লাশ উত্তোলনের সফলতা আমরা চাই না
মীর আব্দুল আলীম: দেশে শিশুহত্যা ও নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। হবিগঞ্জে চার শিশু হত্যার খবর যেদিন সংবাদপত্রে ছাপা হয়, সেদিন পত্রিকার পাতা জুড়ে আরও কয়েকটি শিশুহত্যা ও নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়। নীলফামারির ডিমলায় কুকুরের মুখে দেখা গেছে নবজাতকের লাশ। ধামরাইয়ে ডাস্টবিনে পলিথিনের ব্যাগে পাওয়া গেছে আরেক শিশু। শিশু সোলায়মানকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে বলে, গাজীপুরের আদালতে এক হত্যাকারী স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আবার সেদিনই ভোলার মনপুরায় এক শিশুকে উদ্ধারের সফলতার খবরও ছাপা হয়েছে। এসব খবরগুলো জানান দিচ্ছে, মানুষের মধ্য থেকে মানবিকতা, সুকুমার বৃত্তি ইত্যাদি উঠে যাচ্ছে দিন দিন। মানুষ পরিণত হচ্ছে মায়ামমতাহীন এক নিষ্ঠুর প্রাণীতে। এই শ্রেণীর মানুষ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে টার্গেট হচ্ছে প্রতিপক্ষের নিস্পাপ শিশুরা। শিশুদের ওপর একশ্রেণীর মানুষের আক্রোশ সত্যিই ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। দেশে মধ্যে যারা এ নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ করছে, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। সমাজের এই অংশকে কীভাবে শোধরানো যায়, তা নিয়ে আমাদের এখুনই ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনীকে সবচেয়ে গুরু দায়িত্বটি পালন করতে হবে। শিশুহত্যা ও নির্যাতনকারীদের দ্রুততার সঙ্গে আইনের আওতায় নিয়ে আসা গেলে এ প্রবণতা কমে আসবে নিশ্চয়ই।
আলোচ্য বিষয়ে ফিরে যেতে চাই, হবিগঞ্জে একই সাথে একই পরিবারের চার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। পরস্পর চাচাতো ভাই সম্পর্কের এ চার শিশুকে প্রথমে অপহরন অত:পর গুম ও খুন করা হলো। ঘটনার ৫দিন পর মাটি চাঁপা দেয়া লাশগুলো একে একে তুলে আনার সফলতা দেখালো পুলিশ! প্রশ্ন হলো এমন সফলতাই কি শিশু মনির ও তার চাচাতো ভাই শুভ, তাজেল, ও ইসমাইলের পরিবার চেয়েছিলো? আমরা দেশবাসীও কি এ,ন সফলতা চাই? শিশুদের লাশউত্তোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরা ধারনা করেন যে, হয়তো তারা ২ কিংবা ১দিন আগে খুন হতে পারে। তাতে ধরে নেয়া যায় অপহরনের পর ২/৩ দিন জীবিতই ছিলো এ শিশুরা। যেহেতুক নিকটবর্তী এলাকা (১ কিলোমিটারের মধ্যে) থেকেই তাদের লাশ উদ্ধারর করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় হয়তো তাদের আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। তাহলে তাদেও উদ্ধার করতে প্রাসন কেন ব্যর্থ হলো? এটি ছোট কোন বিষয় ছিলো না, হবিগঞ্জের ৪ শিশু অপহরনের ঘটনাটি গোটা দেশ আলোড়িত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতিকে এখানে কিছুতেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো আমরা কেন তাদেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলাম? সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এর দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না। দায় আমাদেরও আছে। যারা ঐ এলাকার জনপ্রতিনিধি, যারা ঐ সমাজের বাসিন্দা তারাও কিভাবে এ দায় এড়াবেন? তাই অকপটেই বলতে হয় এ চার শিশু খুন হয়েছে আমাদের অবহেলা আর ব্যর্থতায় কারনে।
কেন এই হত্যাকা-? গ্রাম্য রাজনীতির (ভিলেজ পলিটিক্্র) শিকার এ শিশুরা। জানা গেলো, এলাকার দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পঞ্চায়েতের নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জের ধরেই অপহরন এবং পরে হত্যা করা হয় এ চার শিশুকে। এরা ছিল নেহায়েতই শিশু; একবারে নি:ষ্পাপ। গ্রাম্য রাজনীতির সঙ্গে আলোচ্য চার শিশুর কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। বিরোধের সম্পর্কটা কেবল অভিভাবকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এ কথাতো সত্য যে, হত্যাকারীরা চার শিশুকে হত্যা করে এদের অভিভাবকদের চরম শাস্তি দিতে চেয়েছে। এ কেমন শাস্তি দিলো তারা? এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারে? শিশুরা তো কারও শত্রু হতে পারে না? তারা তো কারও মনে জিঘাংসা জাগাতে পারে না। সব সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজে শিশুমাত্রই স্নেহ-বাৎসল্যের পাত্র। আমাদের সমাজে কেন শিশুহত্যার বিভীষিকা মোচ্ছবে পরিণত হলো? হবিগঞ্জের চার শিশু স্থানীয় পঞ্চায়েতকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-বিরোধের জেরে খুন হয়ে থাকতে পারে এ সন্দেহ যদি সত্য হয়, তাহলে উদ্বেগের মাত্রা গুরুতরভাবে বেড়ে যায়। পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের নির্মম বলি হচ্ছে শিশুরা।
কি আচানক খবর! চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গড়ে প্রতিদিন ১টি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ২৯ দিনে ২৯টি শিশুকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪ জনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। নিখোঁজের পর লাশ পাওয়া গেছে ৬ জনের। স্বজনদের হাতে খুন হয়েছে ৩ জন। ২০১২ সালে খুন হয়েছে ২০৯টি শিশু। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে হয়েছে ২৮১। আর তার পরের বছর ২০১৪ সালে শিশুহত্যায় উল্লম্ফন ঘটেছে: সে বছর খুন হয়েছে ৩৬৬টি শিশু। অবশ্য ২০১৫ সালে তা কমে ২৯২-এ নেমেছে, কিন্তু ২০১২ সালের তুলনায় বেশিই রয়ে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, ২০১৬ সালের দেড়মাসেই দেশে ৪০ জনের বেশী শিশু নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। এই পৈশাচিক প্রবণতা এমন হারেই যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বছর শেষে মোট শিশুহত্যার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিশু হত্যার হার ছিল ক্রমর্বধমান। ২০১৫ সালে এই হার ২০১৪ সালের তুলনায় কিছুটা কমছিল। ২০১৬তে তা বেড়ে আকাশচুম্বি হচ্ছে বলেই ধরে নেয়া যায়। চলতি বছরে প্রায় প্রতিদিনই শিশু হত্যার ঘটনা, পূর্বের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব শিশু হত্যা সন্তানকে ঘিরে মা-বাবার রঙিন স্বপ্ন তছনছ হচ্ছে। শিশুদের জন্য আগামী পৃথিবী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ, জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মুক্তিপণের জন্য টার্গেট করা হচ্ছে শিশুদের। একের পর এক শিশু খুন হলেও যেন কারো ঘুম ভাঙছে না। একের পর এক শিশুহত্যার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও মনোবিকলন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বর্বরতা ও নির্মমতার এই পর্যায়ে এসে মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি আদৌ কোন সভ্য সমাজে বাস করছি? নাকি জাহেলিয়াতের যুগে? আমরা বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছি নাতো? প্রশ্ন হলো বর্বর যুগও কি এমন ছিলো? বোধ করি না। এমন নিষ্ঠুর হয় কি করে মানুষ? এর উত্তর খুঁজতে লজ্জায় আমাদের মাথা নুইয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে হিং¯্র পশুদেরও শিশুদের জন্য দয়ুলুু হতে দেখি। একের পর এক এসব শিশু হত্যার মতো বর্বর ঘটনা ঘটিয়ে ¯্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব বলে আমরা দাবি করি কি করে?
দেশে খুন খারাবি হচ্ছেতো হচ্ছেই। নিষ্ঠুর পৈচাশিক হত্যাকান্ড আমাদেও স্তবদ্ধ করে দিচ্ছে। ৭ খুন, ৫ খুন, ৪ খুন আর পরিবার শুদ্ধ খুনের ধটনার ধারাবাহিতকায় দেশের আর মানুষ আতংঙ্কিত না হয়ে পারে না। গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রতিনিয়ত আমরা নানা নির্মমতা ও পৈশাচিকতার খবর পাচ্ছি। এ ধরনের নৃশংসতা কিংবা নির্মমতা আমাদের ক্রমাগত মর্মাহত ও গভীরভাবে শঙ্কিত করে তুলছে। রাজপথে বাক্সবন্দি নির্যাতিত শিশুর লাশ, গ্যারেজের মালিকের হাতে খুন হওয়া শিশুর লাশ, পিটিয়ে মেরে ফেলা কিশোর, মেরে পানিতে ডুবিয়ে রাখা শিশু। এমন আরো নানাভাবে হত্যার শিকার বিভিন্ন স্তরের নাগরিক ও শিশুরা আমাদের মানবিক চেতনাকে ধিক্কার দিচ্ছে, নিন্দা জানাচ্ছে। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদেরকে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে আমাদেরকেই বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা কি করতে পারছি? আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা কি তা করতে পারছে। মোটেই না। আমাদের এই সমাজে পঁচন ধরেছে। আমরা বরাবরই এসব ভয়াবহ নৃশংসতা দেখছি, মুখ বুজে সহ্য করছি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চোখের সামনে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্ট করে তুলছি। কেন এমন অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খবর পাচ্ছি না? আমরা কোথায় আছি? কেথায় যাচ্ছি? শেষ হয়ে যাচ্ছি নাতো? এমন নানা প্রশ্নের কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই।
লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিষ্ট। e-mail-[email protected]