গোয়েন্দা হেফাজতে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির নায়ক
ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকায় রীতিমতো সংসার পেতেছিল পোলিশ নাগরিক পিটার। শুরু করেছিল স্থায়ীভাবে বসবাস। আর ভেতরে ভেতরে বিছিয়েছিল জালিয়াতির বিশাল এক জাল। স্কিমিং ডিভাইসের মাধ্যমে এটিএম কার্ডের তথ্য ও গোপন পিন নম্বর সংগ্রহ করতেন তিনি। তারপর তৈরি করতেন ক্লোন কার্ড। সেই কার্ড দিয়ে তুলে নিতেন বিভিন্ন লোকজনের টাকা। তার সঙ্গে এই চক্রে ছিল আরও দুই বিদেশি নাগরিক। তাদের একজন রোমানীয় ও একজন স্প্যানিশ। তারা অবশ্য আগেই সটকে পড়েছে। আর চক্রের দেশীয় এজেন্ট হলো খোদ সিটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা। পুরো চক্রটি মেতে উঠেছিল জালিয়াতি করে অন্যের টাকা হাতিয়ে নেয়ার কাজে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি পিটার ও তার সহযোগীদের। ডিবি’র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন তারা। পিটারের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত অপর তিনজন হলেন- মকসেদ আলী ওরফে মাকসুদ, রেজাউল করিম ওরফে শাহীন ও রেফাজ আহমেদ ওরফে রনি। গতকাল তাদের আদালতে সোপর্দ করে ছয়দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে মিন্টো রোডের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা পিটারের অবস্থান শনাক্ত করেন। পরে রোববার রাতে গুলশানের একটি বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজে মিলিয়ে দেখা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারও করে পিটার। পরে পিটারের দেয়া তথ্যমতে গ্রেপ্তার করা হয় অপর তিনজনকে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃত পিটার আন্তর্জাতিক জালিয়াতি চক্রের সদস্য। তার জন্ম মূলত ইউক্রেনে। তবে পোল্যান্ডের নাগরিক সে। জার্মানির একটি নাগরিক সনদও রয়েছে তার কাছে। মূল নাম থমাস হলেও নাম পরিবর্তন করে পিটার হয়েছেন। যেই পাসপোর্টে ২০১৪ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে এসেছেন তাও চুরি করা পাসপোর্ট বলে স্বীকার করেছেন তিনি। ঢাকায় এসেছিলেন ব্যবসায়িক কাজের কথা বলে। আর ভেতরে ভেতরে গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন এটিএম কার্ড জালিয়াতির চক্র।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, পিটারের সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন ও পোল্যান্ডভিত্তিক একটি চক্র এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ইউরোপ ও আফ্রিকায়ও এরা কার্ড জালিয়াতি করে অন্যের টাকা হাতিয়ে নেয়। অন্তত তিনটি দেশে ‘ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল’ বলে তালিকায় পিটারের নাম রয়েছে। পিটারের ভাষ্য মতে, গত চার বছর ধরে বিভিন্ন দেশে পিটার বিভিন্ন দেশের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে আসছিল।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মূলত এক লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী, একজন বুলগেরিয়ান নাগরিক ও একজন ইউক্রেনিয়ান নাগরিককে নিয়ে পিটার বাংলাদেশে কার্ড জালিয়াতির এই পরিকল্পনা করে। তারপর মাঠে নেমে যায় তারা। পিটারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, সে নিজেই স্কিমিং ডিভাইসগুলো এনেছিল। একই সঙ্গে সে কৌশলে কার্ড ডিভিশনের লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে নিজের পরিকল্পনার কথা জানায়। তার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় মকসুদসহ অপর দুইজন। তারপর পরিকল্পনামতো বিভিন্ন বুথে স্কিমিং ডিভাইস লাগিয়ে গ্রাহকের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে ক্লোন কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নেয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পিটার ঠিক কত টাকা তুলে নিয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে সে বলেনি। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও ব্যাংকের অভিযোগ মিলিয়ে দেখা হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো ব্যাংক থেকে গ্রাহকের টাকা খোয়া গেলেও সুনাম হানি হবে বলে গোপনে গোপনে গ্রাহককে টাকা দিয়ে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
বান্ধবীদের ক্রেডিট কার্ড চুরি করাতো পিটার: বান্ধবীদের দিয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রেডিট কার্ড চুরি করানোর চক্র রয়েছে পিটারের। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পিটারের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। কলগার্ল হিসেবে পিটার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে পাঠাতো বান্ধবীদের। সেই বান্ধবী ব্যবসায়ীদের ক্রেডিট কার্ড চুরি করে আনতো। আর তা দিয়ে দেদারসে পুরো চক্রটি অন্য দেশে গিয়ে কেনাকাটা করতো। গ্লোবাল সেসব ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বাংলাদেশে কেনাকাটাও করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন পিটার। কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সদ্য দায়িত্ব পাওয়া এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, চুরি করার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পিটার কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। বেশির ভাগ সময়েই এসব কার্ড দিয়ে পাঁচতারা হোটেলসহ বড় বড় শপিং সেন্টারগুলোতে কেনাকাটা করেছে। শুধু ঢাকা নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসব কার্ড ব্যবহার করেছে সে। এসব কার্ড ব্যবহারের নোটিফিকেশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে যাওয়ার পর তারা যখন সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন পিটার তখন সেই কার্ড ফেলে দিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পিটার জানিয়েছেন, লন্ডন প্রবাসী এক বাংলাদেশীও তার এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। সিলেটের এই বাসিন্দা বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
লিভ টুগেদার করতেন বাংলাদেশী তরুণীর সঙ্গে: বছর চারেক আগে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন পিটার। এরপর নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। উঠতেন গুলশানের হোটেল হলিডে প্লানেটে। সেখানেই মেরিনা ওরফে রোমানা নামে এক হোটেল কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা লিভ টুগেদার শুরু করেন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মেরিনা ওরফে রোমানাও পিটারের অর্থ বিত্ত দেখে আকৃষ্ট হন। সম্প্রতি তারা বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হন। সাতদিন আগে তাদের এক সন্তানও হয়েছে। গুলশানের ২ নম্বর এভিনিউয়ের ১১২ নম্বর সড়কের ১২ নম্বরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। পিটার জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হওয়ায় তিনি থেকে যান। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পিটারের বাংলাদেশী স্ত্রী তাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। সাতদিন আগে সন্তান জন্ম দেয়ায় মানবিক কারণে তাকে পিটারের সঙ্গে আটক করা হয়নি। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, পিটারের এই জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে তার স্ত্রীও জড়িত। তার মাধ্যমেই সে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। এ কারণে পিটারের স্ত্রীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
আদম ব্যবসাও করতেন পিটার: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আদম ব্যবসার সূত্র ধরে বাংলাদেশে আসেন পিটার। বাংলাদেশের শীর্ষ এক আদম ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তার। এরই মধ্যে কিছু লোককে বিশেষ কৌশলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন তিনি। ইউরোপের একটি দেশের ভিসা অফিসারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে আদম ব্যবসা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর আড়ালে তার প্রধান টার্গেট ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিটারের সঙ্গে দেশের অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। গুলশানের হলিডে প্লানেট হোটেলে সে দেশি-বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে নিয়মিত পার্টিরও আয়োজন করতো। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, পিটারের সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ীর যোগাযোগ রয়েছে তাদেরও নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের কেউ পিটারের এই জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ছয় দিনের রিমান্ডে: এটিএম কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এক বিদেশি এবং তিন ব্যাংক কর্মকর্তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল এই চারজনকে আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলাম শুনানি শেষে ছয়দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। আসামিদের পক্ষে জামিন চেয়ে আইনজীবী এইচএম মাসুদ আদালতে বলেন, ‘পিটারকে অমানবিক, নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে সাতদিন আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে তোলা হয়নি, এতে দেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।’ এ সময় শরীরের জামা খুলে জখমের চিহ্ন দেখান বিদেশি এই নাগরিক। এরপর তিনি বক্তব্য দিতে চাইলেও আদালত তা শোনেনি।
গত ১২ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানী ও মিরপুর এলাকার বিভিন্ন বুথ থেকে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের টাকা খোয়া যায়। গ্রাহকের কাছে ডেবিট কার্ড ও পাসওয়ার্ড গচ্ছিত থাকলেও তাদের মোবাইল ম্যাসেজে টাকা উত্তোলন হওয়ার নোটিফিকেশন আসে। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা নিজ নিজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানালে বিষয়টি সবার নজরে আসে। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পায়। এর প্রেক্ষিতে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল)-এর পক্ষ থেকে বনানী থানায় তথ্য-প্রযুক্তি আইন ও পেনালকোডের ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ইউসিবিএল’র পক্ষে মামলাটি দায়ের করেন ব্যাংকের হেড অব ফ্রড কন্ট্রোল অ্যান্ড ডিসপুট ম্যানেজমেন্ট ও কার্ডস, ব্রাঞ্চেস কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন কর্মকর্তা মাহবুব উল ইসলাম খান। এরপরে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রাজধানীর পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে। দু’টি মামলাই তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতারক চক্র অন্তত ৪০টি কার্ড ক্লোন করে গ্রাহকদের প্রায় ২০ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।