আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, ক্যামেরন পরিবারের বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন, তালিকায় ২৯ বিলিয়নেয়ার
ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘পানামা পেপার্স’ বিস্ফোরণে তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে। এ নিয়ে নানা নাটকীয়তার পর গতকাল পদত্যাগ করেছেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডুর ডেভিড গুনলাউগসন। এর আগে হাজারো মানুষ তার পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। এর প্রেক্ষিতে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট ওলাফুর রাগনার গ্রিমসনকে সংসদ ভেঙে দেয়ার অনুরোধ করেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট সাফ জানিয়ে দেন ক্ষমতাসীন শাসক জোটের উভয় দলের সঙ্গে আলোচনার আগে তিনি সেটা করবেন না। এর কিছুক্ষণ পরই পদত্যাগের ঘোষণা দেন সিগমুন্ডুর ডেভিড গুনলাউগসন।
এদিকে, প্রশ্ন উঠছে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পারিবারিক বিনিয়োগ নিয়ে। ফাঁস হওয়া নথিপত্রে উঠে আসে, ক্যামেরনের প্রয়াত পিতাও একটি অফশোর কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন। অভিযোগ করা হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠান ৩০ বছর ধরে বৃটেনে কোনো কর দেয় নি। ক্যামেরনের কার্যালয় থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানে মি. ক্যামেরনের কোনো শেয়ার নেই। তারপরও কর ফাঁকির এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের ওপর চাপ বাড়ছে। বিরোধীদলীয় নেতা লেবার পার্টির জেরেমি করবিন কর ফাঁকির এই প্রবণতার বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
বিপুল সংখ্যক ফাঁস হওয়া নথিপত্রে থাকা সবার নাম এখনও প্রকাশের অপেক্ষায়। তবে, এতে ফোর্বস বিলিয়নেয়ার তালিকার কমপক্ষে ২৯ জন রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ম্যাগাজিনটি। বিশ্বের বর্তমান ও সাবেক কমপক্ষে ৭২ জন রাষ্ট্রপ্রধানের কথা পরশুই প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া রয়েছে, ক্ষমতাধর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সেলিব্রেটি, আর ক্রীড়াবিদদের নাম। আরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কালোতালিকাভুক্ত ৩৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
‘পানামা পেপার্স’ নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন এই নথিপত্রকে এ যাবৎ কালের সবচেয়ে ব্যাপক পরিমাণ গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনা বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। পানামার আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা থেকে এসব গোপন দলিল ফাঁস হয়ে যায়। কর ফাঁকির কেলেঙ্কারিতে থাকা নামের মধ্যে রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর আত্মীয়স্বজন ও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠজন, বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা লিয়নেল মেসি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফসহ আরও অনেকে।
একটি জার্মান সংবাদপত্রের মাধ্যমে এসব দলিল হাতে আসার পর ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) তা শেয়ার করে বিশ্বের প্রায় একশ’টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তাদের এক বছরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে কর ফাঁকির এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এর প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত সব থেকে বেশি চাপের মুখে থাকা আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এবং তার স্ত্রী বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়েছেন। গত দুদিন ধরে এ নিয়ে তার পদত্যাগের দাবিতে শত শত মানুষ পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভ করে। যার প্রেক্ষিতে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
ওদিকে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান ও সাবেক আটজন প্রভাবশালী নেতাও কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। এদের মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন। বেইজিং এখনও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
আইসল্যান্ড, বৃটেন ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে জানা গেছে, কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার তালিকায় রয়েছে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের নাম। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, পানামা সহ আরও কিছু দেশে তদন্ত শুরু হয়েছে। এতে বলা হয়, মোসাক ফনসেকার ৮০০ সম্পদশালী ক্লায়েন্টের খোঁজে তদন্ত শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস। ওই আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাচারের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে স্পেন। আইসিআইজে’র পক্ষ থেকে প্রকাশ করা এক কোটি ১৫ লাখ নথিতে রয়েছে প্রায় ৫০০ ভারতীয়ের নাম। তারা কারা বা কোন্ কোন্ কোম্পানি মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে টাকা পাচার করেছে তা তদন্ত করে বের করতে ভারত সরকার সোমবার কয়েকটি এজেন্সির সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করেছে। কারো বিরুদ্ধে অন্যায় কোনো কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সঙ্গে আলোচনার পর অর্থমন্ত্রী ওই তদন্তের নির্দেশ দেন। আইসিআইজের সঙ্গে ওইসব ফাইলের যৌথভাবে তদন্ত করছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তারা সোমবার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, অফশোর হোল্ডিং বা উপকূলীয় প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন ভারতের মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন, তার পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, ডিএলএফ চেয়ারম্যান কেপি সিং ও তার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য, ইন্ডিয়াবুলসের মালিক সমীর গেহলাউট, এ্যাপোলা টায়ারের ওঙ্কার সিং কানওয়ার ও বিনোদ আদানীর ভাই গৌতম আদানী।
এদিকে, গোপন আর্থিক লেনদেনের বিপুল পরিমাণ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ব নেতা আর তারকারা এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা শুরু করেছেন। দাবি করছেন তারা ভুল কিছু করেন নি। বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তালিকার অনেক রাঘব বোয়াল বলছেন, তাদের অন্যায়ভাবে টার্গেট করা হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থকরা এ ঘটনাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ক্রেমলিনের এক মুখপাত্র বলেছেন, যে সাংবাদিকরা এই গোপন নথিপত্র নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে তাদের অনেকেই সিআইএ বা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা। চীন আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও, সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে কি-না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হং লেই জানিয়েছেন, এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। ফুটবল তারকা মেসির পরিবার এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বলিউডের মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চনও গতকাল অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছেন। তবে, তার পুত্রবধূ ঐশ্বর্য রাইয়ের তরফে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।