সৎভাবে ব্যবসা করেছি, ব্রিকলেনেই ৫শ’ কোটি টাকার বেশি সম্পদ
আজমল হোসেইন। লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। ব্রিটেনে আধুনিক কারিশিল্পের রূপকার আজমল হোসেইন এই শিল্পে এনেছেন নতুনত্ব। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একাত্তরে তরুণ বয়সে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাড়ি জমান প্রবাসে। সংগ্রাম করে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত। প্রবাসে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। ছাত্রজীবনে ছিলেন এমসি কলেজ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। সিলেট নগরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম ময়না মিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র আজমল হোসেইন বিলাতে একজন প্রতিষ্ঠিত ও সফল ব্যবসায়ী। সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনাই তাঁকে নিয়ে গেছে উচ্চশিখরে। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রবাসে তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে।
শিক্ষা, সংসার, রাজনীতি, ব্যবসা এবং প্রবাসে তাঁর অগ্রযাত্রার কথা জানান। গল্পের ফাঁকে জানান প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনকাহিনি। বাঙালিদের নিয়ে তাঁর স্বপ্ন দেশের প্রতি ভালোবাসার কথা। ওঠে আসে কীভাবে তিনি সৎভাবে ব্যবসা করে অর্জন করেছেন কোটি কোটি টাকা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নুরুল হক শিপু, ছবি তুলেছেন রত্না আহমদ তামান্না।
শিক্ষাজীবনের সূচনা সম্পর্কে প্রবাসী কমিউনিটি নেতা আজমল হোসেন বলেন, সিলেট সরকারি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ডাবল ম্যাট্রিক সম্পন্ন করে এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। সুইডেন থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে একজন রিয়েল এস্টেট ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী।
প্রথমে সুইডেন ও পরে যুক্তরাজ্যে ব্যবসা করে অনেক অর্থের মালিক হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যবসায় সফল হতে হলে প্রথমে প্রয়োজন সততা ও নিষ্ঠার। সৎভাবে ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমি একজন শিক্ষিত ও পরিশ্রমী ব্যবসায়ী। যখন প্রথম সুইডেনে যান, তখন ক্যামা নবের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। চাকরির ৩ মাস পরই ওই প্রতিষ্ঠানের ফোরম্যান হই। কিন্তু বাংলাদেশিরা আমাকে মেনে নেননি। তারা অল্পসময়ে অন্যকে বঞ্চিত করে আমাকে ফোরম্যান করা মেনে নিতে পারেননি। তখন কোম্পানির ডিরেক্টর আমাকে খবর দেন। বললেন, আমাকে আর রাখা যাচ্ছে না। কারণ আমি কর্মদক্ষতায় ফোরম্যান হয়েছি। এর নিচে আমাকে নামানো সম্ভব নয়। তিনি একটি চিঠি লিখে দিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে বললেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সুইডেন মিউনিসিপ্যালিটির একজন ডিরেক্টর। চিঠিটি তাঁকে দিলে বললেন, আমি মিউনিসিপ্যালিটির কাজ করতে পারব কি না জানতে চাইলে বললাম, দেখিয়ে দিলে সব কাজই করতে পারব। তিনি আমাকে ফ্লোরপ্লানিংয়ের কাজ দেখিয়ে দেন। সাথে মেশিন ও কিছু সরঞ্জামাদি দিলেন। একবারেই আমি কাজ শিখলাম। ওই সরঞ্জামাদি দিয়ে একবার ফ্লোরপ্লানিং করলে ১০ বছর যায়। টানা পাঁচ বছর এ কাজ করলাম। তখন বেতন পেতাম ৪ হাজার ৩শ’ পাউন্ড। অনেক অর্থ এ থেকেই জমাতে পারলাম। পরে এ কাজ বাদ দিয়ে একটি হালাল মাংসের দোকান দিলাম। সুইডেনের ওই শহরের একমাত্র মসজিদের ইমাম ও মুসল্লিরা আমাকে সহযোগিতা করায় আমি সরকারের কাছ থেকে ওই হালাল মাংসের দোকানের লাইসেন্স পাই। যেটি ছিল সুইডেনে প্রথম হালাল মাংসের দোকান। ৫ থেকে ৬ বছর এ ব্যবসা পরিচালনা করে আরো অর্থের মালিক হই। এরপর ১৯৮৮ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশিদের জন্য প্রথম রেস্টুরেন্ট সুইডেনে প্রতিষ্ঠা করি। রেস্টুরেন্টের নাম দিই ‘বোম্বে রেস্টুরেন্ট’। সরকার আমাকে রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স দেয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চাঙা হওয়ার জন্য সুইডেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা প্রধান শিরোনাম করে ‘ইট টুডে রেস্টুরেন্ট, উইল বি ক্লোজ টুমর। ফর হেলথ রিজন।’ এ সংবাদ প্রকাশের পর রেস্টুরেন্টে মানুষের ঢল নামে। ১৭টি আসন রেস্টুরেন্টের ভেতরে আর বাইরে ছিল ৪০টি আসন। প্লেইট ছিল ৩শ’। ৩শ’ জনকে খাওয়ানোর পর আর খাওয়াতে পারতাম না। কারণ আমি নিজেই রেস্টুরেন্টের সব কিছু ছিলাম। অন্য কাউকে নিইনি। একা খাবার তৈরি করতাম। নিজে সার্ভিসও করতাম। রেস্টুরেন্টে ব্যাপক ব্যবসা সফল হতে থাকলাম। এরপর একটি সিনেমা হল আমার রেস্টুরেন্টে ১শ’ শিঙাড়ার অর্ডার দেয়। আমার বয়সি একজন বাংলাদেশি কারিগর স্বপনকে নিয়োগ দিই। তিনি সুস্বাদু শিঙাড়া তৈরি করতে শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে ১৭ জনকে রেস্টুরেন্টে নিয়োগ দিলাম। ব্যবসা বারতে থাকলে। এক সময় আমার রেস্টুরেন্টের আশপাশের অনেকই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়তে থাকলেন। আর আমি সে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাড়া নিতে থাকলাম। একসময় ওই লাইনে ৩০টি দোকানের মালিক হই। বিক্রিও করে দিই। একই স্থানে পরে দুটি রেস্টুরেন্ট করি। পরবর্তীকালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে ১২টি রেস্টুরেন্ট করি। সবগুলোর নামকরণ করি বোম্বে রেস্টুরেন্ট নামে। এরপর সুইডেনে প্রথমে শেয়ার মার্কেটে ৫০ পাউন্ড জমা দিই। ১৯৯৮ সালে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে যুক্তরাজ্যে চলে আসি। তখন নিয়ম ছিল ১৯৯৯ সালের আগে লন্ডনে কেউ এলে তাঁকে আর ট্যাক্স দেওয়া লাগবে না। আমি সুযোগটা কাজে লাগাই। তখন সুইডেন সরকার আমার কাছে ৫৬ লাখ পাউন্ড ট্যাক্স পেত। লন্ডনের বাংলা টাউনখ্যাত ব্রিকলেন আসার পর সুইডেন সরকার আমার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড আদালতে মামলা করে। মামলা লড়লাম ১০ বছর। মামলার রায় হয় আমার পক্ষে। ১৯৯৯ সালে ব্রিকলেনে অনেক জমি কিনে রেস্টুরেন্ট করলাম। ‘প্রেম’ এবং ‘প্রীতি’ রেস্টুরেন্টসহ এখন পাঁচটি রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। শুধু ব্রিকলেনে রয়েছে তাঁর ৫শ’ কোটি টাকার বেশি সম্পদ।
প্রবাসে বাংলাদেশীরা কেমন আছেন জানতে চাইলে আজমল হোসেইন বলেন, অনেক ভালো আছেন। সবাই সবার মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নতুন প্রজন্ম উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে অনেকেই সরকারি চাকরি করছে।
নতুন যারা স্টুডেন্ট ভিসায় যাচ্ছেন তাদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভিসা কলেজে ভর্তি হলেতো কষ্ট করতেই হবে। তাদেরকে কে বলেছে ভিসার জন্য কলেজে ভর্তি হতে? ওইসব কলেজের সনদের কোনো মূল্য নেই। যারা প্রকৃতভাবে ভালো কলেজে পড়ালেখা করছে তারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছে। ভালো অবস্থানে যেতে পারছে। তাদের সনদেরও মূল্য রয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনীতি কেমন চলছে জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে আজমল হোসেইন বলেন, আমার খুব খারাপ লাগে আমাদের বয়সিরা এখনও বাংলাদেশি রাজনীতি করছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্ম সেখানে স্থানীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা সফল হচ্ছে, দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। আমিও নতুন প্রজন্মকে যুক্তরাজ্যের স্থানীয় রাজনীতি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। আগে বাঙালিরা লন্ডনে এমপি হতে পারেননি। আমি বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করি রেসপেক্ট পার্টির। আমি ওই পার্টির চেয়ার ছিলাম। ওই পার্টি থেকে জর্জ গলাওয়েকে এমপি প্রার্থী করি। শর্ত দিই, ভবিষ্যতে আর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। পরবর্তীকালে বাঙালিকে প্রার্থী করা হবে জানালে শর্তে তিনি রাজি হন। সকল বাঙালিকে একত্র করে জর্জ গলাওয়েকে বিজয়ী করি। এরপর আর আন্দোলন করা লাগেনি। কারণ সকল দলই পরবর্তীকালে বাঙালিদেরকে প্রার্থী করে। এখন আন্দোলন করছি ৫ লাখ বাঙালির জন্য ২০ জন এমপি চাই। আশা করি, এ আন্দোলনেও সফল হব।
যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে কোনো পার্টির রাজনীতি করছেন জানতে চাইলে আজমল হোসেইন বলেন, তিনি লেবার পার্টির সিনিয়র মেম্বার। আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখার একজন কাউন্সিল মেম্বার।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে আমি দেশের সব দলকেই আর্থিক সহযোগিতা করি। তবে জামায়াত ছাড়া। আমি জামায়াতকে দেখতে পারি না। তাদের বিরুদ্ধে আমার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমি লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেটসের জামায়াতপন্থি সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। মামলা করি। মামলায় জয়ী হই। লুৎফুর মেয়র পদও হারান। যে আন্দোলন একাত্তরে করেছি, সে আন্দোলন আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।
দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে একজন প্রবাসী বিনিয়োগ করার পর লভ্যাংশ বিদেশে নিতে না পারার কারণেই বিনিয়োগ করছেন না বলে আমি মনে করি। দেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগ বাড়বে যদি লভ্যাংশ তারা নিজের কাছে নিতে পারেন।
প্রবাসে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বপ্ন অনেক। ইচ্ছা আছে দেশের জন্য জাতির জন্য কিছু করার। ভবিষ্যতে এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, আমার বাবা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। আমি এই বিদ্যালয়কে এবার কলেজে উন্নীত করেছি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। আমি লন্ডন থেকে ২০টি হাই প্রসেসর কম্পিউটার এনে একটি অত্যাধুনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার অনেক কষ্ট লাগে তাদের জন্য যারা প্রবাসে আমার রয়সি। তাঁরা দেশ থেকে কোনো সাংসদ গেলে তাদের পেছনে পেছনে ঘুরেন। অর্থ খরচ করেন। কারণ দেশে সামান্য সমস্যা এমপি শেষ করতে সহযোগিতা করবেন-এ আশায়। কিন্তু ওই ব্যক্তি যখন দেশে আসেন তখন আর এমপি সাহেবকে অনেক ধরনা দিয়েও পান না।
আজমল হোসেইন ৮ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে সবার জ্যেষ্ঠ। এর মধ্যে ৭ ভাই দেশে এবং এক ভাই যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করছেন। আজমল হোসেইনের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। বড় ছেলে আব্দুল ফাত্তাহ একজন আইটি বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক, দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল মুমিন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। তৃতীয় ছেলে তানজিব কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে শারমিন সিএ চাটার্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, দ্বিতীয় মেয়ে সারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। সব ছোট মেয়ে সালমা এবার জিসিএসসি পরীক্ষা দেবে। স্ত্রী মিসেস ফাতিমা গৃহিণী।