ছাতক সিমেন্ট কারখানা : কাজ শেষ হওয়ার আগেই ছাড়পত্র, দু’মাসে ১৩কোটি টাকা গচ্ছা
চান মিয়া, ছাতক সংবাদদাতাঃ ছাতক সিমেন্ট কারখানায় ২০কোটি টাকার কার্যাদেশের প্রথম দফায় এইচইসি কিলনের সাড়ে ৮কোটি টাকার কাজ শেষ ও এটি চালু না করেই বিসিআইসির বোর্ড সভায় কাজ সম্পন্ন কথা হয়েছে মর্মে ঠিকাদারি প্রতিষ্টানের পক্ষে সাফাই দেয়া হয়। যদিও বরাদ্ধের দ্বিগুন টাকা ব্যয় করে মেয়াদের দু’মাস পরও এটি চালু করা যায়নি। এতে দীর্ঘদিন থেকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় প্রত্যহ কারখানার ২০লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ফলে শ্রমিক-কর্মচারি বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ১৭ডিসেম্বর ২০১৪ইং থেকে ৮মাসে এইচইসি কিলনের মেরামত কাজ শেষ করার চুক্তিতে কার্যাদেশ গ্রহন করে ক্যাথওয়েল্ড কন্ট্রাকশন কোং লিঃ। একাজে সাড়ে ৮কোটি টাকা বরাদ্ধ হয়। কিন্তু মেয়াদ শেষে আরো দু’মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও কাজ শেষ করে কারখানা চালু করা হয়নি। একাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, ২কোটি ৯৪লাখ ৩০হাজার টাকার চার পিস শেল ও চার পিস রোলার, ৯৭লাখ ৫০হাজার টাকার ৩নং ও ৪নং ফাউন্ডেশনের ২পিস শেল, ২১লাখ টাকার ১নং ও ২নং ফাউন্ডেশনের মধ্যে ১পিস শেল (নতুন-১.২৫মিটার), ১৪লক্ষ ৬২হাজার ৫শ’টাকার ৪নং ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ পাশের একটি মিটার-শেল কর্তন করে পূনরায় এক পিস শেল প্রতিস্থাপন, ২১লাখ ৫০হাজার টাকা এসব মালামাল প্রতিস্থাপন ও আরো ৫কোটি ৭০লাখ ২৫হাজার টাকার মেরামত কাজে মোট ১৬কোটি ১০লাখ ১৭হাজার ৫শ’টাকা ব্যয় হয়। একই কাজে কারখানা থেকে দেয়া সিজা মেটাল কোম্পানীর মাধ্যমে ৪০টি ফাষ্টসিয়াল বেয়ারিং, পিভি কনভেয়ারের বাকেট হুইল, লিঙ্ক, এপ্রোভ কনভেয়ারের বাকেট লিঙ্ক, হুইল, টায়ারের শো, সিম ও বোল্ডসহ সিজা মেটাল কোম্পানীর ৩কোটিসহ আরো চেইন জোনের চেইন, ফায়ার ব্রিকস্, পিভি কন্ভেয়ার, এপ্রোন কনভেয়ার, মেটাল বিয়ারিং, কাষ্ট এ্যাবলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ বাবত মোট ৫/৬কোটি টাকার মালামাল সরবরাহ করা হয়।
জানা গেছে, কার্যাদেশে ১৩কোটি টাকায় এইচইসিও এফএলএস কিলন মেরামতে বরাদ্ধ ছিল। কিন্তু এফএলএস কিলনে কাজ শুরুর আগেই চলে গেছে প্রায় ১৬কোটি টাকা। এ বড় ধরনের তারতম্য নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোন মাথা নেই। তারা জোড়াতলি দিয়েই মিল চালানোর চেষ্ট চালাচ্ছেন বলে জনা গেছে।
সূত্র জানায়, বৃটিশ আমলের এফএলএসও ১৯৮৭সালে প্রতিষ্টিত এইচইসিসহ দু’টি কিলনের অবস্থা এখন নাজুক। ভেঙ্গে-চুরে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে এগুলোর ভেতরে। অসংখ্য জোড়াতালির মাধ্যমে এখন এগুলোর পথচলা। প্রতিবছর জুলাই মাসে কারখানা ওভাররোলিং করার নিয়ম থাকলেও গত দেড় যূগ থেকে না করায় কিলনের এ অবস্থা হয়েছে।
কারখানা কর্তৃপক্ষ জানান, একবছরের গ্যারান্টি ও বুয়েট টেষ্টে বিসিআইসি, সিমেন্ট কারখানাও সিজা মেটালের শেলসহ অন্যান্য মালামাল ইন্ডিয়া থেকে সরবরাহকৃত। উৎপাদনে যাবার পর মালামালের এক বছর গ্যারান্টি ও কাজে কোন ত্রুটি দেখা দিলে নিজ খরছে মেরামত করবে এ দায়বদ্ধতা ঠিকাদারের। কিন্তু কিলন চালু না করেই কর্তৃপক্ষের কাছে তারা কাজ বুঝে দেন। এর ৬মাস পর অর্ধেক, ৯মাস পর পুরো বিলও ১বছর পর সিকিউরিটি মানি উত্তোলন করবে ঠিকাদার। এছাড়া কাজের তদারকির জন্যে এমডিকে প্রধান করে কারখানার ১৬ ও বিসিআইসির ৬সহ মোট ২২জনের কমিটি রয়েছে। তারাই কাজের দায়বদ্ধ রয়েছেন। কিন্তু তাদের চোখের সামনেই এসব অনিয়ম ঘটলেও রহস্যজনক নীরবতায় পালন করায় জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তদারকি কমিটির নেতৃবৃন্দ জানান, ১৮সেপ্টেম্বর কাজ শেষে পরীক্ষামূলক চালুর জন্যে হস্তান্তর করলে বিভিন্ন ক্রুটি দেখা দেয়। এখন এগুলো সারানোর কাজ চলছে। কিন্তু কাজ বুঝে নেয়ার কথা অস্বীকার করেন।
জানা গেছে, সুদসহ শত কোটি টাকা দেনার ভারে ক্রমশঃ ন্যুজ হয়ে পড়ছে কারখানাটি। বিসিআইসির ৪৫কোটি, জালালাবাদ গ্যাসের ১৮কোটি, কেএলএমসির ৫কোটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুইটি ফান্ডের প্রায় ৮কোটি, বিভিন্ন ঠিকাদার ও সরবরাহকারীসহ কারখানার দেনা রয়েছে শত কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের পরও কিলন না চলায় কারখানাটি এখন বন্ধের উপক্রম।
সূত্র জানায়, প্রত্যহ ২শ’৬০মেঃটন কিংকার উৎপাদন হলে চুক্তির মেয়াদের দু’মাসের অধিক সময়ে প্রত্যহ ২০লাখ করে কারখানার ১৩কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে মেরামতে ইন্ট্যাক মালামাল দেয়ার কথা থাকলেও কাটা-ছেঁড়াও পুরাতন দিয়েই চলছে দায়সাড়া কাজ। এখন কোনোমতে চললেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবার নয় অভিমত অভিজ্ঞ মহলের।
এদিকে, ক্যাথওয়েল্ড কোং লিঃ ৮মাস পর ১৬আগষ্ট ১৫ইং কাজ শেষ করার চুক্তিতে ১৭ডিসেম্বর ১৪ইং কাজ শুরু করে। চুক্তির দু’মাস পর চালু না করে রহস্যজনকভাবে ১৯সেপ্টেম্বর কর্তৃপক্ষকে এইচইসি কিলন বুঝিয়ে দেয় ঠিকাদার। এর দু’দিন পর ২১সেপ্টেম্বর বিসিআইসির বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে বলা হয় ‘এইচইসি কিলনের কাজ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার দ্বারা সম্পাদন পূর্বক কারখানা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়ায় বোর্ড যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এইচইসি কিলনের মাধ্যমে উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে কারখানা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেন। কিন্তু বোর্ড সভার একমাস পর কিলনটি এখনও চালু করা যায়নি। পুরো কাজ না করে অচল ও ত্রুটিপূর্ন কিলনটি কিভাবে কর্তৃপক্ষ বুঝিয়ে নেন তা- রহস্যজনক। সিবিএ সাধারন সম্পাদক খলিলুর রহমান জানান, এইচইসি কিলন মেরামতে সাড়ে ৮কোটি টাকা বরাদ্ধ ছিল। এর দ্বিগুন ব্যয় করে ও ত্রুটি সারানো যাচ্ছেনা। তিনি এ কাজের অতিরিক্ত মজুরী কারখানা বহন করছে বলেও দাবি করেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, মেয়াদের ৮মাসে কাজ শেষ না হলে অথবা কিলন চালু করতে না পারলে এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে তা- চুক্তিপত্রে উল্লেখ নেই। এজন্যে কাজে ত্রুটি ও প্রত্যহ ২০লাখ করে গচ্ছা গেলেও এর দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেনা ঠিকাদারী প্রতিষ্টান। ফলে বিষয়টি নিয়ে এখন চরম বেকায় পড়েছেন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে কিলনের আগুন দেয়ার রাস্তায় ৫ ও ৬নং কিলনের পাটের মধ্যখানের জয়েন্টে প্রায় ৭ইঞ্চি ব্যবধান রয়েছে। অদক্ষতার কারনে এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারনে এখন কিলন চালু হচ্ছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে বরাদ্ধের টাকাগুলো দায়সাড়া কাজে গচ্ছা গেলে পরবর্তীতে কে দেবে ফান্ড এবং কোথা থেকে আসবে টাকা। স্থানীয় ও জাতিয় একাধিক পত্রিকায় কারখানায় ব্যাপক দূর্নীতি-অনিয়মের খবর প্রকাশ হলে বিসিআইসি চেয়ারম্যান একটি তদন্ত কমিটি করার নির্দেশ দেন। কিন্তু এখনো কোন কমিটি না করায় হতাশায় ভোগছেন শ্রমিক-কর্মচারিরা। জানা গেছে, বরাদ্ধের দ্বিগুন ব্যয় করেও যখন কিলন চালানো যায়নি, তাহলে অপকর্ম ও লুঠপাট না হয়ে সঠিক কাজ হয়েছে কিভাবে বলা যায়। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ কাজ কমপ্লিট হওয়ার আগেই কিভাবে সন্তোষজনক হয়েছে লিখে সার্টিফিকেট দেন- তা বোধগম্য নয়। এছাড়া বেয়ারিংগুলো এখানে কেটে জোড়াতালি দিয়ে লাগানো হচ্ছে। এতে ছড়াচ্ছে তাদের দূর্নাম। বেয়ারিং ইন্ডিয়া থেকে আনতে ঠিকাদারকে দেয়া হয় সেম্পুল ও ড্রয়িং। ঠিকাদার ড্রয়িং না সেম্পুলে মাল দিতে হবে প্রশ্ন করলে কর্তৃপক্ষ তাকে ড্রয়িং মতে মাল দিতে বলেন। এতে মালের সাইজ সঠিক না থাকায় এখন কাটা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যদিও কোম্পানী অর্ডার মতো সাইজ করেই মাল তৈরী করে থাকে। সাইজ মতো মাল না আনায় এখন মিশেনিং করা হচ্ছে। এ ভূলের মাশুল এখন কোম্পানী গুনছে।
কারখানার এমডি প্রকৌশলী হাসনাত আহমদ চৌধুরী দূর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে মেরামত কাজে মেকানিক্যাল সমস্যার কারনে কিলন চালাতে বিলম্ব হচ্ছে দাবি করে বলেন, দু/এক দিনের মধ্যেই (১৯অক্টোবর) কিলনটি পূরোদমে উৎপাদনে যেতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদারের কাছ থেকে কিলন বুঝে নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। ১৯অক্টোবর থেকে আরো ১সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও কারখানা কিলনটি চালু হয়নি।
এদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্টান ক্যাথওয়েল্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর প্রকল্প প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, কিলনের অ্যালাইনমেন্টসহ ১১টি নির্ধারিত আইটেমের কাজ সঠিক ভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। মোট ১৭টি আইটেম সন্তোষজনকও গ্রহনযোগ্য বলে প্রত্যয়ন করা হয়েছে। তবে কাজটি সুষ্টুভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছে বলে দাবী করা হয়।