আমানতদার রাখাল : আখতার হোসাইন জাহেদ
ইতোমধ্যে ইসলামের প্রথম খলীফা,সিদ্দীকে আকবর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত ওমর (রা.) এখন মুসলিম জাহানের খলীফা। ধুলির তখতে বসে অর্ধজাহান শাসন করছেন তিনি। মানুষেরা খলীফাকে আমীরুল মু’মিনীন বলে ডাকে। সবার অভাব অভিযোগ খলিফা শুনেন, বুঝেন। এদিকে তার কাছে অন্যায়কারী ও জালিমরা ভোগ করে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি।
হযরত ওমর (রা.) এর চমৎকার একটা অভ্যাস ছিল। সময় পেলেই তিনি শহরের অলি গলিতে ঘুরে বেড়াতেন। কখনও বা চলে যেতেন শহরের বাইরে, গ্রমে-গঞ্জে,একেবারে পল্লী এলাকায়। সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের খোঁজ খবর নিতেন। যারা অভাব অনটনে আছে তাদের অভাব দূর করতেন। যারা রুগ্ন-অসুস্থ নিজ হাতে তাদের সেবা করতেন। কোথাও কোন অন্যায় অভিচার দেখলে তা প্রতিরোধ করতেন।
একদিন চদ্মবেশী ওমর (রা.) চলতে চলতে শহরের বাইরে বহুদূর চলে গেছেন। সাথে কোন সফর সঙ্গীও নেই।অনেক পথ চলার কারণে এক সময় তার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগল। ধুধু মরু প্রন্তরে কোথাও কোন লোকালয় চোখে পড়ছে না তার। ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির তিনি। মুখে দেওয়ার মত দু’মুটো খাবারও কাছে নেই। এবার তাহলে উপায়?
ক্ষুধা পিপাসায় কাতর খলিফা সামনে চলতে লাগলেন। বেশ কিছু পথ অগ্রসর হওয়ার পর একটি বকরির পাল নজরে পড়ল। মনে মনে ভাবলেন, বকরির মালিক থেকে কিছু দুধ নিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা নিবৃত করবেন। তাই সেখানে গিয়ে বললেন, ভাই! আমি একজন মুসাফির, সাথে কোন খাবার নেই। আমার বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। যদি তুমি অনুগ্রহ করে কিছু পয়সার বিনিময়ে আমাকে সামান্য দুধ দাও তবে বড় উপকৃত হব।
উত্তরে লোকটি বলল, হে সম্মানিত অতিথি! আমি অবশ্যই আপনার আবেদন পূর্ণ করতাম, দুধ পান করিয়ে আপনার ক্ষুধার যন্ত্রণা দূর করতাম। কিন্তু দুঃখ লাগছে এজন্য যে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তা পারছি না। কারণ এসব বকরির মালিক আমি নই, আমি একজন রাখাল মাত্র। সুতরাং আপনিই বলুন, মালিকের অনুমতি ব্যতীত দুগ্ধ দোহন করে কিভাবে আপনাকে তা পান করাব?
রাখালের সততায় একটা খুশি দোলা দিয়ে যায় খলীফার অন্তরে। ঠোটের কোণে ফুটে উঠে একটা মৃদু ক্ষীণ হাসির রেখা। অভূতপূর্ব আনন্দে হৃদয় মন নেচে উঠে তার। সেই সাথে ভুলে যান ক্ষুধা পিপাসার যন্ত্রণার কথাও।
হযরত ওমর (রা.) কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে রাখালের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর তাকে আরেকটু পরীক্ষা করার জন্য বলেন, যদি আমার কথা মত কাজ কর, তবে তোমাকে দারুণ একটি প্রস্তাব শুনাব। বুঝতেই পারছ, প্রস্তাবটি নিশ্চয় লাভজনক হবে।
রাখাল বলল, বলুন আপনার কি প্রস্তাব। খলীফা বললেন, তুমি একটি বকরি আমার নিকট বিক্রি কর। বকরির মূল্য এখনই তোমাকে দিয়ে দেব। এতে বকরি দোহন করে আমি যেমন দুধ পান করতে পারব তেমনি প্রয়োজন হলে তা জবাই করেও খেতে পারব। পরে মালিক তোমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলবে একে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। আর বাঘ তো বকরির উপর হামলা করেই থাকে।
বাঘ আসলেই বকরি খেল কি-না, তা তো মালিক আর যাচাই করে দেখবে না। আর যাচাই করবেই বা কেমন করে? এখন তো তোমার সাথে অন্য কোন রাখাল নেই যে, তার কাছে মালিক জিজ্ঞাসা করে প্রকৃত অবস্থা অবগত হবেন। এদিকে আমার দেয়া অর্থগুলো তোমার নিকট থাকলে বিপদে আপদে অনেক উপকারে আসবে। প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে।
ইচ্ছে হলে, পরিবারের লোকদের জন্য ভাল কোন জিনিস ক্রয় করে নিবে। এতে তারা, তোমার উপর সীমাহীন খুশি হবে। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাবে। মোটকথা, আমার এ প্রস্তাবটি তোমার জন্য বড়ই কল্যাণ বয়ে আনবে। সেই সাথে আমারও কিছু উপকার হয়ে যাবে।
রাখাল খলীফাকে চিনতে পারেনি। সে এতক্ষণ তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। খলীফার বক্তব্য শেষ হলে রাখাল বলল, ভাইজান! আপনার ধারণা মতে প্রস্তাবটি হয়তো বেশ সুন্দর এবং উভয়ের জন্য সুবিধাজনক। তা মেনে নিলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমার আপনার কিছু ফায়দা হবে এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু মিথ্যা বলে মালিককে না হয় প্রতারিত করতে পারব, তাকে বুঝিয়ে দিতে পারব, সত্যিই বকরিটিকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে, কিন্তু যিনি আমার মালিকেরও মালিক, যিনি সব কিছু দেখেন, শুনেন, বুঝেন সেই রাব্বুল আলামীন আল্লাহকে তো প্রতারিত করা যাবে না, পার পাওয়া যাবে না মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে। সুতরাং আমার পক্ষে আপনার প্রস্তাব মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
রাখালের বক্তব্য শুনে আবারো অনাবিল এক আনন্দে আপ্লুত হল খলীফার হৃদয় মন। খুশির ঝাপটা তার সমস্ত অন্তরে একটা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে গেল। বললেন তিনি, যতদিন এ পৃথিবীতে তোমার ন্যায় সৎ, আল্লাহ ভীরু ও বিশ্বস্ত মানুষ বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এ জাতির উপর কোন বির্পযয় নেমে আসবে না। মনে রেখো, যে পর্যন্ত মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার ভয় থাকবে, সে পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অবশিষ্ট থাকবে। আর যে দিন মানুষের হৃদয় থেকে জবাবদিহিতা ভয় বিলুপ্ত হবে সে দিন মানুষ আর মানুষ থাকবে না, হায়েনায় পরিণত হবে। হবে বাঘের ন্যায় হিং¯্র ও রাক্ষসের ন্যায় রক্ত পিপাসু।
লেখকঃ
আখতার হোসাইন জাহেদ
সংগঠক