অযোগ্য শাসকদের যাতাকলে বাংলাদেশ বিজয়ের ৪৪ বছরের সাতকাহন

Jahid-Hasanজাহিদ হাসানঃ এই বছরের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা ৪৫তম বিজয় দিবস উৎযাপন করেছি। আর ৫ বছর পর আমরা ৫০তম অর্থাৎ স্বাধীনতার সূবর্ন জয়ন্তী পালন করব। ৪৪ বছরের অনেক লম্বা সময় পার করে আজ আমরা যেখানে এসে দাড়িয়েছি সেখান থেকে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সাথে আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার যদি একটা আবেগহীন ও বস্তুনিষ্ট পর্যালোচনা ও তুলনা করতে পারি তবেই তা হবে স্বাধীনতার ৪৪ বছরের সত্যিকার মূল্যায়ন। আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালেচনা এবং অতীত ও বর্তমানের যুক্তিসংগত বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই একটা জাতি তথা দেশ ভুল-ত্র“টি সংশোধন করে ভবিষ্যত অগ্রগতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারে। অহমিকা, আবেগ-তাড়িত মনোভাব ও সান্তনামূলক আত্ম-তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি নিয়ে আর যাই হউক বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা, প্রকৃত সত্যকে উম্মোচন করা ও কাংখিত লক্ষ্যে কখনও পৌছানো যায়না।
স্বাধীনতার আগে নেতারা আমাদেরকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই বাংলা( পূর্ব বাংলা )কে “সোনার বাংলায়” পরিনত করবে অর্থাৎ আমরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করব, আমরা গনতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষের মত প্রকাশের তথা বাক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করব, মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটা শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলব, সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্টির সম-অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করব, সামাজিক ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠা করে মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করব, আইণের শাসন প্রতিষ্ঠা করব, বাংলা ভাষা ও বাংগালী সংস্কৃতিকে মনে প্রানে ধারন করে শ্রেষ্ঠ বাংগালী জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাড়াব, বাংলার শাশ্বত প্রকৃতি ও রূপকে সংরক্ষন করে এই বাংলাকে সত্যিই প্রকৃত সোনার বাংলায় সাজিয়ে তুলব। বাংগালী জাতির উল্লেখিত স্বপ্ন, আদর্শ ও লক্ষ্য পূরনে একমাত্র বাধাই ছিল ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ পাকিস্তানী শাসক গোষ্টি। তাই তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম শেষে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি – যার বয়স এখন ৪৪ বছর। অতএব, আজকের বাংলাদেশকে দেখতে হবে ৪৪ বছরে আমাদের শাসকরা স্বাধীনতাপূর্ব স্বপ্ন, আদর্শ ও লক্ষ্য পূরনে অর্থাৎ বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করার ক্ষেত্রে কতটুকু সফল হয়েছেন। আর যদি প্রকৃত অর্থে ( রাজনৈতিক বুলি হিসেবে নয় ) সোনার বাংলায় পরিনত করা সফল হয়ে না থাকেন তবে দেখতে হবে, খুজতে হবে, বুঝতে ও মেনে নিতে হবে তাদের ব্যর্থতা কোথায় এবং কেন ?
স্বাধীনতার পূর্বে আমাদেরকে বুঝানো হয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানের মূল অর্থনৈতিক শক্তিই ছিল আমাদের বাংলার প্রধান সম্পদ পাট, চা ও চামড়া। আমাদেরকে বঞ্চিত করে পাকিস্তানী শাসকরা মূলত এই তিন খাতের আয় দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলছিল। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকদের কাছ থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করে দীর্ঘ ৪৪ বছরে আমরা আমাদের পাট সম্পদকে ( যাকে বলা হত সোনলী আঁশ ) ধ্বংশ করেছি, বাংলার পাট চাষীরা এখন মৃতপ্রায়, পাটকে এখন তাদের গলার ফাঁশ বলা হয়, কোন কোন বছর পাট চাষীরা পাটের ন্যয্য মূল্য না পেয়ে মনের দু:খে কষ্টে-উৎপাদিত পাটকে আগুণে পুড়িয়ে ফেলে। অথচ স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৯ – ৭০ অর্থবছরেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ( আজকের বাংলাদেশের ) পাটখাতে আয় ছিল ৩০০ কোটি টাকা ( যা আজকের মূল্যমানে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশী )। সারা পৃথিবীতে এখন প্লাস্টিক ও পলিথিনের পন্য ব্যবহারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক কাঁচা মালের তৈরী পন্যের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে – যেখানে আজ আমাদের নিজস্ব কৃষিজ সম্পদ পাটের চাহিদার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে উজ্জল। বর্তমানে আমাদের দেশে পাট উৎপাদিত হয় বছরে ৭০-৭৫ লাখ বেল, বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাট রপ্তানী হয়েছে ২০ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩২ বেল, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে দাড়িয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ বেল, অর্থাৎ গত ৪/৫ বছরে পাটের রপ্তানী কমেছে ৫৭%, ফলে অনেক জুট প্রেস বন্ধ হয়ে গেছে, বেকার হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক/কর্মচারী, কি কারণে এখন আবার সরকার পাট রপ্তানী অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাট খাতে দূর্নীতি, জাতীয়করনের মত ভুল সিদ্ধান্ত ও অযোগ্য ব্যবস্থাপনার কারণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজীসহ দেশের বলতে গেলে সব কয়টা পাটকলকেই লোকসান দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এ মাসের ২১ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে প্রকাশ নানা সংকটে পড়ে খুলনা-যশোর শিল্প এলাকার ৩টা জুটমিল বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কয়েকটা বন্ধের দাড়প্রান্তে, ফলে কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছে। আমরা এখন পাটের জন্ম ইতিহাস আবিষ্কার করে বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করার প্রচার ও প্রচারনা নিয়ে পুলকিত হচ্ছি, কিন্তু প্রকৃত অর্থে পাট সম্পদের উন্নয়ন ও পাটচাষীর কল্যানের জন্য কার্যকর ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কোন লক্ষন নাই।
এইতো গেল পাটের অবস্থা। স্বাধীনতার আগে যেখানে আমাদের এখান থেকে বিদেশে চা রপ্তানী হত, এখন দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য চা আমদানী করা হচ্ছে, চামড়া শিল্পও কোন রকমে টিকে আছে। বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পন্য রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ১২৮ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলার, কিন্তু প্রথম ৫ মাসে তা বিগত অর্থবছরের চেয়ে ১.৮১% কম। বর্তমান ট্যানারী শিল্পকে ৪৪ বছরেও কোন সরকার ঢাকার হাজারীবাগ থেকে নির্দ্ধারিত স্থান কালিয়াকৈরে স্থানান্তর করে পরিকল্পিত ও আধুনিকভাবে পুন:স্থাপনের কাজটা সমাধা করতে পারেনি। যে পাট, চা ও চামড়ার আয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলা হচ্ছিল, স্বাধীনতার পর এই তিন খাত আমাদের হাতে আসার পর এই তিন খাতের আয় দিয়েত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করা যেত। আসলে বিগত ৪৪ বছরের শাসনকাল পর্যালোচনা করলে আমাদের শাসকদের তথা যারা দেশ পরিচালনা করছে তাদের এই ক্ষমতা বা যোগ্যতা এমনকি ইচ্ছা ছিল বলেও আমরা বিশ্বাস করতে পারছিনা। স্বাধীনতাপূর্ব ঢাকার আদমজী শিল্পনগরী, ডেমরা শিল্পনগরী, কাঞ্চন শিল্পনগরী, নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা/গোদনাইল শিল্প এলাকা এবং খুলনার খালিশপুর শিল্প এলাকা অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যে ছিল মূখর, এখন এসব এলাকা মৃত ও পরিত্যাক্ত। আগে আমাদের চিনি আমদানী করতে হতনা, এখন চিনিকল প্রায় সবই বন্ধ, খুলনা নিউজপ্রিন্টের কাগজই সংবাদপত্রের জন্য পর্যাপ্ত ছিল, এখন তাও প্রায় অচল। এই কি বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে চলা ?
স্বাধীনতার প্রধানতম স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলব। ৪৪ বছরের পরেও কি তা সম্ভব হয়েছে ? স্বাধীনতার পূর্বে বলা হত পুরো পাকিস্তানের ২২ পরিবার দেশ ও জনগনকে শোষণ করছে, স্বাধীনতার পর এখন আমাদের দেশে ২২ লাখেরও বেশী কোটিপতি পরিবার হয়েছে, শোষণ আগের চেয়ে আরো ভয়াবহভাবে বেড়েছে। অপরদিকে বিভিন্ন খাতে হাজারো পন্যের উপর ( এমনকি শিক্ষার উপরও ) বিভিন্ন মাত্রার কর, ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে এবং জ্বালানী তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাস এর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে সরকারও প্রকৃতপক্ষে জনগনকে আরো বেশী শোষণ করছে / গলা টিপে ধরেছে। দেশের নিজস্ব কৃষিজ বা খনিজ সম্পদের উপর অর্থনীতিকে দাড় করাতে ব্যর্থ হওয়াতেই পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তবতায় বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার জন্য দেশের জনগন (বেসরকারী উদ্যোগতারা ) ধীরে ধীরে পোষাক শিল্প ও জনশক্তি রপ্তানী খাতকে আজ দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানী আয়ের উৎস হিসেবে গড়ে তুলেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ের সরকার বা শাসকরা তাদের উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করেছে সত্য কিন্তু পাট, চা আর চামড়া খাত ধ্বংশ হওয়ার পর গদি নিয়ে কাড়া-কাড়ি / মারা-মারি এবং দূর্নীতি আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট-পাট করা ছাড়া দেশের অর্থনীতির জন্য বিকল্প খাত বা উৎস খুজে বের করা বা সৃষ্টি করার মত কোন যোগ্যতা বা দক্ষতা দেখাতে পারে নাই। বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণে পরিচালিত প্রকল্প খাতেও দূর্নীতি ও অব্যস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশে বিদেশী বিনিয়েগ মারাত্মকভাবে কমে গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য মতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৬০ কোটি ডলার, সেই তুলনায় আমাদের প্রতিবেশী একটা অগনতান্ত্রিক দেশ মিয়ানমারেও ২০১৪ সালে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ৮০০ কোটি ডলার, ভিয়েতনামে এই সময়ে ৭২০ কোটি ডলার। দৈনিক কালের কন্ঠের ৮ ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “বিনিয়োগে হাহাকার”, এফবিসিসিআই এর সভাপতি বলেন বিনিয়োগের বড় বাধা হল গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, জমির উচ্চ মূল্য, ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর এক প্রতিবেদনে বলা হয় নতুন বিদেশী বিনিয়োগ বিগত ৫ বছরে কমেছে সর্বনিু । এর ফলে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেছে। বিভিন্ন দেশে এখন তৈরী পোষাকের চাহিদা বেড়েছে বলে আমরা এ খাতে দেশের ৬০ লাখ মহিলা শ্রমিককে কাজে লাগাতে পেরেছি বটে, যদি তা না হত তবে এই বিশাল বেকার মেয়েদের কি অবস্থা হত ? বিভিন্ন দেশে গৃহদাসী হিসেবে রপ্তানী করা ছাড়া আর কি কোন উপায় থাকত ? অপরদিকে বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ তাদের দেশের উন্নয়ন ও রক্ষনাবেক্ষন কাজের জন্য বিদেশী শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল হয়েছে বলে আমরা লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশে রপ্তানী করতে পেরেছি, এটাকে জনশক্তি রপ্তানী বলা হলেও প্রকৃত অর্থে এটা বিদেশের কাছে শ্রম বিক্রি করা ছাড়া আর কিছুই নয়, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ নাই বা খুবই সীমিত বলে আমরা অসম্মানজনক এই খাতে আমাদের দেশের যুবকদের বিদেশে পাঠাচ্ছি, দেশে চাকুরী/কাজ-কর্মের সুযোগ নাই বলে আবার অবৈধভাবেও হাজার হাজার বেকার যুবক বিদেশে পারি দিতে গিয়ে মাঝপথে মারা যাচ্ছে বা বিভিন্ন দেশে বন্দি হচ্ছে, এমনকি এখন বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীর নামে মেয়েদেরকেও গৃহদাসী হিসেবে পাঠাতে শুরু করেছি ? সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা স্বাধীন দেশের জন্য এটা কি সম্মানজনক বা মর্যাদাশীল আয়ের উৎস ? বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার এটাই কি যথার্থ প্রমান ? সস্তা ও সহজলভ্য শ্রম থাকায় এবং লাখ লাখ বেকার থাকার কারণে আমরা উল্লেখিত দুই খাতে এখনও টিকে আছি, কিন্তু এখানেও আমাদের প্রতিযোগী দেশ রয়েছে। বিকল্প ও ক্ষনস্থায়ী চাহিদার উপর নির্ভর হয়ে অর্থনীতিকে বেশীদিন সচল করে রাখা যায়না। দেশের আর এক প্রকৃতিক সম্পদ ছিল মাটির নিচের গ্যাস, এটাও এখন নি:শেষ হতে চলেছে, বাসা বাড়ি ও খাবার হোটেলে ২৪ ঘন্টা গ্যাসের অতি ও অপব্যবহার নিয়ন্ত্রনের কোন ব্যবস্থা ছিলনা, বরঞ্চ গ্যাস নিয়ন্ত্রক সংস্থা তিতাস ও বাখরাবাদে চলছে শুধু কোটি কোটি টাকার দূর্নীতি। আমাদের “দেশপ্রেমিক” সরকার তথা শাসকদের দেশ চালাতে অদূরদর্শিতার আর একটা নমূনা হল মাটির নিচের মূল্যবান এই সম্পদকে আরো দ্রুত শেষ করার জন্য কার্বন নি:সরন তথা পরিবেশ দূষণ কমানো নামে প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহনকে গ্যাসে রূপান্তরিত করার আত্মঘাতি নির্দেশ / সুযোগ করে দেওয়া, গত ১০ বছর যাবৎ লাখ লাখ যানবাহন জ্বালানী গ্যাস ব্যবহার করে মাটির নিচের গ্যাসের মওজুদ শেষ করে ফেলেছে, এখন সাধারন জনগন বাসা-বাড়িতে রান্নার কাজের জন্য এবং শিল্প-কারখানা চালাতে আর গ্যাস পাচ্ছেনা। অপরদিকে নাসার স্যাটেলাইটের গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের এক বৈঠকে সম্প্রতি জানানো হয় যে এই সময়ে বাংলাদেশে দূষণের হার বেড়েছে শতকরা ৮০ ভাগ। ঢাকাসহ সারা দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ এবং নদ-নদীর পানিকে যেভাবে আরো অসংখ্য কারণে দিন-রাত দূষিত করা হচ্ছে সেখানে গাড়ির ইঞ্জিনে গ্যাস ব্যবহার করে দূষণ কমানোর চিন্তা-ভাবনা যেমন হাস্যকর বা তামাসা তেমনি আত্মঘাতিও বটে। অপর সম্পদ মাটির নিচের কয়লা, এই সম্পদেরও উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য আজ পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা নিতে পারছেনা, এমনকি দীর্ঘ ৪৪ বছরে একটা কয়লা নীতিও প্রনয়ন করা যায়নি, বরং বিদেশ থেকে কয়লা আমদানী করে দেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ সুন্দরবনকে ধ্বংশ করার জন্য সেখানে ( রামপালে ) ভারতের সহযোগিতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করা হচ্ছে। এমনিতেই বিভিন্ন মানুষ-সৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও বন্য প্রানীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমে যাচ্ছে, সুন্দরবন এখন জলদস্যু আর বনদস্যুদের আস্তানা ও অভয়াস্থলে পরিনত হয়েছে। অথচ আমাদের বর্তমান বনমন্ত্রী বলেছেন সুন্দরবনের বাঘরা নাকি ভারতে বেড়াতে যাওয়ায় সেখানে বাঘের সংখ্যা এখন কমে গেছে। এই হচ্ছে আমাদের শাসকদের “দেশপ্রেমিক ও জ্ঞানগর্ভ” বক্তব্য এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মেধা ও যোগ্যতা।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান দূর্নীতি ও অযোগ্য ব্যবস্থাপনার কারণে একটানা শুধু লোকসান দিয়েই যাচ্ছে (বিমানমন্ত্রী অবশ্য বল্লেন ৪৪ বছর পর এই প্রথমবার নাকি বাংলাদেশ বিমান লাভের মূখ দেখেছে ), যেখানে যাত্রীর অভাব নাই, সীট চাইলে সীট পাওয়া যায়না সেখানে লোকসান হবে কেন ? পৃথিবীর কোন এয়ারলাইনস এর এমন লোকসানের নজির নাই। একই অবস্থা রেল ও সড়ক পরিবহনেও ( বি,আর,টি,সি )। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের পর উত্তরাধিকার সূত্রে যে রেল লাইন ছিল ৪৪ বছরে মাত্র ১৪২ কিলোমিটার নতুন রেল লাইন বসানো হয়েছে, স্বাধীনতার আগে এ দেশের ৭.৫ কোটি মানুষের কাছে রেল যোগাযোগই ছিল সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় ও সহজলভ্য, কিন্তু স্বাধীনতার পর লোকসংখ্যা এখন ১৬ কোটি হওয়ার পরেও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা মূখ থুবড়ে পড়ে আছে, যেখানে এখন এর আরো সম্প্রসারন বা আধুনিকায়ন হওয়ার কথা বরং সারা দেশে এখন ১৫৫ টা ছোট-বড় রেল স্টেশন বন্ধ হয়ে আছে-যাকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষের ছোট ছোট ব্যবসা তথা রুটি-রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছিল। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ত সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এখন গরু-ছাগল বিশ্রাম নেয়, ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে মূলবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় দেশে সরকার নাই, রাষ্ট্রের ও জনগনের এসব ক্ষয়-ক্ষতি ও লোকসান দেখার কেউ নাই। অপরদিকে স্বাধীনতার আগে চলাচলের ও পন্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থাই ছিল নৌপথ, কিন্তু বিগত ৪৪ বছরে তার প্রসার, উন্নয়ন বা আধুনিকায়নের পরিবর্তে ঢাকার বুডিগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালি নদীসহ সারা দেশের নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট করে, দখল করে বাংলার ঐতিহ্য ( যে নৌকা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ) নৌপরিবহন ব্যবস্থাকে চিরতরেই শেষ করে দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। সড়ক যোগাযোগে যানজট ও কালক্ষেপনের কারণে নৌপথ হতে পারত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় বা শিল্পাঞ্চলে মালামাল পরিবহনের অন্যতম বিকল্প পথ, এজন্য ইতমধ্যে বেসরকারী উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌ টার্মিনাল/স্টেশন তৈরী হচ্ছে। এখন সরকারের উচিত বছরের পর বছর ধরে জমে যাওয়া পলির কারণে নদ-নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য বিরামহীম ড্রেজিং এর ব্যবস্থা করা, অথচ মাঝে-মধ্যে ছিটে-ফুটো ড্রেজিং এর কাজ করে শুধু রাজনীতি করা হয় ( আমরা করছি, অন্যরা কেউ করেনি )। নদ-নদী, খাল-বিল দখল ও ভরাট করার কারণে আজ দেশে মাছের আকাল সৃষ্টি হয়েছে, এখন বাংলাদেশের নিজস্ব বহু প্রজাতির মাছের বংশ নির্বংশ হয়ে গেছে, জাতীয় সম্পদ/মাছ ইলিশেরও অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে, এত নিষেধ, আদেশ/বাধা সত্তেও বড় হওয়ার আগেই ইলিশের পোনা/বাচ্চা ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার আগে কি বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল এবং মৎস সম্পদের এই অবস্থা ছিল ? ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী লুটেরা ও ডেভলেপর কোম্পানীর নামধারী ভূমি দস্যুরা আজ বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর-জলাশয় সব দখল করে ভরাট করে ফেলছে, এর ফলে জলজ সম্পদসহ দেশের ও জনগনের কি মারাত্মক ও ভয়াবহ ক্ষতি ও পরিনতি হবে তা জানা ও বুঝার পরেও নিজের স্বার্থ ও সুবিধা লাভের জন্য এরা এই আত্ম-ঘাতি প্রবনতা থেকে বিরত বা ক্ষান্ত হচ্ছেনা, এই অপতৎপরতা দেখা ও রোধ করার জন্য সরকারী বিভাগ/দপ্তর, আইণ ও লোকবল থাকা সত্তেও কোন প্রতিকার হচ্ছেনা, মাঝে-মধ্যে লোক-দেখানো অভিযান চালানো হয়, কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার একই অবস্থা। বনদস্যূরা গাছ-পালা কেটে দেশের বন-জঙ্গল উজার করে দিচ্ছে, ফলে বাংলাদেশ থেকে এখন বহু প্রজাতির পশু-পাখি এবং বহু জাতের ফলমূলসহ বনজ তথা ভেসজ উদ্ভিদ ও লতা-গুল্ম বিলীন হয়ে গেছে, শীত মৌসুমে এখন অতিথি পাখির আগমন আগের মত নাই। ভূমি দস্যূরা পাহাড় কেটে জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মশালায় জানানো হয় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আমাদের দেশের ৩৪ শতাংশ জীববৈচিত্র এখন ধ্বংশের সম্মূখীন, নিজ দেশের জলবায়ূ ও প্রকৃতি/পরিবেশকে যেখানে ঠান্ডা মাথায় আমরা নিজেরাই ধ্বংশ করে দিচ্ছি সেখানে বিশ্ব জলবায়ূ তথা পরিবেশ সংক্রান্ত পুরস্কার আমাদেরকে কোন্ কাজের জন্য বা কেন দেওয়া হয় এর জবাব জানা নাই ? এসব পেয়ে আমরা ধন্য হই এবং এ নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার সুযোগ পাই মাত্র। এই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ূ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশের দৈনিক কালের কন্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এবং এ জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেন, সাথে সাথে তিনি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব পাবলিক হেল্থ এ্যাসোসিয়েশনের ১৫টি উন্নত ও ২০টি উন্নয়নশীল দেশের উপর পরিচালিত জরীপের যে প্রতিবেদনটি গনমাধ্যমকর্মীদের হাতে তুলে দেন তাতে বলা হয়েছে ৩৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। ১৮টি সূচকের মধ্যে ১৪টিতেই বাংলাদেশের কোন কার্যক্রম নাই, ৪টি সূচকে সীমিত কিছু কর্মসূচি ও পরিকল্পনা আছে, কিন্তু কোন বাস্তবায়ন বা কার্যক্রম নাই। এই মিথ্যা ও ঠকবাজির রাজনীতিই চলছে ৪৪ বছর যাবত। এভাবেই আমাদের শাসকরা এখন বাংলাদেশেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে রেলের প্রায় ৪ হাজার একর জায়গা বেদখল হয়ে আছে। সবই হয়েছে ও হচ্ছে সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতা ও মাস্তানদের দ্বারা। দেশের সর্বক্ষেত্রেই চলছে এই জবরদখল ও অরাজকতা। স্বাধীনতার আগে ঢাকার রেসকোর্সে হত ঘোড়দৌড়, তাও উপভোগ্য ছিল, স্বাধীনতার পর এটা হয়েছিল রাজধানীবাসির জন্য নির্বিঘেœ সময় কাটানো, প্রাত:ভ্রমন তথা বুকভরে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য সোহরোয়ার্দী উদ্যান, যা এখন ধীরে ধীরে পরিনত হয়েছে নেশাখোর ও অন্যান্য অপরাধীদের এবং তথাকথিত প্রেমিক যুগলদের অবৈধ যৌনাচারের লীলাভূমি, ফুসকার দোকান আর জনসভার স্থানে, গাছ-গাছড়াসমৃদ্ধ সবুজ শ্যামল নির্মল পরিবেশ এখন আর সেখানে নাই, কোন শিক্ষক/ভদ্রলোক এখন আর এখানে ভুলেও যায়না। এমন অবস্থা ঢাকার রমনা পার্ক, ওসমানী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, ন্যাশানাল বোটানিক্যাল গার্ডেন, জাতীয় উদ্যান, চিড়িয়াখানাসহ দেশের সবকয়টা পার্ক/বিনোদনকেন্দ্র/লেকপারের অবস্থা। কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত বিশ্বের সর্ববৃহৎ, এ নিয়ে গর্ব করি এবং ৮ম আশ্চর্য হিসেবে তালিকাভূক্ত করার জন্য গনভোটে অংশগ্রহন করি, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো অনেক মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ এ দেশের ছিল, যাকে ঘিরে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে পারত, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হত, বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের উৎস বাড়ত, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও এখন পর্যন্ত পর্যটনের জন্য আমরা কোন অবকাঠামোই তৈরী করতে পারিনি। ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশের দেশীয় “পর্যটকদের” এইসব স্থানে গণহারে ভ্রমনের/চাপের কারণে এগুলোর আকর্ষণ, সৌন্দর্য ও অস্তিত্বই এখন ধ্বংশ হওয়ার পথে। বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করতে না পারায় এ খাতে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরী হচ্ছেনা, তবে দেশীয় সৌন্দর্য্য পিপাশুদের ঘিরে একশ্রেনীর লোকের হোটেলব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা এখন জমজমাট, এখানে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন নাই, এমনকি রাজস্ব আয়ের জন্য দেশীয় পর্যটকদের কাছ থেকেও টিকিট বা বিভিন্ন স্পটের জন্য একটা নির্দিষ্ট ফি আদার করা যেত। শাসকরা এভাবেই বাংলাদেশেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সস্তা বাহবা নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক বুলি আওড়িয়ে শাসক দল এখন বলে বেড়ায় আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হওয়ার দাড়প্রান্তে এসে গেছি, আমাদের মাথাপিছু গড় আয় এখন এক হাজার ডলারেরও বেশী, কথাটা গানিতিকভাবে সত্য হলেও এর মধ্যে যে অসারতা ও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে তা জনগন ঠিকই বুঝে। একজন দরিদ্র লোক যদি দৈনিক আয় করে ২০০ টাকা আর একজন ধনী লোক যদি আয় করে ১০০০ টাকা তবে এই দুইজনের মাথাপিছু গড় আয় হবে ৬০০ টাকা, এই হিসেবে যদি বলা হয় দেশের মানুষের গড় আয় বেড়েছে তবে নিজেদেরকেই নিজেদের ধোকা দেওয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে আরো বলা হয় এখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, কত ডাহা মিথ্যা কথা ! স্বাধীনতার আগে এই দেশের একজন নিন্ম পদমর্যাদার সরকারী কর্মচারীর মাসিক বেতন ছিল ৭৫ – ১৫০ টাকা, এই আয় দিয়েই সে সারা মাস স্বচ্ছন্দ্যে চলতে পারত, ঘুষ খেতে হতনা বা ধার-দেনা করতে হতনা। কারণ তখন নিত্যপ্রযোজনীয় পন্যের দাম ছিল কম এবং টাকার মান ও ক্রয় ক্ষমতা ছিল বেশী। কিন্তু এখন একই পদমর্যাদার একজন কর্মচারীর মাসিক বেতন ৫,০০০-১০,০০০ টাকা হওয়ার পরেও মাস চলতে তাকে দূর্নীতি করে বাড়তি আয় করতে বা সংসার চালাতে ধার করতে হয়। কারণ স্বাধীনতার পূর্বের সময়ের চেয়ে বর্তমানে নিত্যপ্রযোজনীয় পন্যের অস্বাভাবিক ও আকাশচুম্বি মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে উপার্জিত টাকার মান ও ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। এখন সাধারন মানুষ খরচের বাজেট কমাতে বা প্রয়োজনীয় পন্য আগে যা কিনত তার চেয়ে পরিমানে কম কিনতে বাধ্য হচ্ছে। তারপরেও শাসক দল বলে এখন দেশের মানুষ নাকি আগের চেয়ে ভাল আছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে !
আমাদের সরকারের তরফ থেকে আরো বলা হয় বাংলাদেশে এখন দারিদ্র সীমার হার ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, অথচ অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে এখন ৫১ শতাংশ লোক দারিদ্র সীমার নীচে আছে, যদি তাই না হত তবে এখনও ঈদের সময় যাকাতের কাপড় নিতে শত শত লোক জড়ো হয় কেন বা ঠেলা-ঠেলিতে অগনিত সংখ্যায় পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে জীবন দিতে যায় কেন ? স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের শাসন ও শোষণকালে এই দেশে এমন অবস্থা কি কখনও হয়েছে ? অর্থাৎ ঐ সময় এই বাংলার মানুষেরও জীবন ধারনের জন্য এত কঠিন ও কঠোর বাস্তবতার সম্মূখীন হতে হয়নি, তাহলে ৪৪ বছর পার করেও আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারন তথা দরিদ্র জনগনের ভাগ্যোন্নয়ন করতে ব্যর্থ কেন ? স্বাধীনতার অন্যতম ও প্রধান আকাংখা ছিল এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, ৪৪ বছরেও কি এই মুক্তি অর্জিত হয়েছে ? তবে স্বাধীনতা পেয়ে ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে এক শ্রেনীর মানুষের যারা অবৈধ উপায়ে ব্যবসা করে আয় করছে, যারা মওজুতদারী / অতি মুনাফা করে বেশী আয় করছে, যারা লাখ লাখ শ্রমিকের সস্তা শ্রমকে পুজি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে, যারা ঘুষ আর দূর্নীতির মাধ্যমে টাকা কামাচেছ, যারা ভুিমদস্যু, যারা বনদস্যু তাদের আয় বেড়েছে, ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে, সরকারী মহলের কথায় তারাই ভাল আছে, তাদেরকে নিয়েই হয়ত দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
দূর্নীতি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যধি, রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজের এমন কোন স্তর নাই যেটাকে দূর্নীতি গ্রাস করে নাই, এখন শিক্ষা ও সাংবাদিকতা পেশাতেও দূর্নীতি ঢুকেছে যেখানে বিবেকবান মানুষ তৈরী হবে এবং যারা সমাজের দর্পন বা বিবেক। দূর্নীতিতে বাংলাদেশ পর পর ৩ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে এখন তা একই সূচকে আছে, কোন দেশ র্দূর্নীতিতে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের সূচক নিচে নেমে আসে, তার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে দূর্নীতি কমেছে, বরং দূর্নীতি এখন বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, দূর্নীতি এখন নীতিতে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো দূর্নীতিতে দেওলীয়া হওয়ার পথে, শেয়ার বাজারে মহা দূর্নীতি ও কেলেংকারীর ঘটনা ঘটছে, দেশের বিমানবন্দরগুলো এখন স্বর্ন চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ ( যাকে মানুষের তথা অসহায়ের বন্ধু বলা হয় ) তারা এখন এ দেশে সমস্ত দূর্নীতির জন্মদাতা বা মাতা হিসেবে পরিনত হয়ে উঠেছে, টাকা খেয়ে আসামীকে বাদী, বাদীকে আসামী বানাচ্ছে, অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামী বানিয়ে রমরমা গ্রেফতার বানিজ্য চালু করেছে, আইণ-আদালতে এখন টাকার বিনিময়ে বিচারের নামে প্যাকেজ ডিল করে পছন্দমত রায় নেওয়া হয়, সাধারন মানুষের ন্যায় বিচার ও সময়মত বিচার পাওয়া এখন দূরহ ও ভাগ্যের ব্যাপার। টাকার বিনিময়ে আইণ-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এখন “কন্ট্রাক্ট কিলিং” এর মত জঘন্য অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছে, আর বন্দুক-যুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডতো হরহামেশাই চালিয়ে যাচ্ছে, আইণ-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম ও খুনের ঘটনাও দেশে এখন অহরহ ঘটছে। এই অবস্থা পর্যালোচনা করলে ন্যায় বিচার ও আইণের শাসন প্রতিষ্ঠা করা – স্বাধীনতার অন্যতম এই প্রধান আকাংখাও কি ৪৪ বছরে পূরন হয়েছে ? স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের শাসন ও শোষণকালে কি এ দেশের জনগন এমন বিভিষীকাময় পরিস্থিতিতে পড়েছিল বা দেখেছিল ? তাহলে ৪৪ বছরের শাসনামলে আমাদের শাসকরা এ দেশের জনগনের জন্য কি সূখের ব্যবস্থা করেছে ? দেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে কি এই কলংক নিয়ে ?
স্বাধীনতা পূর্ববর্তি সময়ে এই বাংলার মানুষ রাস্তায় নির্বিঘেœ ও নির্ভয়ে চলতে পেরেছে, রাতে দরজা খোলা রেখেও ঘুমাতে পেরেছে, আর এখন দিনের বেলায়ও দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকা নিরাপদ নয়, রাস্তায় বের হলে জান-মাল নিয়ে ঘরে ফিরে আসতে পারবে কিনা এই আশংকা দেখা দিয়েছে। ছিনতাই, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি এখন এ দেশের রাস্তাঘাটে অতি পরিচিত ও প্রাতিষ্ঠানিক আতংকের নাম, এখন বাসা-অফিস কোথাও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নাই, পুলিশও এখন বাসা-অফিসে কারো নিরাপত্তা দিতে পারছেনা, তাই বলছে সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসাতে-যার ব্যবসা এখন সবচেয়ে বেশী জমজমাট। বলা হয় এ দেশে এখন ১২০০ মানুষের জন্য ভাগে একজন পুলিশ, কিন্তু প্রতিদিন ১২০০ মানুষই কি ১২০০ অপরাধ করে যে পুলিশের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয় ? এমন জঘন্য ও অসহায় অবস্থা কি এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার আগে ছিল ? তাহলে ৪৪ বছরে এ দেশের শাসকরা জনগনের জন্য কি সূখ-স্বাচ্ছ্যন্দের ব্যবস্থা করতে পেরেছে ? আমাদেরকে কি এমন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিল ?
প্রতিদিন দেশে নারী নির্যাতন ( যৌন হয়রানীসহ ) ও খুনের ঘটনা ঘটছে – যা কখনও কখনও খুবই বিভৎস, নৃশংস ও লোমহর্ষক এবং এই আপরাধের প্রবনতা দিন দিন মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে – যা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের মানবতাবিরোধী অপরাধকেও হার মানাচ্ছে ( বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে এই বছর নভেম্বর পর্যন্ত ৩৬ জনকে পুলিশী নির্যাতন ও ৮২ জনকে হত্যাসহ মোট ৪১১৬ জন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘঠেছে )। ঐ সময় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা যা করেছিল তা একটা বিশেষ সময়, পরিস্থিতি ও ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৯ মাস যাবৎ করেছে ( যে কাজকে আমরা গনহত্যা তথা যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে সেই সময়কার এ দেশেীয় অপরাধীদের এখন ৪৪ বছর পরেও বিচার করছি )। কিন্তু এখনতো আমাদের নিজেদের স্বাধীন দেশ, আমরা একই মায়ের জাত ভাই-বোন, এখন আমরা কিভাবে ও কেন প্রতিনিয়ত আমাদের মা-বোনদের প্রতি এমন অন্যায়-অবিচার করতে পারছি ? মুক্তিপন আদায়ের জন্য মানুষকে এমনকি অবুঝ, নিরীহ শিশুকেও অপহরন করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, কত মা, কত নারী, কত সন্তানের বুক ও কোল চিরতরে খালি করে দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার পূর্বে এমন মানবতাবিরোধী বিভিষীকাময় অবস্থা কি এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে ? তাহলে কেমন সূখ ও শান্তির স্বপ্ন দেখিয়ে আমরা জনগনকে স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত এত আত্ম-ত্যাগ করতে উদ্ভূদ্ধ করেছিলাম ? বাংলাদেশ কি এই কালিমা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ?
প্রতিদিন এখন চারিদিকের হত্যা, খুন ও পৈশাচিকতার মত অপরাধ দেখলে মনে হয় দেশের জনগন যেন অসহিষ্ণূ ও অপরাধপ্রবন এবং হিংস্র ও সন্ত্রাসী জাতিতে পরিনত হয়েছে, তুচ্ছ ঘটনার জের হিসেবেও একজন আর একজনকে হত্যা করে ফেলছে, চোর/পকেটমার সন্দেহে প্রকাশ্যে কাউকে পিটিয়ে দেহ থেকে জানটা বের না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়না (কয়েকদিন আগে পিটিয়ে মারল নারায়নগঞ্জে ৮ জনকে ), চারিপাশে দাড়িয়ে অন্যরা এই নৃশংসতা উপভোগ করে, কেউ বাঁচাতে যায়না, কেউ বলেনা যে আর মেরনা, এবার পুলিশের কাছে দিয়ে দাও। স্বামী স্ত্রীকে খুন করছে, প্রেমিক প্রেমিকাকে খুন করছে, ভাই ভাইকে খুন করছে, এমনকি শিশু কিশোররাও এখন সহপাঠি, বন্ধু বা খেলার সাথীকে খুন করতে দ্বিধা করছেনা। কোন মানুষ রাগ করে একটা গ্লাস ভাঙ্গলে তা আবার কিনে আনা যায়, কিন্তু একটা মানুষের জীবন শেষ করে দিলে কি আর একটা জীবন মানুষ ফিরিয়ে দিতে পারে ? পারেনা বলেই যারা কারো জীবন নেয় ইসলামী শরীয়া আইণে তার একমাত্র বিচারও মৃত্যুদন্ড। অবৈধ পথে চোরাচালান হয়ে এবং দেশের বিভিন্ন গোপনীয় স্থানে তৈরী হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র, সন্ত্রাসী ও খুনিদের হাতে এখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি, অথচ এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে র‌্যাব-পুলিশের নাই কোন বিশেষ তৎপরতা। খুন করা বা জানে মেরে ফেলা যেন এখন বাংলাদেশে ডাল-ভাত। এর প্রধানতম কারণ মানুষ মনে করে খুন করে এখন পার পাওয়া যায় বা কোন কোন সময় খুনের জন্য মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীও রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রান ভিক্ষা পেয়ে যায়, বিচার শুরু হলে খুনের আসামীকেও জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়, জামিনে বের হয়ে সে বাদী বা সাক্ষিকে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে না হয় তাদেরেকেও মেরে ফেলার হুমকী দেয়। সামাজিক মূল্যবোধ, পারিবারিক ও পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালবাসা, দয়া-মায়া সবই যেন আমাদের সমাজ থেকে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমরা দেশকে দ্রুত মধ্য যুগীয় বর্বতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সীমান্ত দিয়ে অবাধে ফেনসিডিল ও ইয়াবাসহ নেশাজাতীয় পন্য ও ঔষধ দেশে প্রবেশ করছে, যা যুব সমাজ তথা উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে অংকুরেই ধ্বংস করে দিচ্ছে, প্রথম প্রথম লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে ইয়াবা সম্রাট/সম্রাজ্ঞীকে ধরার খবর প্রকাশ করেছিল, এখন এই ব্যবসায় এম,পি, প্রশাসনের লোক, পুলিশ কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েছে, তাই এর বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। শাসক দল ও তাদের সমর্থকরা বলে পাশ্চাত্য/উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অপরাধের মাত্রা/সংখ্যা অনেক কম। অথচ পাশ্চাত্য সমাজ অবাধ মেলা-মেশায়, বহু বিবাহ, অবাধ যৌনাচার ও নেশা ( মদ্যপান ) গ্রহনে অভ্যস্থ এবং যে কেউ অবাধে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে বা রাখতে পারে বলে সেখানে আপরাধের ঘটনা ও প্রবনতা স্বাভাবিকভাবেই বেশী। কিন্তু আমাদের সমাজ পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আবরনে আবদ্ধ, এখানে নেশাগ্রস্ত হয়ে প্রকাশ্যে কেউ রাস্তায় মাতলামি করতে পারেনা, প্রকাশ্যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেনা, যুগ যুগ ধরে ( এমনকি স্বাধীনতার আগেও ) আমাদের সমাজ তথা দেশের মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে আসছে। কাজেই পাশ্চাত্য দেশের অপরাধের সাথে আমাদের দেশের অপরাধকে তুলনা করে দায়মুক্তি পাওয়ার কোন সুযোগ নাই। অথচ পাশ্চাত্য সমাজে অপরাধকে যেভাবে মোকাবেলা করা হয় এবং আপরাধীর বিচার করা হয় আমাদের দেশে কি তা হয় ? আমাদের সাধু-শাসকরা এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের সাথে আমাদের তুলনা দেয়না।
আমাদের সমাজে ৪৪ বছর পরে পরিবর্তন এসেছে প্রেম-প্রীতি/ভালবাসার ক্ষেত্রেও, পারষ্পরিক ভালোবাসা, পবিত্রতা ও মানবিকতা এখন আর নাই, এখন প্রেম মানে দৈহিক সম্ভোগ। প্রগতিশীলতার নামে অবাধ মেলা-মেশার সুযোগে নারী-পুরুষরা এখন অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি কর্মস্থলেও নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, চারিদিকে পরকীয়া প্রেমের অভিশাপ- যার জন্য প্রায়ই প্রান দিতে হচ্ছে স্বামী, স্ত্রী বা সন্তানদের। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখন একজন আর একজনের বয়-ফ্রেন্ড ও গার্ল-ফ্রেন্ডে পরিনত হয়েছে, যে সম্পর্কের কোন স্থায়িত্ব নাই, ভোগ-সম্ভোগের পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, ইদানিং ইন্টারনেটের যুগে এসব অবৈধ ও অসামাজিক কাজের দৃশ্য মোবাইলে ধারন করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েদেরকে অবাধে ব্ল্যাক-মেইলিংও করা হচ্ছে। অর্থাৎ কোথায় ও কোন্ নরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের সমাজকে কেউ জানেনা। এ ব্যাপারে দেশের শাসক ও সমাজপতিদেরও কোন মাথা-ব্যথা আছে বলে মনে হয়না। এমন পরিস্থিতি কি স্বাধীনতার আগে এ দেশে ছিল ? এমন বাংলাদেশ নির্মানের জন্য কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম ? তাহলে এজন্য কে ও কারা দায়ী, এর কারণ কি, নিশ্চয়ই স্বাধীনতা এ জন্য দায়ী নয়। সামাজিক অবক্ষয়কে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই আমাদের যারা শাসক, সমাজপতি, শিক্ষক, রাষ্ট্রনায়ক তারাই দায়ী। নিজেদের কর্মকান্ড, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নৈতিকতা ও আদর্শহীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিশাপে গোটা জাতিকে অসহিষ্ণূ, বেপরোয়া, উশৃংখল ও মানবতা বর্জিত জীবে পরিনত করে তুলছে। তারপরেও বলা হচ্ছে আমরা তথা দেশ নাকি আগের তুলনায় এখন অনেক ভাল ও সূখে আছে।
আমরা গনতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষের মত প্রকাশের তথা বাক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করব বলে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম, ৪৪ বছরেও কি তা করতে পেরেছি ? মূখে নিজেদেরকে পাশ্চাত্য গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুসারী বল্লেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি পাশ্চাত্যের গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণূতা ও সংস্কৃতির লেশমাত্র খুজে পাওয়া যায় ? পাকিস্তানী শাসকরা গনতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে কান লুই এর বিশ্বখ্যাত নক্সা অনুযায়ী শেরেবাংলা নগরে যে জাতীয় সংসদ তৈরী করে দিয়েছিল তার স্থাপত্য সৌন্দর্য নিয়ে আমরা এখন গর্ব করতে পারি সত্য, কিন্তু এখানে কি এখন প্রকৃত গনতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে ? আমাদের দেশেরই একটা গবেষণা সংস্থা এটাকে এখন “পুতুল নাচের নাট্যশালা” বলে উল্লেখ করেছে। ৪৪ বছরের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় এখন আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিকৃত গনতন্ত্র এবং নির্বাচনকে পরিনত করা হয়েছে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য একটা প্রহসনমূলক রাজনৈতিক তামাসা বা নাটক। সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিবর্তে এখন চলছে হিংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি, একদল রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন করে যেভাবেই হউক ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, অপরদিকে বিরোধী দল সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আন্দোলনের নামে সাধারন ও নিরস্ত্র মানুষকে জালিয়ে পুড়িয়ে মারে। এখন দেশের সকল শ্রেনী বা পেশার লোকজনই এই অসুস্থ ও অগনতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের শিকারে পরিনত হয়ে বা প্রভাবে পড়ে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অসহনীয় ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। শিক্ষকরাও ( যারা দেশের ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য নাগরিক গড়ে তুলবেন ) পদ, পদোন্নতি ও সুবিধা পাওয়ার আশায়/লোভে আজ দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে দলাদলি নিয়ে ব্যস্ত। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ, ছাত্ররা এখন শিক্ষক পেটাতে কোন লজ্জা বা দ্বিধাবোধ করেনা। কারণ শিক্ষক এখন আর ছাত্র/ছাত্রীদের কাছে শ্রদ্ধা করার মত মহত ব্যক্তিত্ব বা একটা নিরপেক্ষ আদর্শ বা মডেল নয়। ছাত্ররাতো ইতমধ্যে রাজনৈতিক দলাদলি ও কোন্দলে ধ্বংশের শেষ প্রান্তে পৌছে গেছে, এখন ছাত্রদের হাতে থাকে বই-খাতার পরিবর্তে চাপাতি, রাম দা ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের ছাত্র/যুব সংগঠন শিক্ষাঙ্গন ও অন্যান্য স্তরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। লেখা-পড়ার পরিবর্তে দলাদলি, টেন্ডারবাজি, প্রতিপক্ষের সাথে মারামারি ও ভাগ-বাটোয়ারা বা প্রভাব বিস্তারকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সারাক্ষন লিপ্ত থাকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছাত্রজীবনের সহপাঠীর মত মধুর ও অকৃত্রিম বন্ধু আর কেউ নয়, কিন্তু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন রাজনৈতিক দলাদলির কারণে সবচেয়ে প্রিয় এই সহপাঠীরাও একে অপরকে কুপিয়ে জখম করছে, খুন করছে। স্বাধীনতার আগেও এ দেশে ছাত্র রাজনীতি ছিল। আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ছিল, পাকিস্তানের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনীতি ছিল, কিন্তু তখনওতো ছাত্রদের মধ্যে এমন সশস্ত্র দলাদলি, মারামারি ছিলনা, শিক্ষকরাও কখনো রাজনীতির লেজুরবৃত্তি করতনা। যে কারণে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল তখন অহংকার করার মত মধুর ও শ্রদ্ধাপূর্ন। স্বাধীনতার পর চালু হয়েছে ভোগের রাজনীতি, লুট-পাটের রাজনীতি, কাকে মেরে কাকে ঠকিয়ে কে খাবে, কে পাবে এই রাজনীতি। ৪৪ বছর আগে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হয়েছিল কি এ জন্য ? তাই এখন প্রশ্ন জাগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের “স্বাধীনতা” ছিনিয়ে আনা হয়েছিল নাকি লুটে-পুটে, ছিড়ে-ফেরে খাওয়ার জন্য এবং যার যা খুশি যেমনে ইচ্ছা তেমনে চলার জন্য পাকিস্ত