‘সুবিধাভোগী, বহিস্কৃত ও শোকজ প্রাপ্তরাই’ সিলেট বিএনপির নেতৃত্বে : নবগঠিত কমিটিকে জামানের প্রত্যাখান
সুরমা টাইমস রিপোর্টঃ তৃণমূলের প্রত্যাশা অনুযায়ী কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় সিলেট জেলা বিএনপি’র নতুন কমিটি নেতৃত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট নয় দলটির নেতাকর্মীরা। নতুন এই কমিটি দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার পরিবর্তে আরও দুর্বল করবে মনে করছেন বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের মতে বিএনপি এখন কঠিন সময় পার করছে। এই সময়ে দলের সাংগঠনিক দক্ষ ও পরীক্ষিতদের নেতৃতে নতুন কমিটির প্রত্যাশা ছিল। তারা চেয়েছিলেন আন্দোলনমুখি কমিটি। দলের যুগ্ম মহাসচিবদের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সিলেটের নেতারাও নতুন নেতৃত্বের দাবি তুলে ধরেন জোরালোভাবে। তাদের প্রত্যাশা ছিল তৃণমূল নেতাদের প্রত্যাশা মতো কমিটি ঘোষণা হবে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো রাজনীতির মাঠে-ময়দানে দীর্ঘ অনুপস্থিত নেতাদের নতুন কমিটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছে। অবমূল্যায়ন করা হয়েছে সাংগঠনিকভাবে দলের যোগ্য, দুর্দিনের পরীক্ষিত নেতাদের। এমনকি গুম হওয়ার আশঙ্কা এবং হামলা, মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন-এমন নেতাদেরও স্থান হয়নি নতুন কমিটিতে। তাদের পরিবর্তে সংগঠন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দল থেকে বহিস্কৃত ও শোকজ প্রাপ্ত নেতাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। ‘কেন্দ্রের চাপিয়ে দেয়া এই কমিটি বিএনপি পরিবারকে হতাশ করেছে বলে মনে করছেন তারা। এ্টা বিএনপির জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন জেলা বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মিরা। আগামীদিনের কঠিন আন্দোলন সংগ্রামে বর্তমান নেতৃত্ব কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকেই।
জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও নতুন কমিটির যুগ্ম আহবায়ক আলী আহমদ বলেন বৈঠকে অংশ নেয়া বিএনপি নেতারা নতুন নেতৃত্ব চেয়েছিলেন। তারপরও কেন্দ্র একটি আহবায়ক কমিটি দিয়েছে। এই কমিটি তৃণমূলের কতটা প্রত্যাশা পুরণ করতে পারবে তা সময়ই বলে দেবে।
নিখোঁজ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার এম ইলিয়াস আলীর শূণ্যস্থান পুরণ করার মতো কোনো যোগ্য নেতৃত্ব সিলেট বিএনপিতে গড়ে উঠেনি বলেও দাবি করেন তিনি। সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের আহ্বায়ক ও মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, নতুর কমিটিতে তৃণমূলের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।
নতুন কমিটি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও সদস্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল গফ্ফার। তিনি বলেন, তৃণমূলের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন কমিটিতে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি।
এছাড়া বৈঠকে অংশ নেয়া সিলেট বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিগত আন্দোলন সংগ্রামে যে সব নেতা রাজপথে ছিলেন না, এমনকি কর্মীদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিলেন; মামলার ভয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত-সেসব সুবিধাভোগীরাই আহবায়ক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। আর বিগত সরকার বিরোধী আন্দোলনে যেসব নেতারা জুলুম অত্যাচার উপেক্ষা করে আন্দোলন সফল করেছেন, গুম হওয়ার আতঙ্ক আর একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রাজপথে লড়েছেন, পাশে থেকে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রেখেছেন তাদের যথাযথ মূল্যালয় করা হয়নি।
নতুন কমিটিতে তৃণমূলের দাবি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
এদিকে সিলেট জেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটিকে প্রত্যাখান করলেন সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি এডভোকেট সামসুজ্জামান জামান। লন্ডন থেকে মুঠোফোনে তার এক ঘনিষ্ঠজনের কাছে আজ তিনি এ মত প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন,অসময়ে দলের যে সব নেতাকর্মী দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের বাদ দিয়ে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তা বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকান্ডকে জোরদার করতে ব্যর্থ হবে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে যারা জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছে তারা এ কমিটিতে স্থান পায়নি। আর যাদের রাজপথে দেখা যায়নি, তারাই আজ অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে হয়ে গেছে নেতা। লন্ডনে অবস্থানকারী সামসুজ্জামানের সাথে প্রবাসী কমিউনিটি এক নেতার র্দীঘ আলাপের সময় এসব কথা বলেন তিনি। এ ছাড়া সামসুজ্জামান দলের স্বার্থে এবং সিলেটে দলের কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে এ বিষয় নিয়ে দীর্ঘ ৩ ঘন্টা আলোচনা করেন বলে বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় দলের পল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সিলেট বিএনপির নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন দলের যুগ্ম মহাসচিবরা। দীর্ঘ প্রায় আড়াইঘন্টা ব্যাপী অনুষ্টিত ওই বৈঠকে সিলেট থেকে অংশ নেয়া প্রায় ৮০ জন নেতার অধিকাংশই সিলেটে বিএনপিকে শক্তিশালী করতে নেতৃত্বের পরিবর্তনের দাবি জানান। তারা বলেন, বর্তমান নেতৃত্ব দিয়ে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করা সম্ভব নয়। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে রাজপথে নামাতে হলে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন। এছাড়া বিগত সময়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে যেসব নেতাকর্মী জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদেরকে কমিটিতে মূল্যায়ন করার দাবি জানান। বৈঠকে যেসব নেতারা বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পাননি কমিটির ব্যাপারে তাদের লিখিত মতামত নেন যুগ্ম মহাসচিবরা।
পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশানস্থ তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে মতবিমিয়সভায় মিলিত হন দলের সিলেটের নেতারা। মতবিনিময় শেষে রাত ১১টার দিকে সিলেট জেলা বিএনপির ১০ সদস্যের নতুন আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করেন দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ।
নব ঘোষিত কমিটিতে সদ্য বিলুপ্ত জেলা বিএনপির সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হককে আহবায়ক এবং সিনিয়র সহ সভাপতি দিলদার হোসেন সেলিম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল গফ্ফার, কেন্দ্রীয় সদস্য আবুল কাহের শামীম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের আহবায়ক আবদুর রাজ্জাক, জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আহমদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান, জেলা যুবদল সভাপতি আবদুল মান্নান ও জেলা ছাত্রদল সভাপতি এমরান আহমদ চৌধুরীকে যুগ্ম আহবায়ক এবং তাহসিনা রুশদীর লুনাকে প্রথম সম্মানিত সদস্য রাখা হয়। নতুন আহবায়ক কমিটিকে ৪৫ দিনের সময় নির্ধারণ করে দিয়ে এই দিনের মধ্যে প্রতিটি থানা কমিটি গঠন করে জেলা কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। নতুন কমিটিতে জেলার সংসদীয় আসনের সাবেক এমপি প্রার্থী (নবম জাতীয় সংসদ), দলের কেন্দ্রীয় নিবার্হী কমিটির সদস্য, জেলা, পৌর, থানা বিএনপির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক, বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের জেলা সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদক এবং নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের (পুরুষও মহিলা) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশনাও দেয়া হয়।
এই কমিটি ঘোষণার পর পরই বিস্মিত হন উপস্থিত নেতারা। তাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকেই সভাকক্ষ থেকেও বেরিয়ে পড়েন।