প্রাথমিক শিক্ষক যেন বিমাতার সন্তান! স্বপন তালুকদার
অষ্টম বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সচিবদের থেকে অবনমন ও মর্যাদার বৈষম্য করায়, রাষ্ট্রের কাছে শিক্ষকদের প্রয়োজনীতা ও মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। প্রায় প্রতিদিনই শিরোনাম হচ্ছে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৈষম্যের বিষয়। পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী সবার উপরে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন করা হয়! কোন কারন ব্যতীতই বেতন বৈষম্যের শিকার হোন বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকরা। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরও শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থানের তেমন উন্নতি হয়নি।বাস্তবতা হচ্ছে অনেক স্তরের শিক্ষক এখনও নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থাতেই আছেন।শিক্ষকদের সাথে বেতন ও মর্যাদার বৈষম্য আজকের নয়, তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় তাও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে নতুন বেতন কাঠামোতে বেতন ও মর্যাদার বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্থক্য এইটুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে হওয়ায় যেভাবে বিষয়টি সামনে এসেছে, মিডিয়া সহ রাষ্ট্রে আলোচিত হচ্ছে তা অন্য স্তরের শিক্ষকদের সাথে অনেক অনেক আগে তৈরি হলেও তা এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বেতন বৈষম্য নিরসনের আশ্বাসের পরও সচিব কমিটি, বৈষম্য নিরসন কমিটি ঘুরে এসেও সংকট রয়েই গেছে কালো হাতের থাবায়!
এবার টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়টি যেভাবে সরকার ও মিডিয়ার নজরে এসেছে, তেমনটা প্রাথমিক শিক্ষকদের বেলায় ঘটেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের মাঝে তিনধাপের ব্যবধান,যা এতদিন থাকার কথা নয়। এমন বৈষম্য সৃষ্টি হয়ই বা কিভাবে!প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপেই বেতন পেতেন এবং একই শ্রেণিভুক্ত কর্মচারি হিসাবে প্রায় সম যোগ্যতায় ১৯৭৩ সাল থেকে। দুইটি পদের মাঝে অন্য কোন পদ নাই! ২০০৬ সাল থেকে প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের বেতন ও পদ মর্যাদার বৈষম্যের সৃষ্টি, বর্তমানে তা তিনধাপের! প্রায় দুই বছর ধরে সহকারি শিক্ষকরা বৈষম্য নিরসনের জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়ে আসছেন। সরকারেরর সবুজ সংকেত থাকার পরও বছরের পর বছর বৈষম্য বহন করতে হচ্ছে সহকারি শিক্ষকদের। বৈষম্য নিরসনে আজ অবধি কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্যনীয় হয়নি। শুধু বিভিন্ন মহল থেকে যৌক্তিক দাবি বলিয়া মনে করা হলেও তা বৈষম্য নিরসন কমিটি সভায় উত্থাপিত হলেও আশ্বাসই সীমাবদ্ধ আছে। প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদ মর্যাদা প্রদান করা হলেও, অজ্ঞাত কারনে নন-গেজটেডই রাখা হয়। ক্রসপন্ডিং স্কেল না দেওয়ায় তাঁরাও অসন্তোষ্ট। পদোন্নতি প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের স্ব-বেতনে পদোন্নতি হয়! প্রাথমিক শিক্ষকদের এইসব দাবি কি অযৌক্তিক? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশের শিক্ষায় প্রাথমিক শিক্ষকদের তেমন একটা গুরুত্ব নেই। প্রাথমিক শিক্ষক যেন রাষ্ট্রের বিমাতার সন্তান! অথচ একটা ছেলে বা মেয়ে যখন কাস ওয়ানে স্কুল শুরু করে তখন সে কি আর যখন সে প্রাইমারি স্কুল শেষ করে তখন সে কি!এই দুটো অবস্থার মধ্যে আকাশ আর পাতাল পার্থক্য। শুধু মাত্র তার লিখতে পড়তে পারা বা হিসেব করতে পারার মধ্যে এটা সীমাবদ্ধ নয়, তার সমস্ত চিন্তাধারা, পারিপার্শিকতা কে মূল্যায়ন করা এবং সেই মত কাজ করা,সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়া এবং ক্ষমতা, নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা, সমাজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা এসব ব্যাপারে সে সমাজের একজন নাগরিক হবার জন্য তৈরী হচ্ছে। আর এর পেছনে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন সেই শিক্ষক যিনি নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন আর সমাজের সবচেয়ে নীচের একজন মানুষ হিসেবে দিন যাপন করছেন। যাঁদের বিষয়টি সবচেয়ে আগে বিবেচনায় বা নজরে আসার কথা তাঁরাই আজ গুরুত্বহীন।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনে সরকারের তৎপরতা ও মনোযোগ বা মিডিয়ার সম্প্রচারে দোষ খুঁজছি না। যে কোন স্তরের শিক্ষকদের মর্যাদা দেখভাল সরকার করবেন এটা স্বাভাবিক। আমি অবশ্যই এই সমস্যার সুন্দর সম্মানজনক সমাধান চাই। তবে অবশ্যই সাথে সাথে সর্বস্তরের শিক্ষকদের বৈষম্য ও মর্যাদা সমান গুরুত্ব আশা করি এবং করব। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের বৈষম্য ও মর্যাদা সমান গুরুত্ব পাবে। তাঁরাও এদেশেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। সর্বনিম্ন স্তরের শিক্ষক বলে এতটা অবহেলিত ভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।কারন শিক্ষার কোন স্তরই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তেমনই সকল স্তরের শিক্ষকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রাথমিক শিক্ষকের কর্ম ঘন্টা ও কর্ম পরিধি বিবেচনায় নিলে বুঝা যাবে প্রাথমিকে শিক্ষকতা কতটা কষ্টসাধ্য। একজন প্রাথমিক শিক্ষককে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত টানা অবস্থান করে ৭/৮টা কাশ নিতে হয়। বিদ্যালয় বহির্ভূত রাষ্ট্রীয় কাজ যেমন বাড়িবাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা প্রনয়ণ, ভোট গ্রহণ, শিশু জরীপ, খানা জরীপ, আদম শুমারি, তাছাড়া বিদ্যালয়ে অফিসিয়াল নানা কাজকর্ম, উপবৃত্তি প্রদান, ইত্যাদি ইত্যাদি। যা সম্পাদন করতে একজন ফুলটাইম অফিস সহকারি দরকার তাও প্রাথমিক শিক্ষকদেরই করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের সাপ্তাহিক ছুটি শুধু শুক্রবার। অন্যসব প্রতিষ্টানে তা দুইদিন।রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দিবসেও বিদ্যালয় খোলা রাখতে হয়। হিসাব কষে দেখা গেছে অন্য সবারর থেকে দুইটি কার্যদিবস বেশি। অথচ তাঁরা ভ্যাকেশনাল ডিপার্টম্যাটের কর্মচারি! এটা কি বৈমাত্রেয় আচরণ নয় তাঁদের সাথে।বাংলাদেশে এমন কোন অফিস কি আছে অফিস সহকারি নেই! তাছাড়া সরকারের বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসুচি যা গত সাত বছর যাবৎ পালিত হচ্ছে, উপবৃত্তি প্রদান এসব কাজ প্রাথমিক শিক্ষক সুচারুরূপে সম্পন্ন করছেন। এসব কাজে শিক্ষকদের বাড়তি শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।যদি কোন স্তরের শিক্ষকদের আলাদা গুরুত্ব বা কম গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় তা হবে সমালোচনা যোগ্য দৃষ্টিকুটু বিমাতাসুলভ।
বর্তমান শিক্ষা বান্ধব সরকার শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল কাশরুম, বছরের প্রথমদিনে সকল শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া, উপবৃত্তি প্রদান, ছাব্বিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। শুধু এসবই শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নে যথেষ্ট নয়। শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নে মান সম্মত শিক্ষক এবং শিক্ষকদের মান সম্মত জীবনের ব্যবস্থা করাও সমান দরকার। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে, শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষনীয় বেতন ও মর্যাদা সময়ের দাবি। তাই শুধু বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নয়, প্রাথমিক শিক্ষকদের মনোকষ্ট বিবেচনা নিতে হবে টাস্কফোর্স কমিটিকে। সবচেয়ে ভালো হয় সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রনয়ণ। এতে শিক্ষানীতির অঙ্গীকারও বাস্তবায়ন হবে, হয়ে যাবে সর্বস্তরের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের স্থায়ী সমাধান।
লেখক ঃ শিক্ষক ও কলামিসট
স্বপন তালুকদার
মোবাইলঃ ০১৭৩৫-৩২৯৫৮৪