মার্কিন যুদ্ধনীতির খেসারত দিচ্ছে গোটা বিশ্ব
মাত্র কয়েকদিন পূর্বে ঢাকায় যে রক্তের দাগ দেখেছিলাম হুবহু সেই রক্তের দাগ দেখলাম প্যারিসের শহরজুড়ে । ২০০৮ সালে তেমন রক্তের দাগ দেখেছিলাম ভারতের মুম্বাইয়ের রাস্তায় কিংবা ২০১৪ এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পেশোয়ারের একটি স্কুল জুড়ে । কেবল ছোপ ছোপ রক্তের লাল লাল দাগ । আক্রান্ত হওয়া এবং আক্রমনকারীর-উভয়ের শরীর থেকে গাঢ় লোহিত রঙের লহুর ফোঁয়ারা ছুটেছে । একদল মারছে আরেকদল মরছে । ক্ষতের পর ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে গোটা বিশ্বা ব্যাপিয়া । যারা প্রাণে বেঁচে গেছে তারা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে । একদিকে স্বজন হারানোদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে অন্যদিকে আক্রমনকারীরা একটি অভিযানে সাফল্য পেয়ে নতুন অভিযানের ছঁক কষছে । রক্তের হলিখেলায় দুধের শিশু থেকে আশীতিপর বৃদ্ধরাও বারবার আঁৎকে উঠছে । এই বুঝি আত্মঘাতী হামলাকারীর ছোড়া বোমা কিংবা বুলেটে প্রাণবন্ত দেহগুলি মূহুর্তেই নিথর হয়ে যাবে । চরম বীভৎস অনিশ্চয়তায় কে, কোথায়, কিভাবে আত্মরক্ষা করবে তার উপায় খুঁজছে । কিন্তু পালানোর যায়গা কোথায় ? কেউ স্বধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রবাদের আশ্রয় নিয়ে মানুষ খুন করাকে বৈধ ঘোষণা করছে , কেউ শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মরণাস্ত্রের খেলায় নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে আবার কেউ দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মরণ কামড় দিতে ব্যস্ত । ফলাফলে লাশের স্তুপে পরিণত হচ্ছে গোটা জনপদ । লাশের সংখ্যায় নিত্য নতুন যোগ হচ্ছে অগণণ দেহ । সর্বশেষ ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারালো ১২৯ জন, শতাধিক গুরুতর আহত । গুরুতর আহতদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দ্রুত ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে । সন্ত্রাসী হামলার নতুন তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন শহর-নগর-স্থাপনা । বিশ্ব নেতারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও থামছে না সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য । অন্যদিকে যে বিশ্ব নেতারা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যের অন্তরালেও রয়েছে ব্যাপক স্বার্থনিজতা । কেউ কেউ সন্ত্রাসী হিসেবে শুধু মুসলিমদের চিহ্নিত করতে ব্যস্ত আবার কেউ ব্যস্ত তার ক্ষমতার প্রভূত্ব কায়েমে । ফ্রান্স হামলার সাথে জড়িত সন্দেহে ফ্রান্স ও বেলাজিয়াম থেকে এখন পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে । সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরপরই এর দায় স্বীকার করেছে আইএস । বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বেও যদি কেউ খুন হয় সে খুনের দায় ঢালাওভাবে আইএস স্বীকার করায় জনমনে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে । তবে শঙ্কাও কম নয় । কেননা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে আইএসের উত্থানকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করার কোন সুযোগ নাই । এবার সিরিয়ার আইএস দমনের নামে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে বিশ্বক্ষমতা দখলের যে মানসিকতা দেখা গেছে তাতেও আইএস এবং মার্কিননীতির সম্পর্ক ও শত্রুতা নিয়ে সংশয় ঘণীভূত হয় । আজ যে আইএস আতঙ্কে গোটা বিশ্ব কাঁপছে সে আইএসের জন্মদাতা ও লালনকর্তা কারা ?
রোমান্সের দেশ হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সের হামালাকারীরা যদি আইএসের সদস্য হয় তবে সর্বপ্রথম জবাবদিহীতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার আমেরিকাকে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সে এমন রক্তের বন্যা একবারও প্রবাহিত হয়নি । একবিংশ শতাব্দীর পূর্বের বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল স্বয়ং আমেরিকা । ৯/১১ এ টুইনটাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার জন্য আফগানিস্তানে মার্কিনিদের হামলা এবং পারমানবিক অস্ত্রের মওজুদ রাখার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাকে হামলা করে হাজার হাজার নিরীহ মুসলামনকে যে আমেরিকা হত্যা করেছিল সেই আমেরিকাই আবার সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগীতা করে যাচ্ছে । ইস্রাইলের ইন্ধনে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে আল কায়েদা ও তালেবান আক্রান্ত অভিযোগ তুলে আমেরিকা বারবার সামরিক অভিযান চালিয়েছে । এ সব অভিযানে দোষীদের দমন করতে পেরেছে যতটুকু তার চেয়ে নিরীহ মানুষকে খুন করেছে কয়েক হাজার গুন । সর্বশেষ আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে কিন্তু এখানে আমিরকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যতটুকু তার চেয়ে বেশি ঘণীভূত হয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভ । শিয়া, সুন্নী ও কুর্দি অধ্যুষিত ইরাক ভৌগোলিক অবস্থানে নামেমাত্র একটি দেশ থাকলেও আমেরিকা সে দেশের সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে উগ্রবাদীদের উত্থানে সহায়তা করেছে । ইরাকের অভ্যন্তরে মার্কিনিদের কারাগারগুলোতেই তৈরি হয়েছে আজকের কথিত আইএস । এই আইএস অস্ত্র পেল কোথায় ? বিশ্বের এমন কোন মুসলিম দেশ নাই যারা মরণাস্ত্র তৈরিতে সফল হয়েছে । অস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষে অবস্থানকারী পশ্চিমা দেশগুলো যদি আইএসের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করত তবে আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি এমন বিপর্যস্ত হত না । মানুষের জীবন এমন অনিরাপদ থাকত না । যে দেশগুলো নিত্য নতুন শক্তির অস্ত্র উদ্ভাবন করে সে দেশগুলোর পুরানো মডেলের অস্ত্র বিক্রয় করার জন্য ক্রেতার দরকার ছিল । আর সেই ক্রেতাই হয়েছে আইএস । যাদের কাছ থেকে এরা অস্ত্র কিনেছে সেই অস্ত্র দিয়েই তাদের প্রতি চড়াও হচ্ছে । তবে দু’দিকেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ ও নিরীহ মানুষ ।
আজ যারা মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে তাদের অতীত পরিসংখ্যান স্মরণে রাখা উচিত । কোন প্রকৃত মুসলিম অন্যায়ভাবে সাধারণ ও নীরিহ মুসলিম হত্যা করতে পারে না । আজ পর্যন্ত নামধারী মুসলিমদের দ্বারা যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে তার কয়েক লক্ষগুন বেশি আক্রান্ত হয়েছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী দ্বারা; হিটলারের ইহুদী নিধন যার অনন্য উপমা । তাছাড়া প্রকৃত ইসলাম ও মুসলমান উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মানবহত্যার বৈধতা তো দেয়ই না বরং এর বিরুদ্ধে সর্বদা তাদের কঠোর অবস্থান জানান দেয় । আজ যাদেরকে আইএস, জঙ্গী, তালেবান আল-কায়েদা হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগ সেই সব মানুষের অন্তভূর্ক্ত যারা মার্কিনি তথা পশ্চিমাদের সংঘবদ্ধ চাপে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েছিল । পশ্চিমাদের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমনে প্রতিদিন যাদের নিকাটাত্মীয়-স্বজন হারানোর গল্পগুলো কেবল দীর্ঘায়িত হয়েছিল । তবুও প্রতিশোধ হিসেবে রক্তের হলিখেলা তথা উগ্রতাকে শান্তির ধর্ম ইসলাম অনুমোদন করে না বরং কঠোরভাবে নিষেধ করে । যারা আজ উগ্রবাদকে বেছে নিয়েছে তারা পশ্চিমাদের নির্যাতনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে আবার পশ্চিমাদের মরণখেলার দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে । ফ্রান্সে হামলার পর বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর পাঁচ নেতা ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছে । প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিকারেই কি তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন ? তারা কিসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবেন ? প্রকৃত সন্ত্রাসীদের দমনে নাকি ইসলাম ও মুসলিমদের দমনে ? ইসলামে উগ্রবাদ যেমন সন্ত্রাসী কর্মান্ডের আওতাভূক্ত হওয়ায় ইহা পরিত্যাজ্য তেমনি সন্ত্রাসবাদের লালনপালনকারী হিসেবে মার্কিনিদের যুদ্ধনীতি ও স্বার্থনীতির সমালোচনা হওয়া আবশ্যক । মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের অযাচিত আক্রমন ও নীচ স্বার্থ উদ্ধারের কারণে আজ জন্ম হয়েছে আইএসের এবং রক্ত জড়ছে নিরীহ-নির্দোষ মানুষের ।
আইএসের জন্মদানে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের চেয়েও সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের দায় বহুগুন বেশি । তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবাম পরপর দুই মেয়াদে আমেরিকার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে আসীন হওয়ার পর শুরুতেই যদি বিশ্বক্ষমতা করতলগত করার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের কর্তৃত্ব দ্রুত ঘুটিয়ে নিত তবে বিশ্ববাসির বর্তমান পরিণতি হত না । যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেল পাচ্ছে তাদের কারনেই যখন একদল উগ্র-সন্ত্রাসীর জন্ম হয় তখন সেটার সমালোচনার চেয়ে নিন্দা করা বেশি জরুরী । এখনো যদি আন্তর্জাতিক ক্ষমতালিপ্সুরা তাদের সিদ্ধান্তের ভুল বুঝতে পারে তবে সেটা বিশ্বাবাসীর জন্য মঙ্গলের হবে । ধর্মের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ না করে ধ্বংসের ক্ষতকে আরেকটি ধ্বংস দিয়ে সারিয়ে তোলা দরকার । যাকে অবশ্যই হতে হবে স্বার্থের উর্ধ্বে অবস্থান করে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ।
গোটা বিশ্ব যখন সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে কম্পমান তখন আমাদের বাংলাদেশও মারাত্মক ঝুঁকিতে । কাজেই দেশ ও দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় সচেতন হওয়ার বোধহয় এটাই উত্তম সময় । ফ্রান্সে যে রক্তের দাগ লেগেছে এমন দাগ বাংলাদেশের কোথাও যেন লাগতে না পারে । রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর বিপরীতমূখী অবস্থান দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও হুমকিতে ফেলছে । এটা রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা উচিত । পারস্পারিক দোষারোপের রাজনীতি বাদ দিয়ে এখন দরকার দৃঢ় ঐক্যের রাজনীতি; দেশ বাঁচানোর লড়াই । তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়য্ন্ত্র এবং বিদেশী নাগরিক হত্যার বিষয়টিও নিরাপত্তার অনিশ্চয়তাকে আরও পোক্ত করেছে । লাশের বোঝা বইবার মত শক্তি এ জাতির নাই । অনুগ্রহ করে, রাজনৈতিক ঐক্য তৈরির মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসকে প্রতিহত করুণ । যে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যের নিরাপত্তায় সহায়তা করে সেই শক্তিই আজ তাদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবছে । তবুও নিরাপদ রাখতে পারছে না স্ব-আবাসভূমকে । দেশের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে আরও তৎপর হয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে । শুধু সরকারের বিরুদ্ধাচারীদের দমন করাতেই যেন তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত না করেন বরং প্রকৃত সন্ত্রাসীদের কিভাবে দমন করা যায় তার জন্য সকলের সহযোগিতা নিয়ে কার্যকার ব্যবস্থা গ্রহন আবশ্যক । সরকারকেও এ বিষয়য়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত দিক-নির্দেশনা দিতে হবে । সময় থাকতেই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত । রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে এখন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি দায়িত্বশীল অভিভাবক এ জাতির বড় প্রয়োজন ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।