শুল্কফাঁকি দিয়ে সিলেট চষে বেড়াচ্ছে ১১১ বিলাসবহুল গাড়ি, অভিযানে গােয়েন্দারা

1ডেস্ক  রিপোর্ট :: শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সিলেট চষে বেড়াচ্ছে যুক্তরাজ্য থেকে আনা শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। মারসিডিজ, বিএমডাব্লিউ, জাগোয়ার থেকে শুরু করে বিশ্বের নামীদামী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসব গাড়ির প্রতিটির নূন্যতম মূল্য কোটি টাকা। একই নাম্বার নিয়েও একাধিক গাড়ি চলছে নগরীতে।

কারনেট সুবিধায় দেশে প্রবেশ করা এসব দামি গাড়ি বিআরটিএ’র কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে শুল্কফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশেই থেকে যাচ্ছে।

এতোদিন শুল্কফাঁকি দিয়ে চলা এসব গাড়ি প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সিলেট দাপিয়ে বেড়ালেও সম্প্রতি এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। গত ১১ এপ্রিল নগরীর আম্বরখানা বিএম টাওয়ারে বি-৩ ফ্ল্যাটের পার্কিং থেকে ৩ কোটি টাকা দামের একটি ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ’ গাড়ি (ঢাকা-৬১৪/ও)  উদ্ধার করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

গত ২০ এপ্রিল নগরী থেকে শুল্ক ফাঁকির দেড় কোটি টাকা মূল্যের একটি লেক্সাস কার উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া গত রোববার (২৪) এপ্রিল শুল্ক ফাঁকির আরেকটি গাড়ি উদ্ধারে অভিযান চালানো হয় হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। যদিও গাড়িটি উদ্ধার করতে পারেনি গোয়েন্দারা।

এরআগে ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর সিলেটের সুতারকান্দি শুল্ক স্টেশন দিয়ে আনা প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দামের দুটি পাজেরো গাড়ি নগরীর উপশহর ও কুমারপাড়া এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এই গাড়িগুলো এখনো সিলেট কতোয়ালি থানায় পড়ে আছে।
জানা যায়, সিলেটের সড়কগুলোতে চলা বিদেশী দামী ব্র্যান্ডের এসব গাড়ির বেশীরভাগই যুক্তরাজ্য থেকে আসা বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে কারনেট নামে একটি আন্তর্জাতিক অটোমোবাইল এসোসিয়েশন রয়েছে। যুক্তরাজ্যের কোনো নাগরিক পর্যটক হিসেবে তার গাড়ি যদি অন্য কোন দেশে নিয়ে যেতে চান তবে তার ব্যবস্থা করে দেয় ঐ এসোসিয়েশন। কারনেটের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে একটি গাড়ি দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

বিদেশ থেকে বাংলাদেশে গাড়ি প্রবেশে তিনশ’ ভাগ সরকারি শুল্ক নির্ধারণ থাকলেও কারনেটের গাড়ি প্রবেশে পোর্ট ফি ছাড়া কোনো সরকারি শুল্ক প্রদান করতে হয় না। আর পোর্ট ফি মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বলে জানা গেছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সিলেটের অনেক বাসিন্দা সিলেটের আসার সময় নিয়ে আসছেন এসব দামী গাড়ি।

প্রবাসীদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট ওভারসিজ সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক শামসুল ইসলাম জানান, কারনেটের নিয়ম অনুযায়ী পর্যটক হিসেবে আসা এসব গাড়ি ২৪ মাসের মধ্যে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকেই গাড়িগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় না। অনেক গাড়িই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে রেখে দেওয়া হয়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়,  বিদেশি এসব গাড়িকে ঘিরে দেশে বেশ বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট তৈরী হয়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা এই তিনটি বিভাগে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সক্রিয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে এসব গাড়ির অবৈধ বিকিকিনিও।
সূত্র মতে, পর্যটক হিসেবে আসা গাড়িগুলোর মাত্র ১০ ভাগ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। বাকী প্রায় ৯০ ভাগই থেকে যাচ্ছে দেশে। ফিরে যাওয়ার তালিকায় কেবল বিভিন্ন বিদেশী সংস্থাই বেশী।

জানা যায়, কারনেটের সুবিধায় দেশে নিয়ে আসা এসব গাড়ির মালিকেরা গাড়িগুলো দেশে রেখে দিতে বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করেন। ২৪ মাসের মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আসলেও গাড়ি ফেরত না নেওয়া জন্য, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে গেছে, তাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়ে নয়’ এমন তথ্য উপস্থাপন করেন তারা। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করতে সাজানো পুলিশ মামলা, এমনকি কম্পিউটার এনিমেশনের মাধ্যমে গাড়ীটির ধুমরানো-মোচরানো কিছু স্থিরচিত্রও উপস্থাপন করা হয় কারনেট এসোসিয়েশনে।

বিআরটিএ’র কিছু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা পেয়ে এসব অবৈধ গাড়ির রোডপারমিট বের করে দেন। তবে সিলেট বিআরটিএ অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার সূত্রে বলেন, অবৈধভাবে এসব পারমিট বেশী বের হচ্ছে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা বিআরটিএ অফিস থেকে। এছাড়া বিদেশি গাড়ি দেখলে ট্রাফিক পুলিশরা সিগনাল এড়িয়ে চলেন, এমন সুবিধায় রোডপারমিট ছাড়াই গাড়ি হাকিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সিলেট অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, সিলেটে প্রায় ১শ’ ১১টি বিদেশি পর্যটক গাড়ি রয়েছে। বিষয়টি অটোমোবাইল এসাসিয়েশন ও বিআরটিএ-কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। তবে সিলেট বিএরআরটিএ অফিসে অবৈধভাবে এসব গাড়ির কাগজ হচ্ছে না। আন্য কোনো বিআরটিএ অফিসে কোন আসাধু কর্তার মাধ্যমে কাগজ হচ্ছে কিনা তা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, সিলেটে কেউ অবৈধভাবে কাগজ করার চেষ্টা চালালে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক প্রভাত কুমার সিংহ বলেন, অবৈধ সুবিধা দিয়ে আনা কোনো গাড়িই রাস্তায় চলতে পারবে না। যারা বিলাসবহুল গাড়ি চালাবেন, তাদের সরকারের কোষাগারে রাজস্ব দিয়েই চালাতে হবে। শুল্কফাঁকি দেওয়া গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলেও জানান তিনি।