২য় বিশ্বযুদ্ধের ৭৪ বছর পর অজানা তথ্যের নায়ক বিশ্বনাথের আকবর আলী
সিলেট ওলি আউলিয়া খ্যাত শাহজালালের পণ্য ভূমি শুধু যে প্রবাসী অধ্যুষিত তাই নয়, শত ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ও আলোকিত এখন এই জনপদ, এই জনপদের বিশ্বনাথ উপজেলার অন্তর্গত ৩ নং অলংকারি ইউনিয়নের সবুজ শ্যামল ঘেরা সুন্দর ঐতিয্যবাহী একটি গ্রাম রামধানা, এই গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হাজী আকবর আলী, পিতা মৃত বদর উদ্দিনের দুই সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে আকবর আলী ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তথ্য পর্যালোচনায় পাওয়া যায় জীবিকার তাগিদে ১৯২৭ সালের ১৯ শে মার্চ মাত্র ১৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ জাহাজে নাবিক হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেন. সম্বভত ১৯৩০ সালের কোন এক মাসে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য জাহাজ থেকে লন্ডনে পাড়ি জমান, এবং ১৯৪১ সালের ২৮ জুলাই থেকে ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ব্রিটিশ আর্মির পাইওনিয়ার রেজিমেন্টের অধীনে সরাসরি ২য় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন. ব্রিটিশ সৈনিক হিসাবে তার আর্মি নাম্বার ছিল ১৩৯০০২১০, একজন বাঙালি বাংলাদেশী হয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হওয়া সত্তে ও এই ব্রিটিশ সৈনিক জীবিতকালীন তার পরিবারের কোন সদস্যকে এই ব্যাপারে কোন কিছু অবগত করেন নি. তিনির মৃত্যুর দীর্ঘ ৩৫ বছর পর কাকতালীয় ভাবে জানা যায় আকবর আলী ২য় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অবিশ্বাস্য গল্পের কথা,
আকবর আলী সাহেবের পুত্র যুক্তরাজ্য প্রবাসী মো: জুনাব আলীর নিকট থেকে জানা যায় তিনি ঘটনাক্রমে প্রয়োজনীয় একটি পুরাতন কাগজ খুজতেছিলেন, হঠাৎ তিনির ছোট মেয়ে সামিয়া একটা জরাজীর্ণ কাগজ হাতে নিয়া পডে দেখতে পায় তার দাদা আকবর আলী ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্য ছিলেন, এর পর ই কিছু বুজে উঠার আগেই পরিবারে হুলস্থুল কান্ড শুরু হয়ে যায়, কিন্তু আশ্চর্যজনক হলে ও সত্য এই জরাজীর্ণ কাগজ খানা জুনাব আলী বিগত ৩৫ বছর যাবত সংরক্ষিত রেখে চলেছেন কিন্তু কখনো তা পড়ে দেখেন নি অথবা প্রয়োজনবোধ করেন নি, মো: জুনাব আলী জানান তার বাবার মৃত্যুর পর লোক মুখে শুনেছেন মরহুম আকবর আলী ২য় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু সঠিক কোন কাগজ পত্র না থাকায় ইচ্ছা থাকলে ও এ নিয়া অগ্রসর হতে মন সায় দেয় নাই. কাকতালীয় ভাবে পুরাতন ফাইলে পাওয়া জরাজীর্ণ কাগজ টি প্রমান করে মরহুম আকবর আলী ২য় বিশ্বযুদ্ধে যাবার আগে শপথ নিয়েছিলেন, এর পরে মো: জুনাব আলী তার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের সাহায্য নিয়ে শুরু করেন চিটি চালাচালি. প্রথম যখন ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে চিটি লেখা হয় উত্তরে তারা গুরুত্ব না দিয়া ইন্ডিয়ান আর্মি হবে বলিয়া ইন্ডিয়ার আর্মি হেড কুয়ার্টারের ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়া যোগাযোগ করতে বলা হয়, কিন্তু ব্রিটেনে জন্ম ও বেড়ে উঠা মেয়েরা ও মো: জুনাব আলী নিজে বৃটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে দেওয়া উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি.
যদি ও ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে প্রত্যাখানের পর মো: জুনাব আলী হতাশ হয়ে পড়েন কিন্তু তার মেয়েরা ডিফেন্স মিনিস্ট্রি কে চ্যালেজ্ঞ করে চিটি চালাচালির এক পর্যায়ে দো:খ প্রকাশ করে হাজী আকবর আলী ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈনিক ছিলেন স্বীকার করে অধিকতর তথ্য দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে অনুরোধ জানানো হয় এবং যেহেতু অনেক দিনের পুরানো বিষয় সেহেতু তাদেরকে বিস্তারিত তথ্য বাহির করার স্বার্থে অনেক সময় দেওয়ার জন্য বলা হয় এভাবে ৩/৪ মাস পর একদিন স্বীকৃতি স্বরুপ সার্টিফিকেট সহ যুদ্ধে থাকাকালীন আকবর আলী কখন কোথায় ছিলেন মর্মে যত নথিপত্র ছিল সব কাগজ এর কপি পাঠাইয়া আরো অধিক সংস্থার ঠিকানা দিয়া যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়, এই ভাবে একে একে মেডেল সহ আনুসঙ্গিক সম্মাননা পত্র ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে দেওয়া হয়. মো: জুনাব আলী জানান যখন তার পিতার স্বীকৃতি স্বরুপ সার্টিফিকেট হাতে পান পরিবারের সকলের মধ্যে যে কি পরিমান খুশির বন্যা বয়ে গেছে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়.
নি:সন্দেহে আকবর আলীর পরিবার সহ বিশ্বনাথ তথা বাংলাদেশীদের জন্য গৌরবের বিষয়. এই স্বীকৃতির ফলে সুদুর ব্রিটেন প্রবাসী বিশ্বনাথবাসীরা এই অর্জনের মধ্য দিয়ে এক নতুন মর্যাদায় অধিষ্টিত হবেন বলে মনে করা যাচ্ছে. সিলেটের ব্রিটেন প্রবাসীরা যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সফল ও মর্যাদাবান শুধু তাই নয় আজ সিলেটের প্রবাসীরা ২য় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ব্রিটেনের প্রত্যেক সেক্টরে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন. ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে অংশ নেওয়া বাঙালি সৈনিক আকবর আলীকে নিয়ে ঘটে আরো এক মজার ঘটনা, তিনির পুত্র মো: জুনাব আলী জানিয়েছেন তার মা এর নিকট থেকে শুনেছেন তাদের বাবা জাহাজে চাকুরীকালীন সময়ে একবার তার জাহাজে বোমা মারা হয়, জাহাজ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ার ফলে জাহাজের এক টুকরো অংশকে আকড়ে ধরে এক সপ্তাহ সমুদ্রের মধ্যে আকবর আলী কাটিয়ে দেন, পরে অন্য উদ্ধারকারী জাহাজ এসে আকবর আলীকে মরনাপন্ন অবস্থায় উদ্ধার করে এবং ভাগ্যক্রমে তিনি বেচে যান. এ বিষয়ে মো: জুনাব আলীর ধারনা হয়তো ঘটনা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হতে পারে. এই ঘটনার সময় আকবর আলী দীর্ঘদিন নিখোজ থাকার কারনে পরিবারের সবাই ভেবে নিয়েছিলেন হয়ত আকবর আলী আর নেই. ঘটনায় যখন পরিবারের সবাই শোকে মুহ্যমান ঠিক তার মাস দুয়েক পর হঠাৎ এক দিন আকবর আলী বাড়িতে ফিরে আসলে পরিবারের সকলের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে. কে জানতো এই স্বশিক্ষিত অজপাড়ার আকবর আলী ২য় বিশ্বযুদ্ধের গর্বিত ব্রিটিশ সৈনিক হিসাবে বিশ্বনাথ তথা বাঙালিদের মুখ বিশ্বের দরবারে ব্যাপকভাবে উজ্জল করবেন. ২য় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ ৭৪ বছর পর ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে স্বীকৃতি আদায় চাট্টি খানি কথা নয়. ৩য় প্রজন্মের সহযোগিতা নিয়া সৈনিক আকবর আলীর পরিবার ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রির সাথে অব্যাহতভাবে যোগাযোগ রেখে আকবর আলী সম্পর্কে না জানা আরো অধিক তথ্য জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন. ২য় বিশ্বযুদ্ধের গর্বিত সৈনিক আকবর আলী ১৯৬৬ সালে পেনশন নিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাসের উদ্ধেশ্যে বাংলাদেশে পাডি জমান এবং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে মৃত্যুবরন করেন. গর্বিত সৈনিক আকবর আলীর ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ও বড় ছেলে ইতিমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন.