১৭ মৃত্যুকূপে পারাপার-এক বছরে ৯ লাশ উদ্ধার
কাইয়ুম উল্লাস:: দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে ট্রেন। বিকট শব্দে হর্ন বাজাচ্ছে। কেননা, সামনের রেল ক্রসিংয়ে একটি ভ্যানগাড়ি ট্রেন আসার পরও ঝুঁকি নিয়েই পার হতে যাচ্ছে। অবশেষে খুব কাছে আসায় অনেকটা ভ্যান গাড়িটি টান মেরে সরিয়ে নিলেন চালক মিজান। এটি দক্ষিণ সুরমার ডালিমপুর রেল ক্রসিংয়ের চিত্র।
এভাবেই সিলেটের ১৭ টি মৃত্যুকূপে পারাপার হন সিলেটে রেল লাইনের আশপাশ এলাকার মানুষজন। আর প্রতি বছরই ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন পথচারীরা। গত এক বছরে বিভিন্ন ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ৯ জন পথচারী।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশের ১৭ টি রেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে, সিলেট রেলগেইট, কাজিরবাজার সেতু, খোজারখলা, বরইকান্দি, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মকন মিয়া স্কুল, মেনিখলা, শিববাড়ি, চান্দাই, চনড়িপুর, জৈনপুর ডালিমপুর, মোগলাবাজার, হাজিগঞ্জবাজার, রেঙ্গা মাদ্রাসা, ধরমপুর ও ইলাশপুর। এছাড়াও কম ঝুঁকিপূর্ণ আরও কয়েকটি রেল ক্রসিং আছে।
নিয়মিত রেল লাইন পার হন-এমন কয়েকজন পথচারী জানান, দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে এই রেলক্রসিংগুলো খোলা। এসব রেল ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট রাস্তা গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করেছে। ছোট হলেও এসব ক্রসিং দিয়ে নিয়মিতই পার হচ্ছেন পথচারীরা। খানিক পর পর অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যানগাড়িও পার হচ্ছে। ট্রেন এলে কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়েই পার হয়ে যাচ্ছেন। তাই মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে।
শিববাড়ির সিন্টুর রঞ্জন চন্দ জানান, এখানে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়া লাশ পাওয়া যায়। আবার অনেক সময় ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের ধাক্কা লাগার ঘটনাও ঘটে। এই মাস দুয়েক আগে একটি অটোরিকশা রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময়ই ট্রেন চলে আসে। অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায়। ভাগ্যিস, চালকসহ যাত্রীরা দ্রুত গাড়ি ছেড়ে নেমে দূরে সরে যান।
চনড়িপুর রেল ক্রসিংয়ে গিয়ে দেখা গেল, একটি মোটরসাইকেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পার হচ্ছেন নুরুল ইসলাম। তিনি জানান, চনড়িপুর গ্রামে তার বাড়ি। তিনি প্রতিদিনই মোটরসাইকেলে এই ক্রসিং পার হন। দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানোর পরও এখানে কোনো গেইটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
কাজিরবাজার সেতু সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে। এখানে একটি ঝুঁকিপূর্ণ রেল ক্রসিং। দ্রুত সেতুতে ওঠছে যানবাহন। আচমকা রেল ক্রসিংয়ে পড়েন অনেক চালক। এখানে একটি রেল ক্রসিং থাকার কথা জানেন না অনেক গাড়িচালক। ছোট্ট করে দুটি সাইনবোর্ড আছে। তাতে লেখা ,‘সামনে রেলক্রসিং। নিজ দায়িত্বে পারাপার হন’। এই দুটি সাইনবোর্ড লাগিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। অবশ্য, সম্প্রতি এখানে একটি গেইটবক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
সওজ সূত্র জানায়, কাজিরবাজার সেতু নির্মাণের সময়ই সিলেট রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৭০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে গেইটবক্স নির্মাণের জন্য। কিন্তু কাজিরবাজার সেতু চালু হয়ে গেলেও গেইটবক্স নির্মাণ করছিল না রেল কর্তৃপক্ষ। পরে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে এখন কাজ শুরু করে তারা।
দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁওয়ে মকন স্কুল ও কলেজ। স্কুলটির ঠিক সামনের ফটকের পাশেই ঝুঁকিপূর্ণ রেল ক্রসিং। এখানে প্রতিনিয়তই ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা পার হন রেল ক্রসিং। শুধু শিক্ষার্থীরাই নন; স্থানীয় মকন বাজারে আগত মানুষজনও আছেন ট্রেনে কাটা পড়ার ঝুঁকিতে।
জানতে চাইলে মকন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শহিদুর রব বলেন, স্কুলের সামনেই একটি খোলা রেল ক্রসিং। কোনো গেইট নেই, নেই কোনো গেইটম্যান। কিন্তু রেল কতৃপক্ষ যেন উদাসীন। অথচ মকন স্কুলের সামনে খুব দ্রুত ট্রেন যাচ্ছে। কিছুদিন আগে পাশের হামিদা খাতুন স্কুলের ৪র্থ শ্রেণির একজন ছাত্রী ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়।
জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহাঙ্গির হোসেন জানান, সিলেটে এই ১৭ ঝুঁকিপূর্ণ পারাপারে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মরছে। জিআরপি পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। গেল বছরে জিআরপি এরকম ৯ টি লাশ উদ্ধার করেছে। ট্রেনে কাটা পড়া লাশের সংখ্যা কমিয়ে আনতে এই ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার চিহ্নিত করে তালিকা রেলের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে।
রেল সূত্র জানায়, সিলেটের এই ১৭ পারাপার নিয়ে রেলের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বিপাকে আছেন। সিলেট থেকে প্রতি বছর ট্রেনে কাটা পড়ার রিপোর্টসহ সুপারিশ যাচ্ছে। গোল টেবিল বৈঠকে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই অরক্ষিত রেল পারাপারে গেইটবক্স নির্মাণে কোনো উদ্যোগ না নিতে পেরে রেল কর্তৃপক্ষ বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তবে, সারা দেশেই এই অরক্ষিত রেলপথ চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ করা হয়েছে। ঠিক কবে এই গেইটবক্স প্রকল্প শুরু হবে, তা স্পষ্ট করছে না উচ্চপর্যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট রেলওয়ের উপপ্রকৌশলী আকবর আলী বলেন, সিলেটের মোট ১৭টি রেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছে। সারা দেশে রেলে গেইটবক্স নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিচ্ছে বাংলাদেশ রেল। আশা করছি, দুই মাসের মধ্যেই সিলেটের এই ১৭ টি ক্রসিংয়ে জনসাধারণের ঝুঁকি দূর করতে গেইটবক্স ও গেইটম্যান নিয়োগ দেওয়া হবে।