সিটি ব্যাংকে প্রবাসীর দেড় কোটি টাকা লোপাট
আ.ফ.ম. সাঈদ :: বিদেশের মাটিতে কাষ্টার্জিত অর্থের নিরাপত্তা ও লাভের জন্য সিটি ব্যাংকে ৭০ লাখ টাকার এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট) করেছিলেন যুক্তরাজ্য প্রাসী সৈয়দ আখলাক মিয়া। কিন্তু ব্যাংকে তাঁর টাকা নিরাপদ থাকেনি এবং মুনাফাও পাননি। অর্থাৎ, আম ও ছালা দুটিই লোপাট হয়েছে। তিনি আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত চাওয়ায় উল্টো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিষয়টি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।
নগরীর উত্তর পীর মহল্লার সৈয়দ আখলাক মিয়া বসবাস করেন লন্ডনের আপ্নি এলাকায়। ২০০৮ সালের জুলায়ে তিনি সিটি ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখায় শতকরা ১২.৫০% লভ্যাংশ হারে ৭০ লাখ টাকার এফডিআর করেন (হিসাব নম্বর-৪১২২১৮৯৪০৫২০১)। পরের বছর দেশে এসে ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখেন, তাঁর টাকা ঠিক আছে এবং মুনাফা (সুদ) দেয়া হয়েছে ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ’ টাকা।
সৈয়দ আখলাক মিয়া ২০১১ সালের অক্টোবরে দেশে এসে তাঁর এফডিআর-এর হিসেব জানতে ব্যাংকে যান। তখন তাঁকে ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তাঁর এফডিআর-এর টাকা তুলে নেওয়ায় হিসেব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তবে লন্ডনে তাঁর ব্যবসাবাণিজ্য থাকায় তিনি লন্ডন ফিরে যান। সেখান থেকে তিনি ব্যাংকে চিঠি দিয়ে তাঁর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার কারণ জানার পাশাপাশি টাকা ফেরত চান। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে সৈয়দ আখলাক মিয়াকে জানায়, তাঁর টাকা আত্মসাতের দায়ে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর টাকা দ্রুত ফেরত দেওয়া হবে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দেয়। পরবর্তীকালে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে সৈয়দ আখলাক মিয়াকে কয়েক বার দেশে আনানো হয়। তাঁর হিসেবমতে সুদে-আসলে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার মধ্যে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৮ কিস্তিতে ৫৭ লাখ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাকি ৯০ লাখ টাকা প্রদানে গড়িমসি শুরু করে।
সৈয়দ আখলাক মিয়া তাঁর সমুদয় টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সিটি ব্যাংকের কাছে বারবার ধরনা দিতে থাকেন। ইত্যবসরে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সিলেটের চিফ জুডিশিয়াল মাজিস্ট্রেট আদালতে সৈয়দ আখলাক মিয়ার বিরুদ্ধে দরখাস্ত মামলা (৩৫৬/২০১২) দায়ের করে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এতে অভিযোগ করে যে, সৈয়দ আখলাক মিয়া জিন্দাবাজার শাখার তৎক্ষালীন ম্যানেজার মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশ করে তাঁর এফডিআর-এর সমুদয় টাকা উঠিয়ে নিয়ে এখন টাকা ফেরত চাইছেন। আদালত বিষয়টি তদন্তের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংককের সহকারী পরিচালক ও পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম এবং যুগ্ম পরিচালক ও পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা সৈয়দ তৈয়বুর রহমান সম্পূর্ণ বিষয়টি তদন্ত করেন। তাদের ২১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে সৈয়দ আখলাক মিয়ার এফডিআর-এর টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাটের জন্য সিটি ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখা তৎকালীন ম্যানেজার মুজিবুর রহমানকে এককভাবে করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, মুজিবুর রহমান জালিয়াতির মাধ্যমে সৈয়দ আখলাক মিয়ার এফডিআর ভাঙিয়ে নগদায়ন করেন। তার জালিয়াতির সঙ্গে সৈয়দ আখলাক মিয়ার কোনোরকম যোগসাজস বা সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপও বেরিয়ে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ম্যানেজার মুজিবুর রহমানকে জিন্দাবাজার শাখা থেকে গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ শাখায় বদলি করা হয়। সেই শাখার গ্রাহক মো. রাকিব আলীর অ্যাকাউন্টের টাকাও ব্যাংকের ম্যানেজার মুজিবুর রহমান নয়ছয় করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে প্রদত্ত জাবানবন্দিতে মুজিবুর রহমান স্বীকার করেন যে, তিনি সৈয়দ আখলাক মিয়ার এফডিআর-এর টাকা লোপাট ও মো. রাকিব আলীর টাকা তাঁর অজ্ঞাতে জিন্দাবাজার শাখায় স্থানান্তর করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে তদন্তের পরও সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এখনও সৈয়দ আখলাক মিয়ার টাকা ফেরত দেয়নি। তাই নিরুপায় হয়ে তিনি বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী আবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সৈয়দ আখলাক মিয়া তাঁর এফডিআর-এর টাকা লোপাটের প্রতিকার চেয়ে দুদক সিলেট কার্যালয়েও লিখিত আবেদন করেছেন। এতে তিনি অভিযোগ করেন যে, সিটি ব্যাংক তাঁর ৯০ লাখ টাকা ফেরত দিচ্ছে না; উপরন্তু টাকা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে সাবেক ম্যানেজার মুজিবুর রহমান, মামুন ও বর্তমান ম্যানেজার রাব্বি কামাল তাঁকে আরো অর্ধকোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।
সৈয়দ আখলাক মিয়ার অভিযোগটি দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) সিলেট অফিসের পরিদর্শক আশরাফ উদ্দিন তদন্ত করছেন। এ ব্যাপারে দুদক সিলেট অফিসের উপপরিচালক রামমোহন নাথ জানান, ‘অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে।’
সিটি ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখার বর্তমান ম্যানেজার রাব্বি কামালকে সৈয়দ আখলাক মিয়ার টাকা লোপাট হওয়ার সম্পর্কে ফোনে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, বিষয়টি আমার পূরো জানা নেই। তবে সৈয়দ আখলাক মিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে এ ব্যাপারে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি মামলা দায়ের করেছে। তিনি জানান, শাখার সাবেক ম্যানেজার মুজিবুর রহমানকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।