ফেঞ্চুগঞ্জে এইডস আক্রান্ত এক নারীর জীবনযুদ্ধ
এইডস দিবসের বিশেষ প্রতিবেদন
জুয়েল খান, ফেঞ্চুগঞ্জ :॥ “রাইত হুরুতাইনতে (সন্তানরা) আমারে আইনঞ্জা করি ধরিয়া (জড়িয়ে) যখন ঘুমাইন তখন আমার কষ্টটা বাড়ি যায় (বেড়ে যায়)। আমি ঘুমাইতাম পারিনা। ঘুম লাগেনা। চউখ (চোখ) বাইয়া খালি পানি পড়ে। তানরে (স্বামী) মাটি (কবর) দিয়া আইতে না আইতে সবতা চখুর (চোখের) ফলখে হাড়াককাড়া (মুহূর্তে) কিলা বদলি গেলো।
পাড়া-প্রতিবেশীরাও আস্তে আস্তে বদলি গেলা। তারা (পাড়া-প্রতিবেশীরা) আড়ালে-আবডালে আমারে গালাগালি শুরু করলা। আমি ডাইনি, আমার লাগি হুরুতার বাপ মারা গেছইন। আমি অপয়া, অলক্ষ্মী-রাক্ষুসি। আমার শ্বাসো (নিঃশ্বাস) বিষ।
আমার কান্দাত (কাছে) যে আইবো তার এইডস রোগ অইব। কলোনির টিউবওয়েল (চাপকল) থাকি পানি আনতে দেয়না। টিউবওয়েল ছইতেও (স্পর্শ) দেয়না। যারা আমার কান্দার মানুষ যারা আছলা তারাও আস্তে-আস্তে দূরে গেলাগি। আমারে কলোনি থাকি তাড়াইবার লাগি চেয়ারম্যানোর অফিসও কত সালিস-বৈঠক করা অইছে।
কিন্তু আমি দুর্বল অইছিনা। পয়লা (প্রথমে) যে কলোনিত থাকতাম অউ কলোনির মালিক মাইনষর (মানুষের) কথা হুনিয়া (শোনে) আমারে খেদাই দিছে (তাড়িয়ে দিয়েছে) কিন্তু আমি দুর্বল অইছিনা। এক কলোনি থাকি আরেক কলোনি গেছি থাকার লাগি (বসবাসের জন্য)। রোগর কথা জানাজানি হওয়ায় যে কলোনিত অউ যাই কলোনির মালিকে ঘর ভাড়া দেয়না। এর লাগি হুরুতার (সন্তানদের) লইয়া কিছুদিন আগে অন্য এলাকাত আইচ্ছি (চলে এসেছি)।”
চাপা কান্নার স্বরে মোবাইল ফোনে কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার গৃহবধূ কমলা বেগম (ছদ্ধনাম)। স্বামীর মাধ্যমে এইচআইভির জীবাণু বহনকারী এই নারী শত প্রতিকূলতা ঠেলে কিভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, সে বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।
খানিক বিরতি দিয়ে ফের শুরু করেন কমলা বেগম। বলতে থাকেন- “কত ভালা (সুখে) আছলাম। রোগের কথা জানাজানির পর কলোনির কিছু মানুষ ইউনিয়ন পরিষদো গিয়া অভিযোগ করলা। আমারে কলোনি থাকি না তাড়াইলে তারা আমার ঘরো আগুন লাগাইয়া আমারে জ্বালাইয়া মারি লাইবা। অফিসর (এনজিও) মাইনষে আইয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার হকলরে বুঝাইলা। কিন্তু কোন লাভ অইলোনা। তারার সাফ কথা কলোনি ছাড়িয়া যাইতেগি অইবো (যেতে হবে)।” কথা বলতে বলতে দম নিলেন কমলা বেগম।
মরণব্যাধি এইডসে অকালমৃত্যু হয়েছে কমলা বেগমের স্বামী বাদশা মিয়ার (ছদ্ধনাম)। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের এক সভ্রান্ত পরিবারের ছেলে বাদশা মিয়া। পরিবার ত্যাগি বখে যাওয়া বাদশা ১৯৯৮ সালে মৌলভীবাজারের জুড়ী এলাকা থেকে নিজের পছন্দের মেয়ে কমলা বেগমকে বিয়ে করে ফেঞ্চুগঞ্জ রেল কলোনিতে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। বাদশা-কমলার সুখের সংসারে জন্ম নেয় একটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তান। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে কমলা বেগমের সংসার ভালই চলছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে বিপথগামী হতে থাকেন বাদশা মিয়া। মাদকসেবন ও উশৃঙ্খল জীবনযাপন করে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন বাদশা মিয়া।
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার শরীরে এইচআইভির জীবাণু শনাক্ত হয়। পরিবার-পরিজনের কাছে রোগের কথা চেপে যান বাদশা। গোপনে সিলেট শহরে অবস্থিত একটি এনজিওর অধীনে চিকিৎসা নিতে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী’র মেলামেশার কারণে স্ত্রী কমলা বেগমের শরীরেও এইচআাইভির জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় ২০০৩ সালের ২৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন বাদশা মিয়া। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে একাই লড়াই করে যাচ্ছেন কমলা। বর্তমানে ছেলে দিন মজুরি ও মেয়ে গৃহভৃত্যের কাজ করে যা আয় করেন তা নিয়ে সংসার চলে কমলার।
আশার আলো সোসাইটির সিলেট কার্যালয়ের সমন্বয়কারী তাহমিনা বেগম বলেন- “সামাজিক নিরাপত্তার করণে আমরা রোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করিনা। তবে আমরা তাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থার করে থাকি। পাশাপাশি রোগীদের রোগ প্রতিরোধের জন্য মেডিসিন সরবরাহ করে থাকি।”
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শফিকুল আলম বলেন- “সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা এইডস রোগ ও রোগী নিয়ে কাজ করে। বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে স্থানীয় রোগী সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানিনা।”