃষক আর মাতা নাইওরজান বিবি ছিলেন সাদামাটা গ্রাম্যবধূ। ইব্রাহিম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে করিম ছিলেন একমাত্র ছেলে, বাকী ৫ জন মেয়ে।
উজানধল গ্রামের পাশদিয়ে বয়ে গেছে কালনী নদী। করিমের বাড়ি থেকে কালনীর দূরত্ব প্রায় ৫০ গজ। সারি সারি হিজল গাছ কালনীর ছোট ছোট ঢেউ যেকোন মানুষ কে বাউল দর্শনের কাছে জোর করে টেনে নিয়ে যাবে। প্রকৃতির এমন রূপদেখে বেরসিকের কণ্ঠেও অবচেতন মনে গুন গুন গান ভেসে আসবে। গান পাগল করিমের পরিপার্শ্ব ছিলো মন মাতানো রূপের। শেষ বিকেল অথবা ভরদুপুরে কালনীর তীরে বসে করিম রচনা করেছেন অসংখ্য বাউল গান।
ভাটিবাংলা খ্যাত সুনামগঞ্জের ছোট্ট উপজেলা দিরাইয়ের আব্দুল করিম রচিতগান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত ব-দ্বীপের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিয়েছে। আর তাই তো দিরাই শহরের ৫/৬ বছর বয়সের শিশুরা তাকে চেনে করিম সাব হিসেবে। বাংলাদেশের প্রবাদ তুল্য বাউল আবদুল করিম ভাটিবাংলার অপরূপ সৌন্দর্য করিম ধারণ করেছিলেন তার হৃদয়ের গভীরে। ভাটির প্রকৃতি জল-স্থল,আকাশ-বাতাস,কাদামাটি সহজ-সরল মানুষের প্রতিকৃতি ধারণ করেছিলেন আপন সত্ত্বায়।
সাংসারিক টানাপোড়েনে শৈশবে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে রাখালের কাজ করেছেন করিম। মাঠে গরু রাখার কাজ করে কেটে যায় তার কিশোর জীবন। সারাদিন গরু চরিয়ে বাড়ি ফিরতেন গোঁধুলীতে। মাঠে গরু চরানোর সময় তিনি আপন মনে গান গাইতেন। প্রতিদিনের কর্মকান্ডের মধ্যে গান তার একটি নিত্য অনুসঙ্গ। তীব্র অভাবের তাড়নায় প্রচলিত পুঁথিগত শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি তার। তিনি জীবনে মাত্র আট দিন বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন।
প্রকৃতি ছিলো তার প্রথম শিক্ষক। প্রকৃতিই তাকে নিখাঁদ সোনা করে গড়ে তুলেছে। পার্থিব জীবনের প্রায় ২ যুগ ধরে প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এরপর তিনি ভর্তি হন নাইট স্কুলে। স্বাক্ষর জ্ঞান লাভের পর তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে গাজীর গান, বাউলা গান, ঘাটু গান, পালাগান, সারিগান,মালজোড় গান, কবিগান সহ বিভিন্ন অতি প্রাকৃতজনের গান গাইতেন। সে সময় ভাটি অঞ্চলের হাওরে নাও বাইছ (নৌকা বাইছ) হতো তখন করিম তার সহপাঠীদের নিয়ে নাওয়ে উঠে গাইতেন ‘কোন মেস্তুরী নাও বানাইছে কেমন দেখা যায় ঝিল-মিল-ঝিল-মিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও’। এভাবে গানের মধ্যদিয়ে চলে তার বাউল গান চর্চা। বৃহত্তর ভাটি বাংলার সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে মালজোড় গান খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দিরাইয়ের বাউল আব্দুল করিম, নেত্রকোনার খ্যাতনামা বাউল উকিল মুন্সী সহ অসংখ্য খ্যাতনামা বাউলগণ নবীজীর জীবনী, পৌরানিক যুগের কৃষ্ণের জীবনী, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, প্রেম-বিচ্ছেদ, মাটি ও মানুষের গান গেয়ে ভাটি অঞ্চলে সারা জাগিয়ে ছিলেন। শাহ্ আব্দুল করিমের রচিত বাউল, মুর্শিদী, জারিসারি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি গান লোকমুখে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে । “শুধু কালির লেখায় আলিম হয় না মন রে কানা অজানা কে যে না জানে,আল¬াহ নবী আদম ছবি এক সূতে বাঁধা তিন জনে” তার রচিত এ গানটির মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক যোগ সাধনার একটি ধারণা পাওয়া যায়।
মানব প্রেমের মধ্যদিয়ে জগৎ সংসার কে আলোকিত আর সমাজের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির স্বাদ পাইয়ে দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। আব্দুল করিমের গানে সাম্যবাদী ধারা সুর ফুটে উঠেছে। নির্যাতিত মানুষের শোক-গাঁথা, শোষণ-বঞ্চণা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, শাসিত ও শোষক গোষ্ঠীর কথাই বেশি রয়েছে। “আগে কি সুন্দর দিন কাটইতাম গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম” এ গানটির মধ্যে করিমের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের ব্যাপ্তি ঘটেছে।
বাউল শাহ আব্দুল করিম জীবনভর সাধনার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি তার একুশে পদক প্রাপ্তি। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক পান। এ পর্যন্ত তার প্রাপ্ত বিভিন্ন পদক ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পদক ২০০০’ আইডিয়া সংবর্ধনা স্মারক ২০০২’ লেবাক এ্যাওয়ার্ড ২০০৩, মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০০৪’ প্রভৃতি।
বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী বাউল সম্রাটের গানের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বিলেত প্রবাসীদের আমন্ত্রণে তিনি কয়েকবার বিলেতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন ও গান পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন। সিলেট তথা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আগরতলা, শিলচর ও করিমগঞ্জের বাঙালিদের গর্ব বাউল শাহ আব্দূল করিম।
গণসংগীত শিল্পী হওয়ার সুবাদে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাদের জনসভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করে তিনি জনগনকে মুগ্ধ করতেন।
বাউল করিমের প্রথম গানের বই ‘আফতাব সঙ্গীত’ পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বই গণসংগীত প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। তৃতীয় বই ‘কালনীর ঢেউ’ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৫৪ পৃষ্টার এই গ্রন্থটিতে মোট ১৬৩টি গান রয়েছে। প্রতিটি গানেই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের আত্ম প্রতীতির স্বাক্ষর বিদ্যমান, যা সহজেই সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করে। চতুর্থ বই ধলমেলা প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। পঞ্চম বই ‘ভাটির চিঠি’ প্রকাশ হয় ১৯৯৮ সালে। বাংলাদেশের অন্যতম পুরস্কার একুশে পদক পেয়েছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিশীল রচনার জন্য ।
১৯৫৪-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে , ৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে, ৬৯-এর গণঅভ্যুথানে , ৭১-এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি জনতার সমুদ্রে স্বরচিত গণসংগীত পরিবেশন করেন। গণমানুষের আন্দোলন সংগ্রামে মানুষ কে উজ্জ্বীবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুক্ত-ফ্রন্টের সময় বিভিন্ন সভা -সমাবেশে গান পরিবেশন করেছেন বাউল আবদুল করিম। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে সিলেটে আয়োজিত সমাবেশে তার দরাজ কণ্ঠে গেয়েছিলেন স্ব রচিত বিভিন্ন গান। মানুষের দুঃখ শোকের অনুভুতি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার পরিবেশিত এ গানটির মধ্য দিয়ে ‘এবারে দুর্দশার কথা, কইতে মনে লাগে ব্যথা’। বাঙ্গালী জাতির মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গান পরিবেশন করেছেন।
ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে করিম গেয়েছিলেন ভাসানী কে নিয়ে স্বরচিত গান “জনাব মওলানা ভাসানী, কাঙালের বন্ধু তিনি চিন্তা করেন দিন রজনী”।
বাউল করিম ৩৮ বছর বয়সে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের আশাসুরা গ্রামের আব্দুর রহমানের মেয়ে সরলা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৩৯৬ বাংলায় সরলা খাতুন একমাত্র ছেলে শাহ- নূর- জালাল ও বাউল করিমকে রেখেই মারা যান। বাউল করিমের সুযোগ্য উত্তরসূরি তার পুত্র নূর জালালও বাবার শেখানো পথ ধরেই হেঁটে চলছেন।
বাউল আব্দুল করিমের শেষ ইচ্ছা তার ধলের গ্রামের বাড়িতে একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা।