সিলেটে আরেক দস্যুরানী ফুলন দেবীর সন্ধান!
ডেস্ক রিপোর্টঃ এ যেন আরেক দস্যু ফুলন দেবীর সন্ধান পেল সিলেট জেলা পুলিশ। তার নাম রেখা বেগম। কিন্তু অপরাধ জগতের আলোচিত নারী রেখা বেগমের মুখোশ উন্মোচন করেছে সিলেটের জেলা পুলিশ। একটি ডাকাতির ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশ রেখা বেগম ও ডাকাতদলের খোঁজ পেয়েছে। গ্রেপ্তার করেছে রেখা ছাড়াও আরও তিন দুর্ধর্ষ ডাকাতকে। উদ্ধার করেছে ৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। অপারেশনে যেত না রেখা বেগম। তবে, নিয়মিত তার বাসাতেই ডাকাতির পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করতো দুর্ধর্ষ ডাকাতরা। আর ডাকাতির ঘটনার মনিটরিং সিলেটে বসেই করতো রেখা। নিজে এবং পুত্র রুহুলও ছিল ডাকাতদলের অন্যতম সদস্য। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও রেখার আচার-আচরণে কখনও এমনটি প্রকাশ পায়নি। শান্ত স্বভাবের মহিলা হিসেবে তাকে চিনতো সবাই।
এদিকে, গ্রেপ্তারের পর রেখা বেগম নিজেই স্বীকার করেছে তার বাসা থেকে উদ্ধারকৃত মালামাল সব ডাকাতির। সিলেট নগরীর এয়ারপোর্ট, জালালাবাদ ও শাহ্পরান থানায় বিভিন্ন সময় ডাকাতিকালে এসব মালামাল লুট করা হয়। রেখা বেগম, পুলিশের তথ্যমতে বয়স ৪০। দীর্ঘদিন ধরে রেখা বসবাস করছেন সিলেট নগরীতে। তার মূল বাড়ি কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার দক্ষিণ চরথার হাফেজবাড়ী। রেখার স্বামী শফিউল আলম সুমন। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন রেখা সিলেট নগরীর ভাতালি মধুশহীদ ১৫-বি নং বাসায় এসে ভাড়া উঠেন। ওই এলাকার এক ডাক্তারের চেম্বারে সে আয়ার কাছ নিয়েছিল। ওই পরিচয়ে রেখা বাসা ভাড়া নেয়। বাসা ভাড়া নেওয়ার পরদিনই সিলেট জেলা পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ রেখার বাসায় অভিযান চালান। আর ওই বাসা থেকে ডাকাতির মালামালসহ রেখাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আরও তিন ডাকাতকের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সিলেট জেলা পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শনিবার রাতে সিলেটের বিশ্বনাথের পীরের গাঁওয়ের রেদওয়ান মিয়ার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে সিলেটের কাজল শাহ্ ৮১-৩ নং বাসার বাসিন্দা ছাবুল মিয়ার ছেলে নূর উদ্দিন ও শাহ্পরান থানার নাথপাড়া এলাকার ব্রজেন্দ্র দেবনাথের পুত্র কৃষ্ণ দেব নাথ।
বিশ্বনাথে আটক হওয়ার পর পুলিশ তাদের নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই জিজ্ঞাসাবাদে তারা সিলেট শহরে অবস্থানরত রেখা বেগমের সন্ধান দেয়। এরপর এসএসপি আবুল কালাম আজাদ সহ বিশ্বনাথ থানা পুলিশের একটি দল সিলেট নগরীতে অভিযান শুরু করে। রোববার রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ দিরাই থানার ভাটিপাড়া গ্রামের শুক্কুর আলীর ছেলে সোহেল আহমদ ও সিলেটের বিমানবন্দর থানার সাহেবের বাজার পাঠানগাও গ্রামের মতিন খার পুত্র সেবুল খাঁ’কে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশ রেখার মধুশহীস্থ বাসায় অভিযান চালায়। ভোররাতের দিকে পুলিশ রেখাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর রেখার স্বীকারোক্তি মতে তার বসত ঘর থেকে ৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ ডাকাতির মালামাল উদ্ধার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই রেখা বেগম ডাকাতি মালামাল তার হেফাজতে রাখার কথা স্বীকার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, পুরো ১০-১৫ জনের ডাকাতদলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিল রেখা বেগমের ছেলে রুহুল। এ কারণে পুরো ডাকাত দলকে কৌশলে পরিচালনা করতো সে। ডাকাতির আগে রেখা বেগমের বাসায় বসেই পরিকল্পনা করা হতো। সেক্ষেত্রে রুহুল ও তার বন্ধু কৃষ্ণ সব সময় রেখার নির্দেশ মেনে চলতো। এ কারণে রুহুল ও কৃষ্ণসহ আরও দু’-একজনের ডাকাতির মালামালের অংশ রেখা তার হেফাজতেই রাখতো। এদিকে, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাতদলের সদস্যরা জানিয়েছে, তাদের দলে ১২ জনের মতো সদস্য রয়েছে। এবং এরা সবাই সিলেট নগরীতে বসবাস করে। একেক জন একেক এলাকায় বসবাস করে। আর রাত হলেই তারা রেখার বাসায় একত্রে মিলিত হতো। সিলেট নগরীর চৌহাট্টার মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডের দুইজন চালকের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। গাড়ি সহ ওইসব চালকদের নিয়ে রাতের বেলা ডাকাতি করে বেড়াতো। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও জানায়, সিলেট নগরীর বাইরে তারা তেমন অপারেশনে বের হতো না। সব সময় তারা নগরীতেই ডাকাতির ঘটনা ঘটাতো। গেল কয়েক মাস ধরে সিলেট নগরীর বিমানবন্দর এলাকায় খাসদবির, চৌকিদেখি এলাকায় ৪টি ডাকাতির ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে একটি বিয়ে বাড়িতে তারা হাফপ্যান্ট পরে ডাকাতির করে। হাতে চাপাতি, অস্ত্র নিয়ে কখনো হাফপ্যন্ট, কখনো মুখোশ পরে তারা ডাকাতির ঘটনা ঘটায় বলে জানায়। আর প্রতিটি ডাকাতির ঘটনার পর মালামাল ভাগ-বাটোয়ারা করে সূর্য উঠার আগেই তারা আলাদা হয়ে যে যার বাড়িতে চলে যেতো। এদিকে, রেখা বেগমকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ সিলেট শহর ও শহরতলীর ১০টি স্থানে অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে তারা আর কাউকে গ্রেপ্তার না করলেও সিলেট শহরে ওরাই যে একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে তার ধারণা মিলেছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাতদের মুখ থেকেও সেসবের বিবরণ পাওয়া গেছে। তবে, রেখা বেগম তার ডাকাত ছেলে রুহুলকে নিয়ে বেশির ভাগ সময় ভাড়া বাসায় থেকেছে বিমানবন্দর এলাকায়। প্রতি ২-৩ মাসের মধ্যে তারা এক এলাকা থেকে বাসা পরিবর্তন করে চলে যেতো অন্য এলাকায়। আর যেসব এলাকায় তারা অবস্থান নিতো সেসব এলাকায় ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যেতো। অভিযান পরিচালনাকারী দলের প্রধান সিলেট জেলা পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত ডাকাতদলের সদস্যরা সিলেট নগরীতেই বেশির ভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের কাছ থেকে মালামাল উদ্ধারের পর সেটিরও প্রমান মিলেছে। তিনি বলেন, এখন জেলা ও নগর পুলিশ মিলে পলাতক থাকা ডাকাতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আর ওই সংঘবদ্ধ ডাকাতদল ধরা পড়ায় সিলেটে ডাকাতির ঘটনা কমে আসবে বলে জানান তিনি। এদিকে, গ্রেপ্তারকৃত রেখাসহ অপর তিন ডাকাতকে গতকাল সিলেটের আদালতে হাজির করে রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এএসপি আজাদ জানিয়েছেন, অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যেতো পারে।
রেখার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মালামাল: সিলেটের বিমানবন্দর থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাকাতি করা ৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার হয়েছে রেখার কাছ থেকে। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের বাজার মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। এছাড়া, পুলিশ বাংলাদেশী ও বিদেশী ৫ লাখ টাকার মুদ্রা, বিভিন্ন মডেলের ৩৫ টি মোবাইল সেট, ৪ টি ল্যাপটপ, দু’টি এলসিডি টিভি, একটি ডিভিডি, ৬ টি স্টিল ক্যামেরা, দুই কেজি ইমিটেশনের স্বর্ণালঙ্কার ও ডাকাতিকালে ব্যবহৃত দেশি অস্ত্র, ঘর ও গ্রিল ভাঙার সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। (মানবজমিন)