স্কুলছাত্র সাঈদ হত্যা মামলার রায়ের সম্ভাবনা মঙ্গলবার
ডেস্ক রিপোর্টঃ অবশেষে নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সিলেট নগরীর শাহ মীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে এ সাপ্তাহে। তবে রায় ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে আগামী মঙ্গলবার।
বৃহস্পতিবার সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মোশারফ হোসেন, কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) তারেক মো. মাসুদ ও সাঈদের লাশ বহনকারী কোতোয়ালী থানার কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন।
এ নিয়ে সিলেটের বহুল আলোচিত হত্যা মামলায় ৩৭ সাক্ষীর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত মোট ২৮ জন সাক্ষীর মধ্যে দিয়ে শেষ হলো এ সাক্ষ্য গ্রহণ। এমনকি আগামী রোববার চার আসামিদের উপস্থিতিতে মামলার যুক্তিতর্কের তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালতের বিচারক মো. আব্দুর রশিদ।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে এ মামলায় অভিযুক্ত এসএমপির এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ কনস্টেবল (বরখাস্ত) এবাদুর রহমান পুতুল, র্যাবের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা, সিলেট জেলা ওলামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম রাকিব ও প্রচার সম্পাদক মাহিব হোসেন মাসুমকে পুলিশি পাহারায় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। তাদের উপস্থিতিতে গতকাল ৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ফের তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
যেভাবে সাঈদকে হত্যা করা হয়- চলতি বছরের ১১ মার্চ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাসায় ফেরার পথে সিলেট নগরীর রায়নগর থেকে স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে (৯) অপহরণ করা হয়। এরপর পুলিশ ১৩ মার্চ রাতে এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান পুতুলের কুমারপাড়াস্থ ঝর্ণারপাড় সবুজ-৩৭ নং বাসার ছাদের চিলেকোঠা থেকে সাঈদের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে। পরে এ ঘটনায় এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল এবাদুর, র্যাবের কথিত সোর্স গেদা ও ওলামালীগ নেতা রাকিবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই তিনজনই আদালতে খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দিও প্রদান করেন। নিহত আবু সাঈদ রায়নগরস্থ হযরত শাহ মীর (র.) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ও একই এলাকার দর্জিবন্দ বসুন্ধরা ৭৪ নম্বর বাসার আব্দুল মতিনের পুত্র। তাদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার এড়ালিয়াবাজারের খশিলা এলাকায়।
সাঈদকে অপহরণ করার পর তার পরিবারে কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে পুলিশ। ‘টাকার জন্যই খুন করা হয়েছিলো সাঈদকে। আমাদের চিনে ফেলায় গলাটিপে তাকে খুন করি। খুনের আগে আমাদের পরিকল্পনার কথা জেনে যায় সে। আমাদের পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষাও চায়। কাউকে এ অপহরণের কথা বলবে না বলেও জানায়। কিন্তু নিজেদের রক্ষা করতে আমরা তাকে গলাটিপে হত্যা করি। এরপর লাশ গোপন রাখতে পরপর ৭টি বস্তার ভেতরে বন্দি করে রেখে দেই।’ এভাবে ১৬৪ ধারায় স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ঘাতক পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর। অপহরণের পর অপহরণকারীদের কথামতো মুক্তিপণের টাকা হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহে নিয়ে গেলে সেখানে তাদের পাওয়া যায়নি। পরে অপহরণকারীদের কথামতো টাকা নিয়ে ফের বিমানবন্দর এলাকায় বাইশটিলায় গেলে ওইস্থানে যাওয়ার পর সাঈদের পরিবার অপহরকদের মোবাইলফোন বন্ধ পেয়ে বাসায় চলে আসেন। পরে পুলিশ ফোন ট্র্যাকিং করলে ওই নম্বরটি এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ কনস্টেবল এবাদুলের বলে জানতে পারে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়- চলতি বছরের ১১ মার্চ নগরীর শাহ মীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ অপহৃত হয়। ঘটনার তিনদিন পর নগরীর ঝর্ণারপাড়স্থ এলাকার একটি বাসা থেকে সাঈদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ মার্চ নিহতের বাবা আব্দুল মতিন কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোশাররফ হোসেন জানান- গত ২৩ সেপ্টেম্বর মাহিব হোসেন মাসুমসহ ৪ জনকে অভিযুক্ত অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। পরে অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। এরপর গত ২৩ সেপ্টেম্বর এই মামলায় সিলেট মহানগর হাকিম ১ম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মহানগর পুলিশের সহকারি কমিশনার (প্রসিকিউশন) আবদুল আহাদ চৌধুরী। মামলাটি তদন্ত করেন কোতোয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোশাররফ হোসাইন। ৭ অক্টোবর অভিযোগপত্রের উপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
২৯ অক্টোবর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সাহেদুল করিম চার্জশিট আমলে নিয়ে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নথিপত্র স্থানান্তর করেন এবং ৮ নভেম্বর এই আদালত মাছুমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ও মালামাল ক্রোকের আদেশ দেন। আদেশের একদিনের মাথায় পলাতক আসামি মাছুম ৯ নভেম্বর সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করলে আদালত তার জামিন আবেদন না-মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। এরপর চার্জগঠনের কয়েকটি তারিখ পরিবর্তন হয়।
আদালতে যারা সাক্ষ্য দিলেন- ১৯ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন সাঈদের পিতা মতিন মিয়া, মামা আশরাফুজ্জামান, প্রতিবেশী ফিরোজ আহমদ, ওলিউর রহমান ও শফিকুল ইসলাম। ২২ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন সাঈদের মা সালেহা বেগম, সাঈদের আরেক মামা জয়নাল আবেদীন, তার শ্যালক সৈয়দ হিলাল, এয়ারপোর্ট থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) গৌছুল হোসেন, এসআই সমরাজ মিয়া ও কনস্টেবল কাশেম।
২৩ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন মো. সেলিম আহমদ, মো. আজির উদ্দিন, আবুল হোসেন, আব্দুস কুদ্দুস, মোক্তাদির আহমদ, দেলোয়ার হোসেন ও আব্দুল আহাদ তারেক। ২৪ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (আমলী-১) মো. সাহেদুল করিম, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট (আমলী-২) মোছা. ফারহানা ইয়াসমিন, সিলেট সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) শামিমুর রশিদ পীর ও আসামী এবাদুর রহমান পুতুলের সঠিক নাম-ঠিকানা যাচাইকারী এএসআই রতন লাল দেব। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন- মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মোশারফ হোসেন, কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) তারেক মো. মাসুদ ও সাঈদের লাশ বহনকারী কোতোয়ালী থানার কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল মালেক বলেন- বৃহস্পতিবার আসামিদের উপস্থিতিতে মামলার আইওসহ ৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো সাঈদ হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। এ মামলায় আদালতে মোট সাক্ষী ২৮ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। বাকিদের সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। আগামী রোববার এ আলোচিত মামলার যুক্তিতর্ক শেষে মঙ্গলবার রায় ঘোষণা হবার সম্ভবনা রয়েছে। তিনি বলেন- গতকাল ৩৪২ ধারা মোতাবেক আসামিদের দোষ স্বীকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এসময় আসামিরা দোষ স্বীকারে অস্বীকার করেছেন।