বাংলা নববর্ষ পালন নাকি “বাংগালী প্রদর্শনী” ?
প্রতি বছর ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালনের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আমরা অন্তত বছরে একটা দিনে হলেও উপলব্ধি করার সুযোগ পাই যে আমরা জাতি হিসাবে বাংলা তথা বাংগালীত্বের সাথে কিভাবে প্রতারনা করছি। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে আজকাল যে “আধুনিকতা”র ধাক্কা এসে লেগেছে এতে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও যে হারিয়ে যাচ্ছে তাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রার অনুকরনে আজকের বাংলাদেশের নববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পূজা মন্ডবের সামনে হিন্দু শিষ্যরা যে সুরে ও তালে এবং যেভাবে নেচে গেয়ে ঠোলক ও বাদ্য বাজায় একই ভংগিতে আজ বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্যাম নৃত্যের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করছে। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মিশে আছে। এটাই স্বাভাবিক, এটাই জাতিসত্বা। কিন্তু শতকরা ৮৫ ভাগ বাংগালী মুসলমানের বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের কোন অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের কোন আচার অনুষ্ঠানেরই চিহ্ন বা মিল খুজে পাওয়া যায়না। এ বিশেষ দিনে আগত বছরের দিনগুলোতে দেশ ও জাতির কল্যান কামনা করে কোথাও কোন একটা মসজিদে আল্লাহর রহমত চেয়ে দোয়া বা মোনাজাতও করা হয়না। অথচ কথিত আছে মোঘল সম্রাট আকবরের আমলেই বাংলা বর্ষের প্রবর্তন হয়েছিল।
শুধু বাংলা নববর্ষের দিনেই আমরা বাংগালী হওয়া বা বাংগালী সাজার কত যে আয়োজন আর কত অনুষ্ঠানের মধ্যে ডুবে যাই! যেটাকে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পশ্চিম বাংলার “বাংগালী প্রদর্শনী”র সাথে তুলনা করা যায়। কটাক্কমূলক বাংগালী প্রদর্শনী অনুষ্ঠান পালনের অর্থ হলো আজকের তথাকথিত বাংগালীকে স্মরন করিয়ে দেওয়া বাংগালী বলতে কি বা কাকে বুঝায় এবং বাংগালী সংস্কৃতি, বাংগালী ঐতিহ্য, বাংগালী আচার-অনুষ্ঠান কেমন ছিল। অর্থাৎ বাংগালীরা আজ আর বাংগালী নয়, বাংগালীরা অতীত হয়ে গেছে। তাই বাংগালী প্রদর্শনীর মাধ্যমে আজকের বাংগালীদেরকে বাংগালীত্বের সাথে বছরে এক দিন পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বাংগালীরা আজ কি নিষ্ঠুর বাস্তবতায় পৌছে গেছে ! ভারতের পশ্চিম বাংলায় না হয় ( হিন্দি সংস্কৃতির জোয়ারে) এ বাস্তবতার কারণ খোজ করে পাওয়া যেতে পারে। বহুজাতিক বিশাল ভারতের বিবিধ সাংস্কৃতির দাপট ও প্রভাবে পশ্চিম বাংলার বাংগালী সংস্কৃতি আজ মুছে যাওয়ার দাড় প্রন্তে পৌছে গেছে। তাই ওরা প্রতি বছর বাংগালী প্রদর্শনীর আযোজন করে। কিন্তু আমরা বাংগালীরা বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, আমরা বাংগালীরা বাংলা মায়ের রূপ, বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে বাঁচানো ও লালন করার জন্য রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। তাই আমাদের জীবন চর্চা ও আচার-আচরনে বাংগালীত্বের সাক্ষর ও ছোয়া সারা বছরেই জীবন্ত থাকার কথা। কিন্তু আমাদের জীবন চরিতের খাতার পাতাতেও আজ সারা বছর প্রকৃত বাংগালীত্বের সাক্ষর নাই। তাই আমরা বছরে একদিন বাংগালী হওয়া বা বাংগালী সাজার চেষ্টা করি। পান্তা ভাত আর দূর্নীতি ও সাধারন মানুষকে শোষণ করে উপার্জিত টাকায় কোরবানীর গরু-ছাগলের সমান দামে ইলিশ কিনে ভোজের আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
নববর্ষের দিনটা পার হয়ে গেলেই আমরা আর বাংগালী থাকতে চাইনা। বাংলা মায়ের ফার্সি সন্তান হয়ে যাই। কোন্ দিনটা বাংলা কোন্ মাসের কোন্ তারিখ তাও আর আমরা বলতে পারিনা। মাতৃ ভাষা দিবসকেও ৮ই ফাল্গুন এর পরিবর্তে ২১শে ফেব্র“: হিসেবে চিনি। শুধু সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্রের সাথে দায়সারাভাবে এক পাতার বাংলা কেলেন্ডার প্রকাশ করে। ইংরেজী বছর শুরুর আগে যেভাবে সুন্দর করার প্রতিযোগিতায় ইংরেজী কেলেন্ডার বের করা হয় এভাবে আমাদের দেশে কেউই বাংলা কেলেন্ডার বের করার জাতীয় দায়িত্বের কথাও উপলব্ধি করেনা। ছেলে মেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বা লন্ডন আমেরিকায় পড়াশোনা করে বলতে পারলে আমরা গর্ব বোধ করি। মাকে মাম্মি বা মামা, বাবাকে ড্যাড্ডি বা পাপা বল্লে আমরা বাবা মায়েরা মনে মনে খুব পুলকিত হই। বাংগালী বা বাংলাদেশী জাতি হিসেবে আমাদের নাই কোন জাতীয় পোষাক। পাকিস্তানের আছে, ফিলিপিনের আছে, ইন্দোনেশিয়ার আছে, শ্রীলংকার আছে, নেপালের আছে, ভুটানের আছে, চীনের আছে, ভিয়েতনামের আছে, আছে আরো অনেক দেশের। সেসব দেশের রাষ্ট্রনায়ক বা নেতারা যে কোন রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় অনুষ্ঠানে তাদের জাতীয় পোষাক পড়ে। আর আমরা একই ভাষার একই জাতিসত্তার অধিকারী বাংগালীরা জাতীয় অনুষ্ঠানে ভিনদেশী পাঁচমিশালী পোষাক পড়ে তৃপ্তি বোধ করি। জিনস্ এর পেন্ট, টাই স্যুট পড়ে “বাংলা মায়ের ফার্সি সন্তান” হিসেবে নিজেকে জাহির করে বাংগালিত্বের মিথ্যে গর্ব বোধ করি। ইংরেজী স্টাইলে বাংলা উচ্চারন করতে করতে এখন বাংলা ভাষা পরিনত হয়েছে বাংলিশ বা বাংরেজীতে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী বা বাংলা ভাষার পন্ডিত-শিক্ষকদের কোন প্রতিবাদ বা মাথাব্যথা নাই। অথচ ১লা বৈশাখ উপলেেক্ষ এসব কথিত পন্ডিতরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাকে নিয়ে কত বড় বড় বক্তব্য / বিবৃতি দিয়ে তাদের পান্ডিত্য জাহির করতে পিছপা হননা। শুধু একদিন মাতাল হয়ে পহেলা বৈশাখ পালন করলে বা লাখো কন্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে কি বাংগালীত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালিত হবে ? ব্যক্তিজীবনে কেউই বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরন করেনা, একটা নির্দিষ্ট দিনে বাংলা কোন্ মাস ও কোন্ তারিখ ৯০% বাংগালীই তা বলতে পারেনা, অথচ বাংগালী জাতিয়তাবাদের পক্ষে কত জোরালো অবস্থান !
চ্যানেল আইসহ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ আসলে বাংলার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। প্রথম দিনটা শেষ হলেই পুরো বাংলা বছরে এসব বাংলা চ্যানেলে বাংলাকে আর খুজে পাওয়া যায়না। “হৃদয়ে বাংলাদেশ”, “দৃষ্টি জুড়ে বাংলাদেশ” কত সুন্দর সুন্দর এদের শ্লোগান ! অথচ কার্যত এসব চ্যানেলগুলোই সারা বছর এদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলার মাটি থেকে বাংলাকে তথা বাংগালীর হৃদয় থেকে বাংগালীত্বকে মুছে ফেলার প্রতিযোগিতায় সচেষ্ট থাকে।
রবিন্দ্র নাথ আর নজরুল বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি। কিন্তু আস্তে আস্তে বাংলাদেশে রবিন্দ্র সংগীত ও নজরুল গীতির চর্চা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো শাস্বত বাংলার ভাটিয়ালী, পল্লিগীতি, বাউল / কবিয়ালী গানের ঐতিহ্যকে বিলিন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সারা দিন অধিকাংশ বিভিন্ন বস্তাপচা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে “ওয়ান-টাইম ইউজ” বল পেনের মত ব্যান্ড মিউজিক, রক মিউজিক, পপ / ডিস্কো মিউজিক এর নামে বিকৃত রুচির ও অশ্লীল নৃত্য (অংগভংগি) সম্বলিত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির রিহার্সেল দিতে থাকে। এদের কারণে গান এখন হৃদয় ও অন্তরের আবেগকে স্পর্স না করে দৈহিক উশৃংখলা ও উম্মাদনা সৃষ্টি করে। গান এখন শোনার বস্তু না হয়ে দেখার বস্তুতে পরিনত হয়েছে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর নাটকে ভারতের স্টার-প্লাস ও অন্যান্য টিভি চ্যানেলের নাটকের নায়িকাদের অনুকরনে আমাদের দেশের নায়িকারাও সেলোয়ার-কামিজ-ওরনা বা শাড়ির পরিবর্তে টাইট-ফিট জিনস্ এর পেন্ট ও গেঞ্জি বা শার্ট পড়ার কালচার শুরু করেছে। এটা “হৃদয়ে বাংলাদেশ” এর সাথে সংগতিপূর্ন কিনা আমরা বুঝতে অক্ষম। বাংলার রূপকে নিয়ে গর্ব করলেও বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপন দৃশ্য চিত্রায়িত করতে আমরা বিদেশের মাটিতে গিয়ে বিদেশের রূপকে খুজি। হয়ত সেখানে বাংগালীত্বকে সহজেই বিসর্জন দিয়ে যে কোন পোষাকে ও ঢঙ্গে বিজ্ঞাপনের দৃশ্য চিত্রায়িত করার সুযোগ বেশী। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো আজকাল সংবাদের সময় টুকরো খবর বা শেষের খবরের অংশ হিসেবে বিদেশী সংস্কৃতির কুরুচীপূর্ন দৃশ্য বা অনুষ্ঠান দেখাতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে-যা বাংলা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার পরিপন্থি। প্রত্যেকটা টিভি চ্যানেল বিশেষ করে চ্যানেল আই ইদানিং কুরুচীপূর্ন পোষাকে আবৃত ভারতীয় বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরনে অর্ধ-উলংগ নারী দেহ প্রদর্শন করে তথাকথিত ফ্যাশান শো’র আয়োজন বা প্রচার বেশ জোরে-সোরে শুরু করেছে – যেটা বাংগালী সংস্কৃতি ধ্বংশের আর একটা কৌশল। এছাড়াও ভারতীয় হিন্দি টিভি চ্যানেলগুলোর অনুকরনে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো মিডিয়া পার্টনার হয়ে বিভিন্ন পন্যের এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানের নামে বাংলা সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলার মাটিতে কুরুচীপূর্ন নর্তন-কুর্দন শোভা পাবেনা মনে করে তারা এখন শারজাহ/দুবাইতে/কাতারে গিয়ে এসব অনুষ্ঠান করছে।
বাংলা নববর্ষের দিনে আমরা এখন যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন ও উপভোগ করি বছরের বাকী দিনগুলোতে আমরা কি তার উল্টোটা করিনা ? এ আত্ম প্রতারনার উপলব্ধি করতে না পারলে বাংলা আর বাংগালীত্ব শুধু বছরে একদিন অনুষ্ঠান পালনের (বাংগালী প্রদর্শনী) মধ্যেই আমাদের মাঝে বেঁেচ থাকবে। নিজস্ব কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে হারিয়ে কোন জাতিই সত্যিকার অর্থে অগ্রসর হতে পারেনা। আধুনিকতার নামে যাতে আমরা আমাদের জাতিসত্বাকে ভুলে না যাই এটাই হউক নববর্ষের শপথ।
লেখক : জাহিদ হাসান, রিয়াদ, সউদী আরব।