সিলেটি-ননসিলেটি বিভাজন প্রমোট করছেন গাফফার চৌধুরী
মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ক’দিন আগেও এমন একটা সময় ছিলো যখন আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো ‘ট্রেডমার্কড’ গুণীজনকে সম্মান জানাতে বিশেষ কোন দল বা মতের অনুসারী হবার প্রয়োজন হতো না। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী”– এই একটিমাত্র গান লিখেই যিনি হয়েছিলেন বিখ্যাত, গঠনমূলক সমালোচনাধর্মী কলাম হাতখুলে লিখে যিনি ছিলেন দেশে-বিদেশে প্রবল জনপ্রিয়, বছর খানেক ধরে কী এমন জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি ! ‘না ফেরার দেশে’ চলে যাবার আগে কেন তিনি বারেবারে ‘নায়ক থেকে ভিলেন’ রূপে আবির্ভূত হচ্ছেন, তা বোধগম্য হচ্ছেনা বিলেতে তাঁর কাছের মানুষদের কাছেই।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর বয়স হয়েছে সন্দেহ নেই। যেহেতু প্রবাসে থাকেন যুগ যুগ ধরে, তাই একটু যত্নবান হলেই পারতেন জীবনের শেষবেলায় শেষদিনগুলি প্রবাসীদের ভালোবাসায় সিক্ত থেকে সসম্মানে কাটিয়ে দিতে, এমন আক্ষেপ তাঁরই ভক্ত-অনুরাগীদের। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বয়সের ভারে হোক আর অজানা কোন অতৃপ্তি থেকে হোক, মাইক্রোফোন পেলেই আজকাল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন তিনি। লাগামহীন উল্টাপাল্টা উদ্ভট অযৌক্তিক অপ্রাসঙ্গিক আজগুবি এমনকি আত্মঘাতী কথাবার্তা বলছেন বাংলালিংক দামে। নন-প্রোডাক্টিভ সব বেহুদা বাক্যব্যয় করে আবার পরক্ষণেই হয় ‘আংশিক অস্বীকার’ করছেন না হয় বলছেন “আমার বক্তব্যের অপব্যাখা করেছে অপশক্তি”।
বয়োবৃদ্ধ আবদুল গাফফার চৌধুরীর জন্য বিলেতের মনোবিজ্ঞানী বা সাইকোলজিস্টদের কোন ‘প্রেসক্রিপশান’ আছে কি-না, তা ভালো বলতে পারবেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বা যারা তাঁকে কাছে থেকে চলতে-ফিরতে দেখাশোনা করেন তারা। বছরের শেষে তাঁকে নিয়ে প্রবাসীদের এন্তার উদ্বেগের কারণটি হচ্ছে, দূর প্রবাসে কমিউনিটির কল্যানধর্মী সৃষ্টিশীল কথাবার্তা না বলে বেকুবের মতো তিনি যেভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দুর্গন্ধময় ‘ইজম’ তথা আঞ্চলিকতার বীষবাষ্প, তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করছে ইদানিং। সিলেটি-ননসিলেটি বিভাজনকে তিনি মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রমোট করেছেন চলতি ডিসেম্বরেই লন্ডনে ‘চ্যানেল আই ইউকে’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর জন্মদিন উপলক্ষে ‘চ্যানেল আই ইউকে’ তাদের ‘স্ট্রেইট ডায়ালগ’ অনুষ্ঠানটি সেদিন উৎসর্গ করে শ্রদ্ধাভাজন এই ভাষাসৈনিকের সম্মানে। সম্মান-সমাদরের প্রতিদান হিসেবে তিনি চ্যানেলটির লন্ডন সহ ইউরোপ জুড়ে লাখো দর্শক-শ্রোতাদের এমন স্ট্রেইট সম্মানই দিলেন, চলছে এখন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। “সিলেটিরা লাঙ্গল-টু-লন্ডন সংস্কৃতির ধারকবাহক / বিলেতে ভালো সব কাজগুলো করেছে অশিক্ষিত সিলেটিরা / আলাস্কায় গিয়ে দেখি সিলেটিরা পানের দোকান খুলে বসেছে / লন্ডনে আমরা যারা ননসিলেটি আছি”- আবদুল গাফফার চৌধুরীর এমনসব বস্তাপঁচা ডায়ালগ সেদিন শুধু চ্যানেল আইয়ের ভাবমূর্তির বারোটা বাজায়নি, সেই সাথে হতবাক করেছে বিলেত সহ গোটা ইউরোপের নতুন প্রজন্মকে, যাঁরা ভালোবাসেন নিজেদেরকে বাঙালি বা বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দিতে।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর হয়তো জানা নেই, বিলেতের সীমানা পেরিয়ে গোটা ইউরোপের নতুন প্রজন্ম ২০১৬ সালের দ্বারপ্রান্তে এসে মোটেও প্রস্তুত নয় নিজেদেরকে সিলেটি-ননসিলেটি হিসেব পরিচয় দিতে। ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকেই তাঁকে আহবান জানিয়েছেন প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবার। মুখে লাগাম লাগাবার তাঁর এখনই যে উপযুক্ত সময়। নইলে লাঠিতে ভর করে কাল ইতালী বা গ্রীসে গিয়ে এই গুনীজনই বলবেন, “ফরিদপুইরা-শরীয়তপুইরা-নোয়াখাইল্লারা লাঙ্গল-টু-রোম-মিলান-এথেন্স সংস্কৃতির ধারকবাহক”। আঞ্চলিকতা বা ইজমকে প্রবাসে যাঁরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন, তাঁরা চান আবদুল গাফফার চৌধুরী যাতে জীবনের শেষ দিনগুলো ভালোয় ভালোয় কাটিয়ে দিতে পারেন। যুদ্ধাপরাধীদের মতোই ফুলের মালার পরিবর্তে কফিনে একদিন যাতে ছেড়া জুতো-সেন্ডেল নিক্ষেপ করতে না হয়, জীবদ্দশায় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে তাঁরই।